রোগের থাবায় তরুণ প্রজন্ম
অসুরক্ষিত যৌনতা বাড়াচ্ছে ক্যানসারের প্রকোপও
মেয়েটির বয়স ১৯ বছর। জিভে ক্যানসার। ধূমপান-মদ্যপানের অভ্যাস নেই। চিকিৎসকেরা রোগের কারণ নিয়ে খানিকটা আতান্তরে। বাড়ির লোকেরা জানালেন, তাঁদের মেয়ে কোনও রকম নেশা করে না। কলেজ থেকে সোজা বাড়ি ফেরে। বেশির ভাগ সময়ে বাড়িতেই থাকে। চিকিৎসা শুরু হল। পাশাপাশি চলল তার সঙ্গে কথাবার্তাও। এক দিন মেয়েটি চিকিৎসকের কাছে স্বীকার করল, বাবা-মা অফিস যাওয়ার পরে তার একাধিক পুরুষ বন্ধু বাড়িতে আসে। তাদের কারও কারও সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্কও রয়েছে। রয়েছে ‘ওরাল সেক্স’-এর অভ্যাসও। চিকিৎসক বুঝলেন, এত অল্প বয়সে মেয়েটির এমন মারণ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাব্য কারণ কী হতে পারে।
এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কলকাতার এক প্রথিতযশা চিকিৎসকের এই অভিজ্ঞতা এখন শুধু এ রাজ্য নয়, জাতীয় স্তরেই ক্যানসারের কারণ সম্পর্কে নতুন করে উৎকণ্ঠা বাড়াচ্ছে। এ রাজ্যের চিত্তরঞ্জন ক্যানসার ইনস্টিটিউট থেকে শুরু করে মুম্বইয়ের টাটা মেমোরিয়াল পর্যন্ত সর্বত্রই চিকিৎসকেরা এ নিয়ে উদ্বিগ্ন। টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালের অধিকর্তা অনিল ডিক্রুজের বক্তব্য, শুধু মুখ নয়, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ওরো-ফ্যারিঞ্জিয়াল ক্যানসারের ঘটনা দ্রুত বাড়ছে। তিনি বলেন, “এ দেশে এখনও মুখের ক্যানসারের পিছনে তামাকই সবচেয়ে বড় কারণ। কিন্তু এটা অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই যে, হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস থেকে জিভের এবং মুখের ভিতরে নানা অংশের ক্যানসার হচ্ছে।” যৌন অভ্যাসের সঙ্গে ক্যানসারের মতো মারণ রোগের যোগসূত্রের দিকটি নিয়ে এ দেশে যেহেতু কোনও চর্চাই হয় না, তাই তার ফল আরও মারাত্মক হতে পারে বলে চিকিৎসকদের আশঙ্কা।
কোথায় বিপদ
একাধিক যৌনসঙ্গী ঋতু পিছনোর ওষুধ
কন্ডোম ব্যবহার না করা ঋতুকালীন অপরিচ্ছন্নতা
ওরাল সেক্স বেশি ধূমপান-মদ্যপান
‘পৌরুষ’বর্ধক ওষুধ নিরাময় না হওয়া ক্ষত
২০২০ সাল নাগাদ ভারতে ক্যানসার মহামারীর আকার নেবে বলে বারবার হুঁশিয়ারি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এই রোগের সম্ভাব্য বহু কারণ সম্পর্কেই সচেতনতা বাড়ানোর কাজ এখনও শুরু হয়নি। চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ মনে করছেন, ধূমপানের কারণে যত শতাংশ মানুষের মুখে ক্যানসার হয়, ইদানীং তার প্রায় সমসংখ্যক মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন ‘ওরাল সেক্স’-এর কারণে। এই অভ্যাস গ্রাস করছে বিশেষত তরুণ প্রজন্মকে। একটি মার্কিন সমীক্ষা জানাচ্ছে, যাঁদের জীবদ্দশায় এক থেকে পাঁচ জনের সঙ্গে ‘ওরাল সেক্স’-এর অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাঁদের মুখের ক্যানসার হওয়ার ভয় অন্যদের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। এ রাজ্যে চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউট (সিএনসিআই)-এর অধিকর্তা জয়দীপ বিশ্বাসও একই কথা জানিয়েছেন। তাঁর মতে, শুধু ‘ওরাল সেক্স’ নয়, সামগ্রিক ভাবে সুরক্ষিত যৌনতা সম্পর্কে সচেতনতা না বাড়লে ক্যানসারের প্রকোপও বাড়তে থাকবে। গত এক দশকে অল্পবয়সীদের মধ্যে ক্যানসারের হার অনেক বেড়েছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বিদেশে কন্ডোম ব্যবহারের চল অনেক বেশি। এ দেশে শুধু ‘ওরাল সেক্স’ নয়, সুরক্ষিত যৌনতা নিয়েই কোনও ধারণা নেই। অনেক সময়েই আমরা দেখছি, অল্প বয়সী মেয়েরা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ছে। অল্প বয়সে গর্ভপাতের সময়ে কোনও চোট পেলে কয়েক বছর পরে তা থেকে ক্যানসার হতে পারে।”
ক্যানসার শল্য চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ধূমপান বা মদ্যপানের অভ্যাস নেই, অথচ মুখের ক্যানসারে আক্রান্ত কমবয়সীদের ভিড় বাড়ছে তাঁদের চেম্বারে। এঁদের মধ্যে বড় অংশেরই ‘ওরাল সেক্স’-এর অভ্যাস রয়েছে। যথাযথ প্রচার না থাকায় চিকিৎসার ক্ষেত্রেও নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা থেকে যাচ্ছে। রোগী ভাবতেও পারছেন না, ব্যক্তিগত জীবনের নানা অভ্যাস কী ভাবে এই মারণ রোগকে ডেকে আনছে। তিনি বলেন, “একাধিক যৌনসঙ্গী থাকলে এডসের ভয় নিয়ে বিস্তর প্রচার হয়। কিন্তু এই একই কারণে ক্যানসারও যে বাড়তে পারে, সেই প্রচারটা হয় না বললেই চলে। মূল কথা হল, দেহরসের মাধ্যমে এই ভাইরাস এক জনের থেকে অন্য জনের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে। একাধিক যৌনসঙ্গী থাকলে তাই অঙ্কের নিয়মেই ভয়টা বেড়ে যাচ্ছে।”
মেয়েদের মধ্যে এ দেশে যে ক্যানসারের হার এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি, তা হল জরায়ুমুখ ক্যানসার। এর পিছনে অপরিচ্ছন্নতা একটা বড় কারণ। বিশেষত ঋতুকালীন সময়ে অপরিচ্ছন্ন থাকা বা নোংরা পুকুরে নিয়মিত স্নান করার ফল মারাত্মক হতে পারে। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের প্রধান চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “সাধারণ ভাবে মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত পরিবারে জরায়ুমুখ ক্যানসারের ঘটনা বেশি ঘটার কথা নয়। কিন্তু ইদানীং তেমন পরিবার থেকেই অল্পবয়সী মেয়েদের এই রোগে আক্রান্ত হতে দেখছি আমরা।” এর কারণ কী? তিনি বলেন, “জরায়ুমুখ ক্যানসারের জন্য দায়ী হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস। এর বাহক পুরুষ। কিন্তু এর জেরে রোগটা হয় মহিলাদের। একাধিক যৌনসঙ্গী থাকলে তাই জরায়ুমুখ ক্যানসারের ভয় বেড়ে যায়।”
মনোবিদদের মতে, ‘ওরাল সেক্স’ যুগ যুগ ধরে চালু রয়েছে। কিন্তু এখন কমবয়সীদের মধ্যে প্রবণতাটা বেড়েছে। মনোবিদ জ্যোতির্ময় সমাজদার বলেন, “তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মানসিক বাধা ক্রমশ কেটে যাচ্ছে। তাই অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় তারা অনেক কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখতে চাইছে। আমাদের চেম্বারে বহু অল্পবয়সী ছেলেমেয়েকে পাই যারা জানায় যে, যৌনতা তাদের কাছে একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে। এ ভাবেই হয়তো নতুনত্বের খোঁজ করতে গিয়ে তারা নিজেদের বিপদ ডেকে আনছে। আর এখন যেহেতু একাধিক যৌনসঙ্গী থাকছে অনেকেরই, তাই নতুনত্বের খোঁজটাও প্রবল হয়ে উঠছে।” চিকিৎসকেরা এও জানাচ্ছেন, বাছবিচার না করে হরমোনের প্রয়োগ অল্পবয়সী মেয়েদের ক্যানসারের ভয় বাড়িয়ে তুলছে। ছোটখাটো প্রয়োজনে মাসিক ঋতুস্রাব পিছিয়ে দেওয়ার জন্য অনেকে ওষুধ খান। এর ফল মারাত্মক হতে পারে। আবার বহু পুরুষ তাঁদের ‘পৌরুষ’ ধরে রাখতে নানা রকম ওষুধ খাচ্ছেন। তাঁদের বেপরোয়া যৌনজীবনও প্রস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।”
চিকিৎসকেরা কি এ বিষয়ে রোগীদের সতর্ক করতে পারেন না? গৌতমবাবুর জবাব, “হয়তো পারেন। কিন্তু এখানে যৌনতা নিয়ে খোলামেলা আলোচনার পরিসর নেই। অনেক সময়ই চিকিৎসককে ভুল বোঝার অবকাশ থেকে যায়।” এসএসকেএম হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের প্রধান চিকিৎসক অনুপ মজুমদারও বলেছেন “পাশ্চাত্যে এ নিয়ে রাখঢাক নেই। কিন্তু এখানে চিকিৎসক রোগীকে ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে প্রশ্ন করতে সঙ্কোচ বোধ করেন। সরকারি হাসপাতালের ভিড়ে ঠাসা আউটডোরে তো সেটা অসম্ভব। যদি কোনও প্রশ্নপত্রের ব্যবস্থা রাখা যেত, তা হলে হয়তো অনেকটাই সুবিধা হত।”
First Page Swasth Next Story



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.