|
|
|
|
দুর্যোগেও নিজের ধনুক পাল্টাচ্ছেন না ধোনি |
গৌতম ভট্টাচার্য • নটিংহ্যাম |
ক্রিকেট খেলাটার নিয়মকানুন এতটুকু জটিল নয়। দু’টো দল থাকে। এক-একটা দলে এগারো জন করে খেলোয়াড়। একটা দল জেতে। যে দলটার অধিনায়কের নাম মহেন্দ্র সিংহ ধোনি।
এক মাসও হয়নি জনৈক ক্রিকেট অনুরাগী ‘পোস্ট’ করেছিলেন ফেসবুকে। আর সেটা চালাচালি হয়ে ছড়িয়ে পড়ে প্রচুর কম্পিউটারে।
বৃহস্পতিবার প্রাচীন নটিংহ্যামশায়ার প্যাভিলিয়নে বসে যখন সাম্রাজ্যচ্যুত নৃপতির মতো দল সম্পর্কে পরের পর অনাস্থাসূচক জিজ্ঞাসা সামলাচ্ছিলেন ধোনি, তখন ফেসবুক ‘পোস্ট’-টা মনে পড়ছিল। ক্রিকেটে দু’টো দল থাকে। সেই দলটা জেতে যার অধিনায়কের নাম মহেন্দ্র সিংহ ধোনি!
নটিংহ্যামশায়ার কাউন্টি অনেক কারণেই ঐতিহাসিক। লর্ড বায়রনের জন্মস্থান। লেডি চ্যাটারলিজ লাভার-খ্যাত ডি এইচ লরেন্স এখানকার। রবিনহুড এবং তাঁর ধনুক এখানকারই উদ্ভূত লোকগাথা। ট্রেন্টব্রিজ মাঠ ঘিরেও তেমনই ইতিহাসের কত রং। বিশ্বের একমাত্র মাঠ যেখানে গ্রেস-ট্রাম্পার-সোবার্স তিন জনের ব্যাট কাছাকাছি সযত্নে সাজিয়ে রাখা। |
|
অনুশীলনে অধিনায়ক। এ পি |
ভারতীয় ক্রিকেট সাংবাদিকের কাছে প্রেস কনফারেন্স রুমটাও ঐতিহাসিক গণ্য হওয়া উচিত। দু’বছর আগে সাংবাদিক সম্মেলনে এই ঘরটাতেই তো ক্যাপ্টেন-সহ একটা গোটা দলের ওয়াকআউট ঘটেছিল। আপত্তিকর সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে পনেরো জন ক্রিকেটার এবং দশ জন সাপোর্ট স্টাফ এক সঙ্গে মঞ্চের ওপর উঠেছিলেন। সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে লিখিত প্রতিবাদপত্র পড়ে বেরিয়ে যান। যা ক্রিকেটবিশ্বে আর কখনও হয়নি।এ সবের মাথা ছিলেন এই ধোনি। মাত্র দু’বছর দেড় মাস হয়েছে ঘটনাটার। অথচ ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে দেখে মনে হল তারা হয় ভুলে গিয়েছে, বা ওই মেজাজের, রথের চাকা আটকে যাওয়া অবস্থায় অধিনায়ককে পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে শ্লেষ দিতে চায় না। বিশেষ করে ধোনি যখন লর্ডসে ভাগ্য বিপর্যয়ের কথা উল্লেখ করছেন। যখন বলছেন, “জাহির তো নেই-ই। গম্ভীরও খেলতে পারবে কি না জানি না।” যখন বলছেন, “এক নম্বর র্যাঙ্কিং তো আমরা কিনে নিইনি। এটা কারও পাকা জমিদারিও নয়। যারা ভাল খেলবে তারা থাকবে। যারা খেলবে না তারা বেরিয়ে যাবে।”
অন্তত সংবাদমাধ্যমের কাছে
দুই ধোনিতে অনেক তফাত। ধোনি ওয়ান, অনেক বেশি স্পর্শকাতর এবং উদ্ধত। ধোনি টু, স্পর্শকাতর থাকলেও সহ্য করার মাত্রাটা বেড়েছে। আর পরিণতিও বেশি।
ভারতীয় ক্রিকেট দলের কারও কারও সঙ্গে কথা বলে আবার মনে হল, ধোনি যেমন ছিলেন তেমনই আছেন। ‘ধোনি টু’ বলে কিছু নেই। এ রকম কোণঠাসা অবস্থার মুখোমুখি হয়েও তিনি স্বভাবসিদ্ধ অধিনায়কত্বের ভঙ্গি বদলাননি। এখনও দলকে দৌড়ে গিয়ে চাগাচ্ছেন না। বাড়তি চাপ দিচ্ছেন না এই বলে যে, চলো বন্ধুরা, মর্যাদা রক্ষায় সবাই মিলে ঝাঁপাই।
ধোনির অধিনায়কত্বের বিশেষত্ব হল, তিনি প্রত্যেক ক্রিকেটারকে নিজস্ব ‘স্পেস’ দেওয়ায় বিশ্বাসী। বিয়েতে যেমন লোকে পার্টনারকে ‘স্পেস’ দেওয়ার গুরুত্বের কথা বলে, তেমনই ধোনি মনে করেন ভারতের হয়ে যারা খেলছে তাদের প্রত্যেকের সেটা প্রাপ্য। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে সেই গণ্ডি তিনি অতিক্রম করেন না।
ধোনি বলেই হয়তো এটা সম্ভব যে মহাগুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় টেস্ট শুরুর আগে টিম মিটিং বাতিল করে দেওয়া হল। কোচের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হল সফরে মিটিং অনেক হয়েছে। তার চেয়ে বরং এ বার যে যার মতো ফুরফুরে থাকো। এটাই ধোনি! |
|
ট্রেন্ট ব্রিজে অনুশীলনের ফাঁকে সচিন। বৃহস্পতিবার। -গেটি ইমেজেস |
একটা সময় ছিল যখন হবু অধিনায়ক, এমনকী চলতি অধিনায়ককেও লোকে মাইক ব্রিয়ারলির ‘আর্ট অব ক্যাপ্টেন্সি’ উপহার দিত। সৌরভ বেশ কয়েক বার পেয়েছেন। কিন্তু ধোনি ওই সব বই পড়া বিদ্যেয় বিশ্বাস করেন না। দলের মিটিংয়ে অর্ধেক সময় নিজে মুখও খোলেন না। বরঞ্চ অন্যদের বলতে দেন। সভা দীর্ঘ করা, প্রচুর ছক-টক তৈরি এ সবে বিশ্বাসী নন। তাঁর বিশ্বাস স্বতঃস্ফূর্ত অধিনায়কত্বে। টিমের কেউ কেউ বলছিলেন, “এমনও হতে পারে কাল ট্রেন্ট্রব্রিজ মাঠে পা দিয়ে মাহি বলল, তোমার কাছে অমুকটা চাইছি। এমন অনেক বার হয়েছে মিটিংয়ে কিছু না বলে ও সটান মাঠে বলেছে।”
আর একজন বোলার বলছিলেন, “মাহির সবচেয়ে বড় গুণ হল কখনও মাথা গরম করে না। সৌরভ যেমন চার্জড হয়ে যেত বা বাকি সকলে হয়, ও হয় না। এ বারে এত চাপেও নির্বিকার আছে। মাঠে দু’টো বাজে স্পেল যদি আগামী কাল করেও ফেলি ধরে নিতে পারি প্রকাশ্যে ও বকবে না। তাতে সুবিধে হল থার্ড স্পেলে এলেও ব্যাটসম্যানকে আউট করারই চেষ্টা করব। অন্য অধিনায়কের বেলায় বকুনির ভয়ে রক্ষণাত্মক বল করতাম।”
ধোনি নিজে বলছিলেন তিনি রেগে যান এক মাত্র মাঠে দু’টো ব্যাপার ঘটতে দেখলে। এক, পাশ দিয়ে বল চলে যাচ্ছে দেখেও যদি তাঁর ফিল্ডার থামানোর আপ্রাণ চেষ্টা না করে। দুই, তিনি ফিল্ড বদলাবার সময় আউটফিল্ডের লোক যদি তাঁর দিকে না দেখে যে, তাকে কোথায় যেতে বলা হচ্ছে! এর বাইরে রান আউট করতে না পারা, সহজ ক্যাচ মিস, দলকে হারিয়ে দেওয়া---কোথাও প্রকাশ্য উষ্মা তিনি দেখান না। আইপিএল থেকে টেস্ট কোথাও না।
অধিনায়ক ধোনির সঙ্গে কিপার-ব্যাটসম্যান ধোনিকেও চাপে রেখেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম। নিয়মিত তারা ম্যাট প্রায়রের ওপর লেখা বার করছে ধোনিকে ঠেস দিয়ে। বলছে ইংল্যান্ডের সেরা ব্যাটসম্যান-কিপার হলেন প্রায়র। যাঁর টেস্ট গড় ৪৫-এর বেশি। কিপিং করে এর চেয়ে ভাল টেস্ট গড় বিশ্বে মাত্র দু’জনের রয়েছে। অ্যাডাম গিলক্রিস্ট এবং এখনকার ইংল্যান্ড কোচ অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের। বিশেষজ্ঞরা রোজ লিখছেন, ‘ধোনি এই সব ইন্টারনেট একাদশ ট্যাকাদশে মনোনয়ন পেতে পারেন। কিন্তু ইংল্যান্ডের পিচে যেখানে বল সারাক্ষণ সুইং করছে সেখানে তিনি কিপার হিসেবে কত নড়বড়ে লর্ডসে দেখাই গিয়েছে।’
এ সব বলা-কওয়াকে অগ্রাহ্য করে ধোনি পাল্টা দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি মন্তব্যেই ঢোকেননি। তাঁর মিডিয়া-নীতি হল, দেখাশোনা কথাবার্তা কম, বিতর্কও কম। নইলে ৭৯ বলে ৯১ রানের এমন ইনিংস খেলে বিশ্বকাপ জেতানোর পর আজ পর্যন্ত সেই ইনিংস নিয়ে বিশেষ ইন্টারভিউ দেননি। দেবেন বলেও মনে হয় না। তিনি একেবারে নিজের মতো করে অরিজিন্যাল থাকতে চান। এমসিসি-র মডেল ক্যাপ্টেন বলতে যে অদৃশ্য প্রোটোটাইপ বোঝায় ধোনি হলেন একেবারে উল্টো।
নইলে আজকের দিনে তাঁর মতো হাইপ্রোফাইল কেউ নিজের ভারতীয় নম্বরসহ যে মোবাইল সেটা দেশে ছেড়ে আসতে পারেন! ধোনিরা ওয়েস্ট ইন্ডিজের জন্য দেশ ছেড়েছেন জুনের মাঝামাঝি। ফিরবেন সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে। এই চার মাস বহির্জগতের কাছে তাঁর যে মোবাইল নম্বর রাখা আছে সেটা বন্ধ করা থাকবে। ইংল্যান্ডে তাঁর নতুন কানেকশন। যে নম্বর খুব কম লোকের কাছে আছে। কিন্তু কেন? “ভারতের টেনশন ভারতেই রেখে আসা ভাল বলে,” তাঁর ছোট্ট জবাব।
কখনও মনে হচ্ছে এমন আন অর্থোডক্স মনোভাবসম্পন্ন বলেই অধিনায়ক হিসেবে এত ভারী পরিস্থিতির অনায়াস মোকাবিলা করতে পারছেন। ইংল্যান্ড তাঁর দলের টুঁটি চেপে ধরেছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম এক নম্বর র্যাঙ্কিংয়ের ওপর ভয়ঙ্কর চাপ সৃষ্টি করেছে। লন্ডনস্থিত ভারতীয় দূতাবাসও শোনা যাচ্ছে অধিনায়কের ওপর রুষ্ট। তারা যে দিন গোটা দলকে নৈশভোজে নেমন্তন্ন করেছিল সে দিনই স্ত্রী-র চ্যারিটির জন্য ধোনি লন্ডনের হোটেলে নিলামসভা বসিয়েছিলেন। সে জন্য কোনও ভারতীয় ক্রিকেটার দূতাবাসের পার্টিতে পৌঁছোয়নি। দূতাবাস তো রাগবেই।
মহেন্দ্র সিংহ ধোনি তা-ও নির্বিকার। হাসছেন আর বলছেন, “চরম সঙ্কট ভেবে লাভ নেই। সঙ্কট থেকে কী কী পজিটিভ বের হয়ে এল তার কথা ভাবা ভাল।” এহেন অপরিবর্তিত এম এস ডি মডেল সামনে রেখেই ভারত ট্রেন্টব্রিজের কঠিন যুদ্ধে নামছে। কে বলতে পারে ক্রিস ট্রেমলেট অনিশ্চিত হয়ে পড়ে ভাগ্যের যে অপ্রত্যাশিত সহায়তা পাওয়া গেল, তাতে পুরনো ফেস বুক পোস্ট-টাই আবার হাত ঘুরবে না! দু’টো দল খেলে। সেই দলটাই জেতে যাদের অধিনায়কের নাম...। |
|
|
|
|
|