|
|
|
|
তৃণমূল-সিপিএমের থেকেও বেশি রেষারেষি দুই বড় ক্লাবে: মুখ্যমন্ত্রী |
অমর এগারোর আলোয় মমতাময় মোহনবাগান দিবস |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
একশো বছর আগের মতোই মোহনবাগান মাঠ থেকে ফিটন গাড়িতে হাত নাড়তে নাড়তে গিরীশ পার্কের দিকে চলে গেলেন শিবদাস ভাদুড়ি, অভিলাষ ঘোষ, হাবুল সরকাররা!
এর ঠিক মিনিট পনেরো বাদেই নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে শুরু হয়ে গেল গান‘আলোকেরই ঝর্নাধারায়.....’।
১৯১১-র ২৯ জুলাইয়ের ঐতিহাসিক আইএফএ শিল্ড জয়ের আলোয় স্নাত হওয়া ২০১১-র মোহনবাগানিরা অবশ্য হাততালির আগুন ঝরালেন যখন ২৯ জুলাইয়ের মঞ্চে দাঁড়িয়েই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলে দিলেন, “খালি পায়ে ব্রিটিশদের হারিয়ে মোহনবাগানের সেই জয় স্বাধীনতা আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। ওই জয় আমাদের হেরিটেজ। আমাদের এখানে তিনটে বড় ক্লাব আছে। সে দিক থেকে মোহনবাগান সবার চেয়ে এগিয়ে।”
একটু আগেই ‘অমর এগারো’র ফুটবল সৈনিকদের ছবি দিয়ে সাজানো সবুজ-মেরুন মঞ্চের দু’পাশের পদার্য় ভেসে উঠেছিল অমিতাভ বচ্চনের মুখ। সঙ্গে সেই অতি পরিচিত ব্যারিটোন! “বাবার এক বন্ধুর সঙ্গে হাওড়া স্টেশন থেকে প্রথম কলকাতায় আকাশবাণীতে প্রোগ্রাম করতে এসেছিলাম। ঢুকে পড়েছিলাম মোহনবাগান মাঠে। সেখানে খেলা হচ্ছিল, তা দেখেছিলাম। আমি তখন থেকেই মোহনবাগান সমর্থক।”
রাজ্যের দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম বার কোনও ক্রীড়ামঞ্চে আবির্ভাব ঘটিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সবুজ-মেরুনকে আপন করে নেওয়ার চেষ্টা, নাকি বিগ বি-র পালতোলা নৌকোর যাত্রী হয়ে পড়ার রহস্য ফাঁস কোনটায় বেশি আপ্লুত হলেন মোহন-সদস্যরা সেটা অবশ্য বোঝা মুশকিল। কারণ দু’টো ঘটনা ঘটার সময়ই সমান উচ্ছ্বাসে ভাসল নেতাজি ইন্ডোর। যা দেখে বোঝার উপায় নেই গত দেড় বছর কোনও ফুটবল ট্রফি ঢোকেনি মোহনবাগান তাঁবুতে। |
|
তিন রত্নের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী। এ বারের মোহনবাগানরত্ন পি কে বন্দ্যোপাধ্যায় ও দুই প্রাক্তন ক্লাবরত্ন শৈলেন মান্না
ও চুনী গোস্বামীর সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মোহনবাগান দিবসে। নেতাজি ইন্ডোরে। -উৎপল সরকার |
ঐতিহাসিক ঘটনার একশো বছর উদযাপনের ডালি অবশ্য ক্লাব কর্তারা সাজিয়েছিলেন ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির পরম্পরা মেনে। কিন্তু সব কিছুই যেন কেমন মমতাময় হয়ে গেল। যাতে চাপা পড়ে গেল অনেক স্মৃতি উগরে দেওয়া মুহূর্ত। মনে রাখার মতো ছবি। ১৯৫০ থেকে ২০১১ সাত দশকের ৩৯ জন অধিনায়কের মধ্যে মাত্র তিন জন আসেননি। যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে দু’এক জন বাদে বাকিদের সবার সঙ্গী ছিল মুখ্যমন্ত্রীর ভাষায় ‘ডাউন মেমোরি লেন’। শৈলেন মান্না থেকে চুনী গোস্বামী, সুব্রত ভট্টাচার্য থেকে ব্যারেটো, শ্যাম থাপা থেকে সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায় বা নিমাই গোস্বামী থেকে বিদেশ বসু, সবার পিছনেই তো রয়েছে অনেক উজ্জ্বল বা অনুজ্জ্বল স্মৃতির সরণি। কারও ইস্টবেঙ্গলকে পাঁচ গোল দেওয়ার, কারও খাওয়ার। কারও টানা সবুজ-মেরুন জার্সি পরার রেকর্ড, কারও হাতে উঠেছে পদ্মশ্রী, অর্জুন। কারও হাতে অসংখ্য ট্রফি। কিন্তু সব ‘সরণি’ যেন দাঁড়ি টানল মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এসে। শুধু মমতা নয়, তাঁর মন্ত্রীসভার কার্যত অর্ধেকটাই উঠে এসেছিল শুক্রবারের সন্ধের ইন্ডোরে। ছিলেন ক্রীড়ামন্ত্রী, কলকাতার মহানাগরিক থেকে সমাজের সর্বস্তরের প্রতিনিধি। ক্লাব কর্তারাও। তাঁদের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী-সহ আট জন মঞ্চে ছিলেন।
ক্লাব কর্তারা চেয়েছিলেন, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সবার হাত দিয়েই অধিনায়কদের গলায় সবুজ-মেরুন উত্তরীয়, সুদৃশ্য পাল তোলা নৌকো এবং ফুল তুলে দিতে। কিন্তু প্রায় সবাই চাইছিলেন, মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে ‘সম্মান’ নিতে। ছবি তুলতে। যা এক সময় দৃষ্টিকটু লাগছিল। ফলে হল কী, অনুষ্ঠানের অন্যতম সেরা আকর্ষণ ভারতের সর্বকালের সফলতম ক্লাব কোচ প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে ‘মোহনবাগানরত্ন’ তুলে দেওয়ার মুহূর্তটাই কেমন যেন ম্যাড়মেড়ে হয়ে গেল। পিকে-র জীবন নিয়ে তৈরি নানা মুহূর্তের ক্লিপিংস দেখানোরও সুযোগ হল না ক্লাবের। যা কোনও বার হয় না। পি কে তাঁর বক্তব্য রাখতে চেয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর সামনে। কিন্তু জরুরি মিটিং থাকায় অতক্ষণ থাকতে পারেননি মমতা। পি কে বললেন, “আমি মোহনবাগানের জন্য অনেক কিছু করেছি। কিন্তু সে ভাবে ওরা কখনও সম্মান দেয়নি। আজ এই পুরস্কার পেয়ে ভাল লাগছে। মোহনবাগানের ভাল হোক।” পি কে-র আগেই সংবর্ধনা জানানো হল অজুর্ন সুনীল ছেত্রীকে। গত বছর কোনও ট্রফি নেই। তাই বর্ষসেরা করুণা ভট্টাচার্য পুরস্কার পেল মোহন-অ্যাকাডেমির সোনু কুমার। অফিসের কাজে বাইরে চলে যাওয়ায় ধ্যানচাঁদ পুরস্কার পাওয়া সাব্বির আলি অবশ্য আসতে পারেননি। আসেননি ভাইচুং ভুটিয়া, রেনেডি সিংহও। |
|
সবুজ-মেরুনের ঐতিহাসিক শিল্ড জয়ের শতবর্ষে ‘অমর এগারো’র জুড়ি গাড়িতে সেই বিজয়মিছিল।
মূর্তিতে শিবদাস ভাদুড়ি, অভিলাষ ঘোষেরা। ময়দানে শুক্রবার। -শঙ্কর নাগ দাস |
পুরস্কার দেওয়ার পর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কী বলেন তা নিয়ে আগ্রহ ছিল। মঞ্চে ওঠার সময় সুব্রত ভট্টাচার্য আর ব্যারেটোর জন্য সবথেকে বেশি হাততালি পড়েছিল। তা ছাপিয়ে গেল যখন মমতা বললেন, “তৃণমূল আর সিপিএমের চেয়েও মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গলের মধ্যে রেষারেষি বেশি। ফুটবল আমার প্রিয় খেলা। ছোটবেলায় রেডিয়োতে বড় ম্যাচের ধারাবিবরণী মন দিয়ে শুনতাম। এখানে তিনটি বড় ক্লাব আছে। আমার ইচ্ছে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহমেডানের মধ্যে যতই রেষারেষি থাকুক, এক দিন তিনটে ক্লাবকে ডেকে গেট টুগেদার করব।” পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রীর স্বীকারোক্তি, “রসগোল্লা, ফুটবল আর ভাপা ইলিশ এই তো আমাদের আছে।” চিৎকার উঠল চিংড়ি-র কী হল? মমতা যোগ করেন, “হ্যাঁ চিংড়িও। বড় ম্যাচের সময় আগে রাস্তায় ঝুলত।” দুঃখ করলেন এখানকার ফুটবলের মান নেমে যাওয়ায়। অ্যাকাডেমি করে ফুটবলার তুলে নেওয়ার জন্য সাহায্যের আশ্বাস দিলেন। তিনি চলে যেতেই অনুষ্ঠানের সব রঙ উধাও।
অনুষ্ঠানে নামী গায়ক গাইছিলেন, “সবুজ-মেরুন, সবুজ মেরুন, পালতোলা নৌকো ছুটছে দারুণ...।” ইতিহাসে ডুব দেওয়া সেরে মোহন-জনতা আপাতত তাকিয়ে প্রিয় টিমের সেই ‘ছোটার’ দিকেই। স্টিভ ডার্বি বা সুনীল ছেত্রীর মঞ্চে উঠে কোমর দোলানোটা মাঠেও দেখতে চান সমর্থকেরা। |
|
|
|
|
|