|
|
|
|
বাচ্চাদের ডাকছে ব্রতচারীর মাঠ |
রাজশেখর মুখোপাধ্যায় • দুর্গাপুর |
কারও চোখ কার্টুন চ্যানেলে, কারও কম্পিউটার গেমসে।
বিকেল গড়িয়ে যায়।
কিন্তু মাঠ প্রায় ফাঁকাই পড়ে থাকে। ব্রতচারী করবে কে? খুদে খুদে চোখ তখন মনিটরের সামনে ঝুঁকে। অথবা, বইয়ের পাতায়।
শুরুটা কিন্তু এ রকম ছিল না। দুর্গাপুরে ইস্পাতনগরী পত্তনের বহু আগে থেকেই ছোটদের শরীর, মন ও চরিত্রগঠনের জন্য নানা ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। স্বাধীনতার আগে থেকেই। মূলে ছিল প্রধানত জাতীয়তাবোধ, সুস্থ-সবল জাতি গঠনের ইচ্ছে। ইস্পাতনগরী গড়ে ওঠার পরেও সেই চেষ্টায় ভাঁটা পড়েনি।
এক সময়ে মনিমেলা, সব পেয়েছির আসর, কিশোর বাহিনী মিলিয়ে ছিল সংখ্যাটা ছিল প্রায় পঞ্চান্ন। এখন গোপালমাঠ বা ইস্পাতনগরীতে দু’একটি মণিমেলা, কিছু এলাকায় সব পেয়েছির আসর বা কিশোর বাহিনী কোন রকমে টিকে আছে মাত্র। যা আছে, তা-ও কিছু দিন বাদে থাকবে কি না সন্দেহ। মূল কারণ সম্ভবত দু’টি
১) নিত্যনতুন খেলাধুলো এবং বিনোদনের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পারা,
২) পড়াশোনার চাপ। এর উপরে কিছু বাবা-মায়ের সন্তানকে সব বিষয়ে পারদর্শী করে তোলার উচ্চাভিলাষ তো রয়েইছে। |
|
এক সময়ে কচিকাঁচায় ভরে যেত বি জোন এলাকার এই মাঠ। নিজস্ব চিত্র। |
ফলে হতাশ হয়ে পড়েছেন আগের সে সব শরীর-মন চর্চার প্রশিক্ষকেরাও। তাঁদের মতে, আগে স্কুলে চাপ কম ছিল, টিভি-র দাপাদাপিও তেমন ছিল না। কম্পিউটারের তো প্রশ্নই ওঠে না। ছেলেমেয়েরা বিকেলে মাঠে আসত। কিন্তু এখন অভিভাবকদের একাংশের উচ্চাশার দৌলতে অনেক ছেলেমেয়েরই শৈশব যান্ত্রিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা আর মাঠে শরীরচর্চার জন্য আসে না। বিকেলে হয় প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়তে যায় অথবা স্কুল থেকে ফিরে ঘুমিয়ে নেয় বেশি রাত পর্যন্ত পড়তে হবে বলে। কেউ কেউ আবার ‘জিম’ করতে যায়। গোপালমাঠ শিশু ভারতীর সন্দীপ ঘটক বা ইস্পাতনগরীর বলাকা মণিমেলার কান্তিকুমার দাসদের আক্ষেপ, “বহু অভিভাবকই চান, তাঁদের বাচ্চারা সবেতে পারদর্শী হোক। বাচ্চাদের নিয়ে ইঁদুর দৌড়ে নামেন তাঁরাই। যদি বা বাচ্চাকে নিয়ে মাঠে এলেন, এখানে এসেও স্কুলের আলোচনা শুরু করেন।”
কিছু অভিভাবক এই অভিযোগ কার্যত মেনে নেন। ইস্পাতনগরীর কৃষ্ণামঞ্জরি মুখোপাধ্যায়, সুস্মিতা মাজিরা যেমন বলেন, “এখন বাচ্চারা খুব ব্যস্ত। এত পড়ার চাপে ওদের সময়ই নেই।” অনেকেই আবার পড়ার চাপ সত্ত্বেও বাচ্চাদের মাঠে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। বি-জোনের সুলতা মুখোপাধ্যায়, ঝর্না রায়ের কথায়, “স্কুলের পড়া আর পরীক্ষার চাপে বাচ্চারা রুগ্ণ হয়ে পড়ছে। খোলা মাঠের হাওয়াও ওদের প্রয়োজন।”
কিন্তু অন্য সমস্যাও আছে। অনেক অভিভাবকের মতে, বহু ক্ষেত্রেই ব্রতচারী, মণিমেলা বা সব পেয়েছির আসর চালানোর মতো যোগ্য প্রশিক্ষক মেলে না। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যে নিত্যনতুন খেলাধুলো বা নতুন ভাবনার প্রয়োজন ছিল, তারও যথেষ্ট অভাব রয়েছে। ফলে, ছেলেমেয়েদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে না।
ব্রতচারী-মণিমেলার সঙ্গে যুক্ত অনেকেই এই দৈন্যের কথা কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন। বলাকা মণিমেলার কর্তা কানাইলাল গোস্বামীর কথায়, “শিশুদের মানসিক বিকাশের এগুলি অত্যন্ত প্রয়োজন। বাবা-মায়েদেরও সজাগ হতে হবে। তবে আমাদের তরফেও কিছু ঘাটতি রয়েছে।” তাঁদের মতে, এই দৈন্যের জন্য আর্থিক সঙ্কটও অনেকখানি দায়ী। কোনও সরকারি বা বেসরকারি সাহায্য তাঁরা পান না। ফলে ইচ্ছা থাকলেও অনেক কিছু করা যায় না। সরকার সক্রিয় হলে এত খারাপ অবস্থা হত না। পরিকাঠামোর উন্নতি হলে বাচ্চাদেরও বেশি আগ্রহী করে তোলা যেত।
তবে সবারই যে আগ্রহের অভাব রয়েছে, তা নয়। সপ্তম শ্রেণির পড়ুয়া অঙ্কন রায়, পঞ্চম শ্রেণির সুশান্ত ঘোষ বা চতুর্থ শ্রেণির অনিকেত ঘোষেরা যেমন চায় রোজ সব পেয়েছির আসর বা মণিমেলায় যেতে। তাদের কথায়, “বাড়িতে একঘেয়ে লাগে। সারা দিন ভাবি, বিকেলে কখন সকলের সঙ্গে দেখা হবে।”
কিন্তু বাকিরা?
কে তাদের বলবে, ‘জানলার বাইরে আকাশটাকে দেখ, টিভি দেখো না...!’ |
|
|
|
|
|