|
|
|
|
ফুটবলের ভুভুজেলা শতবর্ষে জুলু চার্চের দখলে |
রূপায়ণ ভট্টাচার্য • ডারবান |
এখনও, বিশ্বকাপের এক বছর পরেও সব শহরে চেনা দৃশ্য। শপিংমলে, ফুটপাথে, স্টেডিয়ামে, বিমানবন্দরে বিক্রি হচ্ছে সেই জিনিস। পাল্টেছে রং। কিন্তু এত দিনে সিংহ, হাতি, গণ্ডার, লেপার্ড, বুনো মহিষের মতোই দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতীক গর্বিত ভুভুজেলা।
বৈচিত্র আনতে নানা সুন্দর ভাবে সাজানো সেই যন্ত্র। কাপড় দিয়ে, পুঁতি বা চামড়া দিয়ে। কোথাও কমেছে দাম। কোথাও তো দেখলাম কমেইনি!
ইন্টারনেটে ভুভুজেলার নামে কত ওয়েবসাইট! ভুভুজেলার ইতিহাস নিয়ে সাইট। ভুভুজেলার নামে রেডিও, গানের ব্যান্ড। দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যটন দফতরেও ঝুলছে ফুটবলের এই যন্ত্র। এমনকী ভুভুজেলা নামে গুগুল বা ইয়াহু-র মতো সার্চ ইঞ্জিন। টটেনহ্যামের সঙ্গে ক্লাবের খেলা দেখতে এসে কাইজার চিফস বা অরল্যান্ডো পাইরেটস সমর্থকদের হাতেও তাঁদের ক্লাবের রঙে ভুভুজেলা। স্টেডিয়াম আবার হয়ে উঠল ঝিঁঝিপোকার ডাকে অন্য রকম শব্দময়। মনে হল মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা এত রঙিন শব্দ ছড়াতে পারেন না গ্যালারিতে?
এত সব কিছুর মধ্যে ভুভুজেলা নিয়ে যে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে, তা বোঝা গেল ডারবানের অদূরে ফিনিক্সে মহাত্মা গাঁধীর ভিটেয় গিয়ে। একশো একর জমির উপরে নানা পরিকল্পনা নিয়ে গাঁধী এখানেই শুরু করেছিলেন বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে আন্দোলন। তাঁর বাড়ি, তাঁর তৈরি প্রিন্টিং প্রেস, ছেলে মণিলালের বাড়ি, কস্তুরাবার নামে প্রাইমারি স্কুলসব একই রকম রাখার চেষ্টা চলছে। সেগুলো দেখানোর ফাঁকেই গাইড বোঙ্গানি বলে উঠলেন, “ভুভুজেলা প্রথম বাজানো শুরু হয় ডারবানের সেম্বে চার্চে। ঈশ্বরকে আবাহনের জন্য। গরুর শিং দিয়ে তৈরি ছিল।”
ভুভুজেলা কার মাথা থেকে প্রথম বেরোল? বিশ্বকাপের সময় এই বিতর্কে ফায়দা তুলে নিয়ে গিয়েছেন কাইজার চিফস ক্লাব সমর্থক সাদ্দাম মাকে ও একটি কোম্পানির ডাচ ডিরেক্টর নিয়েল ভান শালকোয়াক। এক জন ফুটবল মাঠে এনেছিলেন ভুভুজেলা, ক্রমাগত বাজিয়ে। অন্য জন বিশ্বের বাজারে পরিচিতি দিয়েছিলেন, বাজারে ছেড়ে। এক বছর পরে জো’বার্গ ও ডারবানের বিভিন্ন শহরে অনেক লোকের সঙ্গে কথা বলে একটা জিনিস স্পষ্ট। ওই তর্ক থামছে না। তবে ডারবানের চার্চই যে প্রথম ভুভুজেলার মতো কোনও শব্দযন্ত্র বাজিয়েছিল, তাতেই সায় দিচ্ছেন অধিকাংশ দক্ষিণ আফ্রিকান। এবং সেই হিসাব ধরলে তো এ বছরই একশো পেরোল ভুভুজেলা।
সেই বিখ্যাত ভুভুজেলা-চার্চটা কেমন? গাঁধীজির অ্যাসবেটস ছাদের বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়। কৃষ্ণাঙ্গদের ইনান্দা শহরের একটা পাহাড়ের চুড়োয়। এমনিতে চার্চ বলতে যা বোঝায়, একেবারেই নয়। সাদা কয়েকটা পাথরের টুকরো দিয়ে ঘেরা একটা জায়গা। এটাই সেম্বে চার্চ। অনেকে বলেন নাজারেথ ব্যাপটিস্ট চার্চ। এমনিতে গুড ফ্রাইডে ছাড়া চার্চে সব দিনই জুতো পড়ে যাওয়া যায়। এই সেম্বে চার্চের বহু দূরে জুতো খুলে রাখতে হয়। এতটাই গোঁড়া এবং রহস্যময় এই সেম্বে-রা, গাইডরা বিদেশিদের চার্চে নিয়ে যেতে ইতস্তত করেন। রবিবার ছাড়া যেতে দারুণ ভয়।
মহাত্মা গাঁধীর বাড়ির গাইড বোঙ্গানি এতটাই আধিপত্য নিয়ে ‘সত্যাগ্রহ’, ‘অহিংসা’-সহ হিন্দি উচ্চারণ করেন, এত নিখুঁত বর্ণনা দেন, তাঁকে দেখে বিদেশি টুরিস্টরা একটা প্রশ্ন করেই থাকেন। “আগের জন্মে তুমি কি গাঁধীরই কেউ ছিলে?” বোঙ্গানি আসলে সেম্বে চার্চের কয়েক লক্ষ ভক্তদের মধ্যে এক জন। মুসলিমদের সঙ্গে এঁদের অনেক মিল। দাড়ি রাখেন। ধূমপান, মদ্যপান নিষিদ্ধ। দীর্ঘ দিন উপোস থেকে মিছিল করে পাহাড়ে যান। বোঙ্গানি দেখি গাঁধী নিয়ে বলতে বলতে স্বচ্ছন্দ হয়ে ওঠেন ভুভুজেলায়। “১৯১০-এ সেম্বের প্রতিষ্ঠাতা ইসাইয়া সেম্বে ভুভুজেলার মতো বাজনা বাজানো শুরু করেন। যত দূর জানি এটা ছিল উপাসনার প্রতীক। আমাদের সবাই এটা জানে। প্রতিষ্ঠিত সত্য।”
ডারবানের এনটান্দোকাজি ট্যুরসের অপারেশনস ডিরেক্টর কুলেকানি এম্বোনাম্বিও এই মতে বিশ্বাসী। সৈকত সংলগ্ন হোটেলকর্মী আবদুলও তাই। রেডিও সাংবাদিক এলিলে এমবুলি আবার মানতে চাইলেন না, “চার্চের দাবিটা গুরুত্ব দেবেন না। চার্চের বাজনাটা অন্য রকম ছিল।” ভারতের বাইরে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ভারতীয় থাকেন ডারবানে। তাঁদেরই এক জন আই টি ইঞ্জিনিয়ার আবদুলের সঙ্গে দেখা হল ডারবান সিটি হলে। তাঁর কথায়, “হতে পারে কাইজার সমর্থক ফুটবল মাঠে প্রথম ভুভুজেলা এনেছেন। ডাচ ভদ্রলোক প্রথম মার্কেটিং করেছেন। কিন্তু চার্চ থেকেই ভুভুজেলার মতো কিছু বাজানো শুরু বলে মনে হয়।”
বৃষ্টি, অঝোর বৃষ্টি ডারবানে। নাটাল প্রদেশের অনেক শহরে দু’দিন ধরে বরফ পড়েছেযা এ অঞ্চলে অপ্রত্যাশিত। হঠাৎই যেন জায়গাটা বিশ্বকাপের সময়ের দক্ষিণ আফ্রিকা। ঠান্ডা। কনকনে বাতাস। সমুদ্রের ধারে ঝোড়ো বাতাসে সারা দিন ধরে অদ্ভুত এক শব্দ তৈরি হচ্ছে। বাঁশির। না, না, শব্দটা যেন আরও চেনা। ভুভুজেলার। ফুটবলের ভুভুজেলা চিরকালের জন্য থেকে গিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকায়।
|
|
|
|
|
|