বেশ কয়েক মাস আগে দিল্লির কৈলাস কলোনিতে অরুণ জেটলির বাড়িতে এসে জমি কেলেঙ্কারির সমস্ত কাগজপত্র দেখিয়েছিলেন ইয়েদুরাপ্পার ছেলে আর জামাই। অরুণের সঙ্গে কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রীর সম্পর্ক ভাল ছিল। কিন্তু এই ডাকসাইটে আইনজীবী সে দিনই কাগজপত্র খুঁটিয়ে দেখে তাঁদের জানিয়ে দিয়েছিলেন, বেশ কিছু গোলমাল আছে। মামলা লড়তে গেলে বিপদ বরং বাড়বে।
লোকায়ুক্তের রিপোর্ট প্রকাশের পরে, যেখানে ইয়েদুরাপ্পাকে সরাসরি দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে, আর কোনও ঝুঁকি নিতে চাননি বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব। রিপোর্ট প্রকাশের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে সরে যেতে বলা হয়। বুধবার রাত প্রায় তিনটে পর্যন্ত দিল্লিতে দলের সভাপতি নিতিন গডকড়ীর বাড়িতে সর্বভারতীয় শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে ইয়েদুরাপ্পার বৈঠক হয়। সেখানেই তিনি বুঝে যান, তাঁকে সরতেই হচ্ছে। দল আর তাঁকে সময় দিতে রাজি নয়। আজ দলের সংসদীয় বোর্ডের বৈঠকে অপসারণের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়ে গেলে ইয়েদুরাপ্পাও জানান, তিনি কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিচ্ছেন।
বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব এই সিদ্ধান্ত নিলেন অনেকটাই সর্বভারতীয় রাজনীতির চাহিদা পূরণে। কর্নাটকের রাজনীতিতে লিঙ্গায়েত ভোটের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার কথা মাথায় রেখেও তাঁরা যে এই সিদ্ধান্ত নিলেন, তার উদ্দেশ্য একটাই। ১ অগস্ট থেকে সংসদের বাদল অধিবেশন শুরু হলে প্রধানমন্ত্রী থেকে চিদম্বরম, কংগ্রেসের সব শীর্ষস্থানীয় মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে যখন গলা তুলবে বিজেপি, তখন যেন কংগ্রেস না বলতে পারে, ‘চোরের মায়ের বড় গলা’। বস্তুত, আসন্ন বাদল অধিবেশনে সংসদে বিজেপির অস্ত্রই হবে দুর্নীতির অভিযোগে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আক্রমণে যাওয়া। সেখানে টুজি কাণ্ডে মনমোহন, চিদম্বরমের ভূমিকা নিয়ে তো প্রশ্ন থাকবেই, সনিয়া গাঁধীও বাদ যাবেন না। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ নীরব থাকার। যা নিয়ে আজ বিজেপি মুখপাত্র রবিশঙ্কর প্রসাদ সাংবাদিক বৈঠকেই প্রশ্ন তোলেন। নিশানায় রয়েছেন শীলা দীক্ষিত, বিলাসরাও দেশমুখ, সুশীলকুমার শিণ্ডেও। এই পরিস্থিতিতে সরে যাওয়া নিয়ে ইয়েদুরাপ্পা যত জটিলতা বাড়াবেন, তত বিড়ম্বনা বাড়বে দলের।
বিজেপির এক শীর্ষ নেতা বললেন, “এটাকেই বলা হয় ‘হবসনস চয়েজ’।” অর্থাৎ এটা ছাড়া (ইয়েদুরাপ্পাকে সরানো ছাড়া) এই পরিস্থিতিতে বিজেপির আর কিছু করার ছিল না। বিজেপি নেতৃত্ব মনে করছেন, দুর্নীতির প্রশ্নে ইয়েদুরাপ্পা নিজে ধোয়া তুলসীপাতা হোন বা না হোন, রেড্ডি ভাই এবং অবৈধ খননের ব্যবসায়ী লবিকে তিনি কিন্তু কিছুটা হলেও শায়েস্তা করতে পেরেছিলেন। বিজেপি শীর্ষ নেতারা আরও জানেন, গত কয়েক বছরে কর্নাটকের প্রায় ১৩-১৫ ভাগ লিঙ্গায়েত ভোটকে অনেকটাই সুসংহত করতে পেরেছিলেন ইয়েদুরাপ্পা। তবু কেন্দ্রের রাজনীতির কারণেই দক্ষিণের প্রথম বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীকে রাজনৈতিক ভাবে ‘বলি’ দিতে বাধ্য হলেন তাঁরা। |
অরুণ জেটলিদের দ্বিধার অবশ্য আরও একটা কারণ ছিল। সেটা হল, বারবার বিজেপি-শাসিত রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী বদল। তাঁদের আশঙ্কা ছিল, লোকে না মনে করে বারবার মুখ্যমন্ত্রী বদলটা আসলে বিজেপি-র দুর্বলতারই পরিচয়। সত্তরের দশকে মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী জনসঙ্ঘের বীরেন্দ্রকুমার সাচলেকা ইস্তফা দিয়েছিলেন দুর্নীতির অভিযোগেই। সেই শুরু। এর পরও কয়েকটি বিজেপিশাসিত রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী বদল হয়েছে। সব ক্ষেত্রে যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তা নয়। উত্তরাখণ্ডে যেমন গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কারণে খান্ডুরিকে মুখ্যমন্ত্রিত্ব খোয়াতে হয়। বাবরি কাণ্ডে চার্জশিটের জন্য মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর পদ হারাতে হয়েছিল উমা ভারতীকে।
শিবরাজ সিংহ চৌহান, নরেন্দ্র মোদী কিংবা রমন সিংহ অবশ্য স্থায়ী সরকারের দৃষ্টান্ত দেখাতে পেরেছেন। ইয়েদুরাপ্পার রাজ্যেও দেবগৌড়া বা কংগ্রেসের মাথা তুলে দাঁড়ানোর অবস্থা নেই। তাই সেখানে যাতে অস্থিরতার বার্তা না যায়, সে জন্য বিজেপি নেতৃত্ব শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি সামলে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু লোকায়ুক্তের রিপোর্টের পর রাজনীতির জল যে ভাবে গড়িয়েছে, তাতে মুখ্যমন্ত্রী বদল ছাড়া উপায় ছিল না।
জাতীয় স্তরে কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে যে মেরুকরণের রাজনীতি শুরু হয়েছে, সেখানে এক সময় ‘পার্টি উইথ ডিফারেন্স’ বলে নিজেদের চিহ্নিত করা বিজেপি দুর্নীতির অভিযোগ থেকে দূরে থাকতে চায় কেন্দ্রে পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়ার জন্যই। শুধু বাদল অধিবেশনই নয়, নিজেদের মধ্যে কোন্দল সত্ত্বেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনকে পুঁজি করে ২০১৪ সালের কেন্দ্রে ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখছেন বিজেপি নেতৃত্ব। তাই কর্নাটকে দুর্নীতির আঁচ আসতেই তাঁরা সমবেত ভাবে সিদ্ধান্ত নিলেন, ইয়েদুরাপ্পাকে সরানো ছাড়া গতি নেই।
ইয়েদুরাপ্পা-কাঁটা যে বিজেপি এত সহজে সামলে ফেলবে, সেটা কংগ্রেসের কাছে অপ্রত্যাশিতই ছিল। কংগ্রেস শিবির জানে, এর পরেই বিজেপি ফের মনমোহন সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে তেড়েফুঁড়ে উঠবে। তাই আক্রমণের অভিমুখ ঘোরাতে এখন থেকেই তারা মধ্যপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ডের মতো বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলির দুর্নীতি খুঁজে বের করে তদন্তের দাবি জানাতে তৈরি হচ্ছে। অবৈধ খনন নিয়ে একটি যৌথ সংসদীয় কমিটি গঠনেরও প্রস্তাব রয়েছে।
কংগ্রেসের মুখপাত্র শাকিল আহমেদ আজ বলেন, “অবৈধ খননের দুর্নীতিতে সুষমা স্বরাজ, অরুণ জেটলিরাও সুফল ভোগ করেছেন। তাই এ নিয়ে যৌথ সংসদীয় কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। আর ইয়েদুরাপ্পাকে সরিয়ে দিয়ে তাঁর পছন্দের যাকেই মুখ্যমন্ত্রী পদে আনা হোক, তিনি দুর্নীতি ধামাচাপা দেওয়ারই চেষ্টা করবেন।” |