বিতর্কের বেড়ি খুলে আসন্ন অধিবেশনেই জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন বিলটিকে সংসদে পেশ করতে চান প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। তাই বিলটি সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সকলে যাতে মতামত দিতে পারেন, সে জন্য আজ তার প্রাথমিক খসড়া প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক। তার ঠিক পরেই মনমোহন এবং ইউপিএ
চেয়ারপার্সন সনিয়া গাঁধীর নির্দেশে আগামিকাল কলকাতা যাচ্ছেন গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশ। জয়রামের প্রতি কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের
সঙ্গে আলোচনা না করে যেন পরবর্তী পদক্ষেপ না করা হয়।
একশো বছরেরও বেশি পুরনো জমি অধিগ্রহণ আইনটির সংশোধনে ইউপিএ-র প্রথম দফাতেই সচেষ্ট হয়েছিল মনমোহন সরকার। কিন্তু সংশোধনীটি লোকসভায় পেশের আগেই সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। দ্বিতীয় দফায় সরকারের অন্যতম প্রধান শরিক হলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যাঁর এই উত্থানের পিছনে রয়েছে জমি আন্দোলনের পুঁজি। তখন থেকেই প্রস্তাবিত সংশোধনী নিয়ে সরকারের সঙ্গে তাঁর মতভেদ। সেই মতভেদ মেটাতে আলোচনাও হয়েছে বহু বার। এ বার আসন্ন বাদল অধিবেশনে জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন বিল দু’টিকে একত্র করে নতুন বিল পেশ করতে চাইছে সরকার। তার আগে তাঁর প্রধান শরিক দলনেত্রীর সঙ্গে কথা বলে নেওয়াটা প্রধানমন্ত্রীর কাছে খুবই
গুরুত্বপূর্ণ। তাই বিলটি সংসদে পেশ করার আগে সনিয়া-মনমোহনের নির্দেশে কাল কলকাতায় আসছেন সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম। কাল সন্ধ্যায় কলকাতা পৌঁছবেন তিনি। মমতা ছাড়াও তিনি বৈঠক করবেন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র এবং রাজ্যের জমি কমিটির সদস্য দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। জমি আন্দোলনকে পুঁজি করে ক্ষমতায় আসার আগেই মমতা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছিলেন, জনস্বার্থের দোহাই দিয়ে শিল্পের জন্য কৃষিজমি অধিগ্রহণ করা যাবে না। জানিয়েছিলেন, বেসরকারি শিল্পের জন্য জমি সংশ্লিষ্ট শিল্পসংস্থাকে সরাসরি বাজার থেকেই কিনতে হবে। অর্থাৎ, জমি অধিগ্রহণে বারবরই সরকারের সামান্যতম ভূমিকারও বিরোধী মমতা। কেন্দ্র এর আগে যে বিলটি পেশ করেছিল, সেখানে সর্বোচ্চ ৩০ ভাগ অধিগ্রহণে সরকারের দায়িত্ব বেঁধে রাখার কথা বলা হয়েছিল। তাতে তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন মমতা। তার পর খসড়া পাল্টে ১৫ দফা নতুন প্রস্তাব আনা হয়। তার মধ্যে সব চেয়ে বড় প্রস্তাব, শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণে সরকারের এক্তিয়ার কতটা হবে, তা নির্ধারণের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট রাজ্যের উপরেই ছেড়ে দেওয়া হবে। অর্থাৎ, সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারই ঠিক করবে, আদৌ তারা শিল্প সংস্থার জন্য জমি অধিগ্রহণ করবে কি না, বা করলেও কতটা করবে। আজকে যে খসড়াটি প্রকাশ হয়েছে, তাতে এই কথাই বলা রয়েছে। আজ যে বিলের খসড়া প্রকাশিত হয়েছে, তাতে মমতার অনুরোধ রাখার পাশাপাশি একটি জাতীয় ঐকমত্য তৈরিরও চেষ্টা করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। |
সাধারণ ভাবে বিষয়টিকে মমতার বড় জয় বলেই দেখছেন রাজনীতির সঙ্গে যুক্তরা। পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই নতুন জমি নীতি করার ভাবনা রয়েছে মমতার মাথায়। তিনি একটি দুই সদস্যের জমি কমিটিও তৈরি করেছেন। মমতার বক্তব্য, যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রথায় কোনও রাজ্য আলাদা জমি নীতি করতেই পারে। আজ নতুন বিলের যে খসড়াটি কেন্দ্র প্রকাশ করল, সেখানে মমতার এই কথাকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর ফলে তাঁর নিজের রাজ্যের জন্য আলাদা জমি নীতি চূড়ান্ত করার পথও পরিষ্কার হয়ে গেল। বড় কথা, জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনের প্রশ্নে মমতা দীর্ঘদিন ধরে যে বিষয়গুলি নিয়ে সরব, প্রায় সব ক’টিকেই গুরুত্ব দিয়েছে কেন্দ্র। যার মধ্যে রয়েছে ক্ষতিপূরণ, উর্বর ও বহু ফসলি কৃষিজমি অধিগ্রহণ এড়িয়ে যাওয়া, প্রকল্পের কাজ যথাসময়ে শুরু না হলে জমি আগের মালিককে ফেরানোর মতো বিষয়গুলি।
মনমোহন তো বটেই, সনিয়াও চান, সংসদের আসন্ন অধিবেশনেই পেশ করা হোক জমি অধিগ্রহণ বিলটি। কারণ, গোটা দেশেই জমি আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তার উপরে সামনে উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা ভোট, যে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় জমি অধিগ্রহণ নিয়ে গোলমাল অব্যাহত। বিশেষ করে সম্প্রতি ভাট্টা-পারসলে এই গোলমাল চরমে ওঠে। জমি আন্দোলনকে হাতিয়ার করে এখন উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের রাজনৈতিক জমি উদ্ধারে নেমে পড়েছেন রাহুল গাঁধীও। মায়াবতীকে গদিচ্যুত করার লক্ষ্যে ভাট্টা-পারসলের মতো গ্রামের জমিহারা কৃষকদের ক্ষোভ সংগঠিত করেছেন তিনি। কৃষকদের জন্য গ্রেফতার হয়েছেন। তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে বলেছেন, জমির ন্যায্য দাম চেয়ে কৃষকরা কোনও অন্যায় করেননি। ভাট্টা-পারসলই একমাত্র নয়। এর আগে দাদরির জমি অধিগ্রহণ করে অনিল অম্বানীর সংস্থা শিল্প গড়তে চাইলে বিক্ষোভ হয়েছিল। সেই জমিটি ছিল রেলের। তৎক্ষণাৎ বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করে গোটা প্রক্রিয়াটি স্থগিত করে দেন তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সম্প্রতি গ্রেটার নয়ডায় কৃষিজমি অধিগ্রহণ করে আবাসন গড়ার প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্ক এতটাই তীব্র হয় যে, সুপ্রিম কোর্ট তাতে হস্তক্ষেপ করে। সর্বোচ্চ আদালত নির্দেশ দেয়, গ্রামের বাসিন্দা ও কৃষকদের জমি ফিরিয়ে দেওয়া হোক।
এই অবস্থায় জমি-অস্ত্র ছাড়তে নারাজ সনিয়া। ভাট্টা-পারসল নিয়ে কংগ্রেসের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন মায়াবতী। বলেছেন, কেন্দ্র তো এখনও সংশোধনীটাই পাশ করতে পারল না। এই অবস্থায় ১ অগস্ট থেকে শুরু হতে যাওয়া বাদল অধিবেশনে অধিগ্রহণ বিল পেশ করাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন মনমোহন-সনিয়া দু’জনই। তারই প্রথম ধাপ আজ বিলটির খসড়া প্রকাশ। দ্বিতীয় ধাপে অবশ্যই জয়রামের কলকাতায় এসে মমতার সঙ্গে বৈঠক। যেখানে ঐকমত্য গড়ে তোলার চেষ্টা করবেন তিনি।
সব দেখেশুনে এখন একটা কথাই বলা হচ্ছে। তা হল: সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট এটাই স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে, জাতীয় রাজনীতির এক ‘সিঙ্গুরায়ন’ ঘটে গিয়েছে। আজকের প্রকাশিত খসড়া জমি বিলটি তাতেই সিলমোহর লাগিয়ে দিল। |