|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
গড়ে ওঠে আধুনিকতার নিজস্ব পরিচয় |
সম্প্রতি অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত হল ‘ক্যালকাটা স্কাল্পটর্স’ এর অষ্টাদশতম বার্ষিক প্রদর্শনী। দেখে এলেন মৃণাল ঘোষ |
কলকাতায় ‘ক্যালকাটা স্কাল্পটর্স’ কেবল মাত্র ভাস্করদের যৌথ সংগঠন। ১৯৯৩-তে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেই থেকে নিয়মিত তাঁরা প্রদর্শনী করে আসছেন।
সম্প্রতি অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে অনুষ্ঠিত হল তাঁদের অষ্টাদশতম বার্ষিক প্রদর্শনী। ১৫ জন ভাস্কর অংশগ্রহণ করেছেন। অধিকাংশ ভাস্কর্যই অবয়বী। ১৯৪০-এর দশক থেকে ১৯৮০-র দশক পর্যন্ত আমাদের ভাস্কর্যে পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য রূপবোধের সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে আধুনিকতার নিজস্ব আত্মপরিচয় গড়ে তোলার চেষ্টা চলছিল। এই প্রদর্শনীতে সেই ধারার প্রতিফলনই বেশি। বিগত দশ বছরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তরুণ শিল্পীরা মাধ্যম ও রূপাবয়ব নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। বিশ্বায়ন ও উত্তর-আধুনিকতার ঢেউ এসে আধুনিকতার প্রচলিত ধারাকে অনেকটাই পাল্টে দিয়েছে। সেই পরিবর্তিত আঙ্গিকের ছাপ- এই প্রদশর্নীতে একে বারে নেই তা নয়। কিন্তু খুব কম। |
|
প্রদর্শনীর একটি চিত্র |
শঙ্কর ঘোষ এই প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী সবচেয়ে প্রবীণ ভাস্কর। তিনটি ব্রোঞ্জে তিনি নারীর অবয়বের আয়তনময়তাকে শিল্পিত করেছেন। ‘রিডিং’ রচনাটি খুবই প্রজ্ঞাদীপ্ত ধ্রুপদী অনুভবের কাজ। হাতের উপর ভর দিয়ে অর্ধ-শায়িতা নারী বই পড়ছে। ১৯৬০-এর দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত রূপের যে অভিনবত্ব গড়ে তুলেছিলেন, তারই শ্রেষ্ঠ প্রকাশের দৃষ্টান্ত এই রচনাটি। অনিল সেনের ‘হিউম্যান কমপ্লেক্স’ অবয়বী হলেও স্থাপত্যধর্মী জ্যামিতির রূপের দৃষ্টান্ত। তাপস সরকারের ব্রোঞ্জের রচনাটি একটি বড় পরিবেশ ভাস্কর্যের ছোট সংস্করণ বলে মনে হয়। তিনটি আলম্ব ধাতব দণ্ডকে অবলম্বন করে অজস্র উড়ন্ত পাখির সমাবেশ এই রচনাটির বিষয়। পাখিগুলি অনেকটাই বিমূর্তায়িত। উড়ন্ত পাখির মধ্য দিয়ে এক আনন্দের পরিমণ্ডল সৃষ্টি করতে চেয়েছেন শিল্পী।
প্রবীর রায় দু’টি ব্রোঞ্জ ও একটি মিশ্রমাধ্যমের কাজ করেছেন। ‘গণপতি’তে গণেশের কান ও শুঁড়কে বিস্ফারিত করে বিমূর্ত রূপ সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। সুদর্শন পালের দু’টি ব্রোঞ্জের মধ্যে ‘রিকশাওয়ালা’ কল্পনাদীপ্ত রচনা। রাস্তায় জলের মধ্য দিয়ে সাইকেল রিকশা টেনে নিয়ে যাচ্ছে চালক। সিটে বসে আছে স্কুলের কয়েক জন ছাত্রী। চন্দন রায়ের তিনটি ব্রোঞ্জের মধ্যে ‘মাদার অ্যান্ড চাইল্ড’ অভিনবত্বে উজ্জ্বল। স্বপনকুমার রায়ের তিনটি ব্রোঞ্জের মধ্যে ‘অলটার অব দ্য মিউজ’ অভিনিবেশযোগ্য রচনা। জ্যামিতিক তলবিন্যাসে আধ্যাত্মিক বোধে সঞ্জীবিত এই কাজটিতে সঙ্গীত-নিমগ্ন এক পুরুষের রূপারোপ। পিছনে তানপুরা নিয়ে বসে দুই নারী। কৌশিক পালের তিনটি ব্রোঞ্জের মধ্যে ‘স্কিপিং’ রচনাটি সবচেয়ে উজ্জ্বল। একটি বড়, একটি ছোট--দু’টি মেয়ে স্কিপিং করছে এক সঙ্গে। চিন্ময় কর্মকারের ব্রোঞ্জ ‘ফ্ল্যুট প্লেয়ার’-এ দু’টি ছন্দিত দেওয়ালের রূপারোপ। তার একটির উপর স্থাপিত ক্ষুদ্রাকৃতি এক বাঁশিওয়ালা। তাঁর দ্বিতীয় রচনাটি ব্রোঞ্জ ও কাঠে তৈরি। প্রভাত মাঝির ‘ফ্রেন্ডশিপ’ শীর্ষক দু’টি রচনাতেই ডোকরা আঙ্গিকে নারী ও সাপের রূপারোপ। সোমনাথ চক্রবর্তী দু’টি ব্রোঞ্জে নরনারীর শরীরী কামনাকে রূপ দিয়েছেন। কিঙ্কর সাহার দু’টি ব্রোঞ্জেই নতুন আঙ্গিক ও ভাবনার পরিচয় রয়েছে। সুব্রত পাল ব্রোঞ্জে ‘মিউজিশিয়ান’ রচনায় শরীরকে সাঙ্গীতিক ছন্দে রূপান্তরিত করেছেন। সৌরভ মজুমদার ‘টপলপ হিয়ার’ ব্রোঞ্জে গড়েছেন তবলা বাজানোর দৃশ্য। বৃত্তীয় জ্যামিতিক বিন্যাসে তবলা বাদকের শরীরের রূপান্তরণ বিশেষ ভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
সুব্রত বিশ্বাসের তিনটি কাজ সবচেয়ে উজ্জ্বল উপহার। ভাস্কর্যের নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ইতিমধ্যেই তিনি যথেষ্ট অবদান রেখেছেন। কিন্তু ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করেছেন সব সময়। শিশুর নিষ্পাপ দৃষ্টি ও কৌতুকবোধ তাঁর রচনাকে বিশেষ অভিনবত্ব দেয়। ‘বার্ডলাভার’ ব্রোঞ্জটিতে একটি শিশুর অবয়বকে তিনি ক্ষুদ্রায়ত করেছেন। হাতে ধরা পাখিটি নিয়ে শিশুটি এক আনন্দের অভিব্যক্তি হয়ে ওঠে। এর চেয়েও বেশি আকর্ষক তাঁর টেরাকোটার রচনা দুটি। ‘ইনোসেন্স-২’ এ রূপায়িত হয়েছে বিড়ালের সঙ্গে শিশুর খেলা। |
|