|
|
|
|
আর্তি ও তাপ্পির মাঝামাঝি স্টেশনে দাঁড়িয়ে ভারত |
গৌতম ভট্টাচার্য • নটিংহ্যাম |
সুরেশ রায়না?
রাহুল দ্রাবিড়?
নাকি যুবরাজ সিংহ?
কে? পাকেচক্রে যদি শুক্রবার ট্রেন্টব্রিজে ভারতকে প্রথম ব্যাট করতে হয়, মাত্র চার টেস্টের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অভিনব মুকুন্দকে নিয়ে এঁদের কে নামবেন নতুন বলের গোলা সামলাতে?
কনুইয়ের যন্ত্রণা গৌতম গম্ভীরকে এখনও চরম অনিশ্চিত রাখার জিজ্ঞাসাটা এমন বিশাল হাঁ নিয়ে ভারতকে গিলতে আসছে। ইংল্যান্ডেরও ক্রিস ট্রেমলেট নেই। কিন্তু ঠিক এই জায়গাতে তাদের বিকল্প রয়েছে টিম ব্রেসনান। ভারতের তো কোনও স্পেশ্যালিস্ট ওপেনারই আর নেই। তাপ্পি দিয়ে ব্যাটিং অর্ডার ম্যানেজ করা ছাড়া উপায় কী! রাতে ভারতীয় শিবিরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, গম্ভীরের জন্য শেষ চেষ্টা এখনও চলছে। ধোনি বলেছেন, “তুমি নিজে আমাদের কাল সকালে জানিও, কী ঠিক করলে। পারবে কি না।” তবে পারবেন না ধরে নিয়েই শিবিরে বিকল্প তোড়জোড় চলছে।
জিওফ্রে বয়কট মনে করেন, ওপেনার হিসেবে সবচেয়ে টেকনিক্যাল যোগ্যতাসম্পন্ন হলেন দ্রাবিড়। “এমনিতেও তো যখন নামে, বোর্ডে ডাবল ডিজিট দেখায় না। তা হলে আর ওপেন করতে আপত্তি কী?” লর্ডসের দ্বিতীয় ইনিংসে দ্রাবিড় ওপেন করেওছিলেন। কিন্তু নিজের ওপর ছেড়ে দেওয়া হলে তিনি গভীর অনিচ্ছুক। দ্রাবিড় মনে করেন, তিন নম্বর খেলার মনন আর ওপেন করার মানসিকতা দু’টো সম্পূর্ণ আলাদা।
এই ফর্মের দ্রাবিড়কে আপত্তি সত্ত্বেও এগিয়ে দেবে? নাকি মিডল অর্ডার থেকে রায়নার মতো কাউকে এনে ফাটকা খেলবে? ভারতীয় শিবির আপাতত এই গম্ভীর প্রশ্নের আবর্তে। ট্রেমলেটের না থাকা উপভোগ করার মতো পরিস্থিতি এটা নয়। আগে তো নিজের প্রাণ বাঁচুক। তার পর ইংল্যান্ডের যাত্রাভঙ্গের কথা ভাবা যাবে।
সংসারে রকমারি সমস্যা। ওপেনার ঠিক করতে হবে। জাহির না থাকা বোলিং আক্রমণকে তাপ্পি দিতে হবে। সুইং বোলিং ঠিক মতো মোকাবিলা করতে হবে। |
|
ট্রেন্টব্রিজে ভারত অধিনায়ক। -গেটি ইমেজেস |
ট্রেন্টব্রিজ মিডিয়া সেন্টারে ইন্টারনেটের যা ঢিকি ঢিকি স্পিড, সেই গতিতে অ্যান্ডারসন, ব্রডদের বল ভাঙলে কোনও সমস্যা ছিল না। কিন্তু তারা সুইং করাচ্ছে ঘণ্টায় ৮০/৯০ মাইল গতিতে এবং দু’দিকে। আক্রমের মতো হাতটা এমন বন্ধ করে আসছেন অ্যান্ডারসন যে, গ্রিপ লক্ষ্য করেও ব্যাটসম্যানের বোঝার উপায় নেই কোনটা ভেতরে যাবে? কোনটা বাইরে বার হবে?
অ্যামি ওয়াইনহাউসকে নিয়ে গত ছ’সাত দিন লন্ডনের কাগজে শোকার্ত লেখার মিছিল বার হচ্ছে। আর তা সহজবোধ্য। মাত্র সাতাশ বছর বয়সে পরমাসুন্দরী বিশ্বখ্যাত এই রকস্টার আচমকা মারা গিয়েছেন উত্তর লন্ডনের বাড়িতে। তাঁর মৃত্যুতে আরও বৃদ্ধি পেল টোয়েন্টি সেভেন ক্লাবের মেম্বারশিপ। রক সঙ্গীতের জগতে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের মতো অভিশপ্ত হয়ে পড়েছে এই বয়সটা। জিমি হেনরিক্স, জ্যানিস জপলিন, ব্রায়ান জোন্স, জিম মরিসন। পর পর সাতাশ বছরে মৃত্যু। খ্যাতি, মাদক, ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভাঙাভাঙি এবং উশৃঙ্খল জীবনের ঢেউ সামলাতে না পেরে।
টোয়েন্টি সেভেন ক্লাব তাই হয়ে উঠেছে অমঙ্গলজনক, গভীর অপছন্দের ক্রমবর্ধমান সম্প্রদায়!
যেমন ভারতীয় ক্রিকেটে বৃদ্ধিই পেয়ে চলেছে অভিশপ্ত ইংলিশ সুইং ক্লাব।
পেস খেলতে সমস্যা হচ্ছে না। অস্ট্রেলিয়ান বাউন্সের সঙ্গেও ধাতস্থ হওয়া যাচ্ছে। কিন্তু অফ স্টাম্প ও তার বাইরের লাইনে নিবিড় সুইং আক্রমণজনিত ঐতিহাসিক দুর্বলতা থেকেই গেল ভারতীয় ক্রিকেটে। দু’দেশের শেষ ট্রেন্টব্রিজ টেস্টে জেলি বিনস হেডলাইন হয়েছিল। ভারত দাবি করেছিল জাহির ব্যাট করার সময় ইংল্যান্ড ফিল্ডাররা ইচ্ছাকৃত জেলি বিনস ছুঁড়ে মেরেছে উইকেটে। ক্রিজের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে পিচ্ছিল জিনিসগুলো। |
রেকর্ড কিন্তু ধোনির দিকে |
দেশে তো নয়ই, বিদেশেও এখনও কোনও টেস্ট সিরিজ হারেননি। |
শতকরা হিসাবে অধিনায়কত্বের রেকর্ড লয়েড, বেনো, ইয়ান চ্যাপেল,
ইমরান, মার্ক টেলর, মাইক আথারটনের চেয়েও ভাল। |
শতকরা সাফল্যের হিসাবে (ন্যূনতম ২৫ টেস্ট) ভারতের সর্বকালের সেরা
অধিনায়ক (৫৩.৫৭%)। দ্বিতীয় সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় (৪২.৮৫%)। |
টেস্ট জয়ের সংখ্যায় ভারতের দু’নম্বর অধিনায়ক। ২৮ টেস্টে ১৫ জয়।
এক নম্বরে সৌরভ (৪৯ টেস্টে ২১ জয়)। |
|
এ বার জাহির নেই। জেলি বিনসের অযোধ্যাও থাকা উচিত নয়। মেজাজটাই অন্য মাত্রায় রয়েছে। ইংল্যান্ড এত এগিয়ে যে লজেন্স ছুঁড়ে মনোযোগ নষ্ট করার বোকামি করবে বলে মনে হয় না। জেলি বিনসের কাজ তো সুইং করে দিচ্ছে! প্রতিরোধের প্ল্যানিং ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা গত ক’দিন টিমের আই টি বিশেষজ্ঞ ধনঞ্জয়ের সঙ্গে আদানপ্রদানে ব্যস্ত থাকলেন। পুরনো ফুটেজগুলো দেখলেন। যখন ২০০২ এবং ২০০৭ দু’টো সফরে সুইং কী ভাবে কোথায় ঠিকঠাক সামলেছিলেন। কোচের নির্দেশমতো যার যার আইপডে ফুটেজগুলো পড়িয়ে পাঠিয়ে দিলেন আই টি বিশেষজ্ঞ। কাউকে সিডি করে দিলেন। কাউকে লিঙ্ক পাঠিয়ে দিলেন। ব্যাটসম্যানদের জন্য ডানকান ফ্লেচারের বার্তা হল, সুইং দিব্যি হজম করা যায়। ছবি দেখো, অতীতে তোমরা যে নিজেরাই এ দেশে সুইং বোলিং হজম করেছ।
ভি ভি এস লক্ষ্মণ ঐতিহাসিক ভাবে ভারতের সিরিজ প্রত্যাবর্তনকারী টেস্টে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছেন। সিরিজে সেকেন্ড টেস্টে তাঁর গড় সচিনের চেয়েও ভাল। কাল থেকে দেখছি লক্ষ্মণ সবাইকে চাগাচ্ছেন। বাড়তি মেহনত করছেন। লক্ষ্মণের রানিং বিটুইন দ্য উইকেটস দেখলে মনে হয় না তার সঙ্গে জিম বস্তুটা যায় বলে। অথচ নিজে খুব ফিট। ফিটনেসে প্রচুর যত্ন নেন। হোটেলের জিম পছন্দ হচ্ছে না বলে প্র্যাক্টিসের পর আলাদা করে সন্ধেবেলা ট্রেন্টব্রিজ মাঠের জিমে আসছেন। তাঁকে দেখে দলের উদ্বুদ্ধ বোধ করাটা আশ্চর্যজনক হবে না।
লর্ডস বিপর্যয়েও প্রবাসী ভারতীয় সমর্থকদের মানসিকতায় কোনও ভূকম্পনের ইঙ্গিত নেই। ওভাল-বার্মিংহাম সর্বত্র টিকিট বিক্রি হয়ে গিয়েছে। নটিংহ্যাম ব্যতিক্রম কেন হবে? টিম হোটেলের বাইরে প্রতিদিন এই ঠান্ডা হাওয়ায় খোলা আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে-বসে থাকছেন শ’খানেক সমর্থক। কখন টিমের কেউ খেতে-টেতে বার হবেন। তাঁকে একটু কাছ থেকে দেখা। একটা ছবি। কিন্তু এ দেশের পরিপ্রেক্ষিতে হোটেলের বাইরে সেই জমায়েতকে কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে।
তবু উৎসাহের অবধি নেই। বৃহস্পতিবারই যেমন দুই বঙ্গললনা তাঁদের সন্তানকে নিয়ে আবির্ভূত হলেন এখানে। বাইরে থেকে হোটেলে নোট পাঠালেন। “সচিন আঙ্কল, প্লিজ বাইরে এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করুন। প্লিজ, প্লিজ!’’ ম্যাচের আগের বিকেলে এমন কোনও অসমসাহসীর খোঁজ পাওয়া গেল না যে সেই চিরকুটটা সচিনের ঘর অবধি দিয়ে আসতে পারে। এঁরা অবশ্য প্র্যাক্টিস মাঠে ঢুকতে পারছেন না বলে বিষ্যুদবারের একটা দারুণ ছবি মিস করলেন। সটান পিচের ওপর হাঁটু গেড়ে অপলকে চেয়ে আছেন হরভজন। ব্যকুল প্রার্থনা ফুটে বার হচ্ছে সেই আর্তিতে। ২১৮ রান দিয়ে এক উইকেট আর অন্তত এখানে করিও না। এমনই পূণ্যার্থীর মতো পড়ে থাকলেন হরভজন যে প্লে ব্যাকে মান্না দে-র বিখ্যাত গানটা অনায়াসে চালিয়ে দেওয়া যেত, ‘আমায় একটু জায়গা দাও/ মায়ের মন্দিরে বসি।’ তাপ্পি, আবেগ, সুইং ক্লাব আর আর্তি। ট্রেন্টব্রিজ টেস্ট, প্রথম বল পড়ার আগে আপাতত এই চতুষ্টয়ের সামনে। |
|
|
|
|
|