|
|
|
|
কাঁটাপুকুর |
অ্যানাটমির বইও মুখস্থ ডোমেদের |
পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায় • কলকাতা |
তাঁরা ইংরেজি লেখেন, অ্যানাটমির জটিল তত্ত্ব এবং বৈজ্ঞানিক নামটাম বলতে পারেন, ঝোড়ো গতিতে কম্পিউটারে তথ্য এন্ট্রি করেন, টাইপ করেন, পুলিশের পাঠানো কাগজপত্র থেকে ভুল বের করতে পারেন। আবার ময়না-তদন্তের সময় চিকিৎসকদের সাহায্যও করেন।
আর এত সব করার পরেও তাঁরা লাশ কাটেন, মড়া ঘাঁটেন!
কাঁটাপুকুর পুলিশ মর্গের তিন ডোম চমকে দিয়েছেন স্বাস্থ্য দফতর ও পুলিশের অফিসারদের। বার বার স্বাস্থ্য দফতর ও পুলিশের কাছে কর্মী চেয়ে নিরাশ হয়ে ডোমেদের দিয়েই দফতরের কাজ করানোর নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কাঁটাপুকুর মর্গ কর্তৃপক্ষ। মন দিয়ে ইংরেজি আর কম্পিউটার শিখে সত্যি-সত্যি সেই কাজ করে দেখিয়ে দিয়েছেন সেখানকার ডোমেরা! |
|
মর্গের চিকিৎসক উমাপ্রসন্ন ঘোষালের সঙ্গে তিন ডোম।
বাঁ দিক থেকে উপেন্দ্র মল্লিক, শীতল মল্লিক, যোগেন্দ্রপ্রসাদ মল্লিক। নিজস্ব চিত্র |
মোট ৫৪টি থানা এলাকা থেকে মৃতদেহ ময়না-তদন্তের জন্য এই মর্গে আসে। সংখ্যাটা দিনে গড়ে ১০টি। সেই সঙ্গে ধর্ষিতাদের শারীরিক পরীক্ষা, আহতদের পরীক্ষা, বয়স নির্ণয় এই সব কাজও করতে হয়। এত কাজের চাপ। কিন্তু কর্মী নামমাত্র। স্থায়ী চিকিৎসক মাত্র এক জন। কোনও করণিক, কম্পিউটার অপারেটর, রেকর্ড কিপার, হিস্টোপ্যাথোলজি টেকনিশিয়ান, ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট, এক্স-রে টেকনিশিয়ান নেই। শুধু ডোম আছেন ৫ জন।
দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পরেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন মর্গ কর্তৃপক্ষ। তাঁরা নিজেরা অবশ্য একে ‘চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। কী চ্যালেঞ্জ? করণিক, কম্পিউটার অপারেটরের দরকার নেই। মর্গের ডোমেরাই তাঁদের কাজের দায়িত্ব নেবেন।
হেসেছিলেন, ব্যঙ্গ করেছিলেন অনেকেই। ডোম বললেই তো অপরিচ্ছন্ন পোশাক, অল্প-শিক্ষিত, অপরিশীলিত, নেশাগ্রস্ত কিছু চেহারা মস্তিষ্কে ভেসে ওঠে। তাঁরা আবার করণিকের কাজ চালাবেন কী করে! কিন্তু যোগেন্দ্রপ্রসাদ মল্লিক, উপেন্দ্র মল্লিক ও শীতল মল্লিক সব ধারণা উল্টে পাল্টে দিয়েছেন। কেউ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। কেউ মাধ্যমিক পাশ। ইংরেজি তেমন ভাবে কেউ শেখেননি। মৃতদেহ ঘাঁটতে-ঘাঁটতে চর্চার অভাবে এ-বি-সি-ডি-টাও ভুলে গিয়েছিলেন।
রোজ সকাল সাড়ে আটটা থেকে ওই ডোমেদের ইংরেজি পড়া শুরু হয়েছিল কাঁটাপুকুর মর্গের দায়িত্বে থাকা সহকারী মুখ্য মেডিক্যাল অফিসার (মেডিকো লিগ্যাল) উমাপ্রসন্ন ঘোষালের কাছে। প্রশিক্ষণ হয়েছিল কম্পিউটারের। কয়েক বছরের চেষ্টাতে মর্গের সেই ডোমেরাই এখন করণিক, কম্পিউটার অপারেটর আর রেকর্ড কিপারের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, অ্যানাটমির মোটা মোটা ইংরেজি বই পড়ে ময়না-তদন্তেও সাহায্য করছেন একমাত্র চিকিৎসককে। ‘ছাত্র’দের কথা বলতে গিয়ে চোখ চকচক করে ওঠে উমাপ্রসন্নবাবুর। বলেন, “আমার একার পক্ষে তো দিনে ১০-১২টা দেহের ময়না-তদন্ত করে দফতরের কাজ করা অসম্ভব ছিল। কিন্তু কারও জন্য কোনও কাজ আটকায় না। অনেক ঘুরেও যখন লোক মিলল না, তখন মর্গের ডোমদের দিয়েই কাজগুলি করাতে পারব বলে মনে হয়েছিল।” তাঁর কথায়, “অনেকে বিদ্রূপ করেছিলেন। আমার অবশ্য যোগেন্দ্রদের নিষ্ঠার উপর বিশ্বাস ছিল। যাঁরা লাশ কাটা এবং সেলাইয়ের মতো শক্ত কাজ করতে পারেন, তাঁরা ইংরেজিও শিখতে পারবেন বলে বিশ্বাস ছিল। ওঁরা সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছেন।”
মর্গ কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই রোজ ধোপদুরস্ত পোশাক পরে কাজে আসেন ডোমেরা। নেশা করাও ছেড়েছেন। ডোম যোগেন্দ্রপ্রসাদ মল্লিক বলেন, “আমাদের তো লোকে ঘেন্না করে। ছোঁয় না। আমরা মড়া কাটি, তাই নীচ মনে করে। যখন সন্মানের সঙ্গে কিছু করার সুযোগ পেলাম, তখন তা ছাড়তে চাইনি। দিনরাত মেহনত করেছি ইংরেজি আর কম্পিউটার শিখতে। সারা দিন লাশের ঘরে কাজের ফাঁকে নতুন শেখা ইংরেজি মনে মনে আওড়াতাম। এখন পুলিশদের ইংরেজির ভুলও ধরতে পারি।”
শীতলবাবুর কথায়, “প্রথমে ভয় লেগেছিল। লজ্জাও করছিল। আমাদের পড়াশোনা করতে দেখে ছেলেমেয়েরাও বাড়িতে নিজেদের ইংরেজি বই থেকে পড়াতে লাগল। সকালে দু’ ঘণ্টা ডাক্তারবাবুর কাছে ইংরেজি ও কম্পিউটার, রাতে বাড়ি গিয়ে এক ঘণ্টা ছেলেমেয়েদের কাছে পড়া। এখন ময়না-তদন্তের নানা বিষয়ে ডাক্তারবাবুকেও পরামর্শ দিতে পারি।”
ইচ্ছে থাকলে সব সম্ভব আবার প্রমাণ করলেন যোগেন্দ্র ডোমেরা। |
|
|
|
|
|