|
|
|
|
তেন্ডুলকরের ট্র্যাফিক সিগন্যাল সবুজ হচ্ছে না |
গৌতম ভট্টাচার্য • নটিংহ্যাম |
ঐতিহাসিক জনশ্রুতি হল, পুরুকে যুদ্ধে হারিয়ে সম্রাট আলেকজান্ডার জিজ্ঞেস করেছিলেন, বলো আমার কাছে কী চাও?
ঐতিহাসিক সত্যতা হল, কোচ হওয়ার পর গ্যারি কার্স্টেন জিজ্ঞেস করেছিলেন সচিন তেন্ডুলকরকে, বলো আমার কাছে কী চাও?
প্রথমটা জনশ্রুতি এ জন্য যে সংলাপটা ডি এল রায়ের নাটক থেকে বহুখ্যাত হয়ে গেলেও সপক্ষে কোনও সুস্পষ্ট প্রমাণাদি নেই।
পরেরটা জনশ্রুতি নয় এ জন্য যে কার্স্টেন নিজেই ঘটনাটা ফাঁস করেছেন। আর এমন এক ক্রিকেট বিষয়ক অনুষ্ঠানে, যেখানে একেবারে সামনের রো-তে বসে আছেন তেন্ডুলকর।
অ্যাডিলেডে যখন তিনি প্রশ্নটা করেন, সচিনের উত্তরটা মনে রাখার মতো ছিল। “চাই বিশ্বাসী বন্ধুত্ব।”
বুধবার ট্রেন্টব্রিজ মাঠে দাঁড়িয়ে একটা কৌতূহলের নিরসন করা গেল না। নতুন কোচ ডানকান ফ্লেচারের সঙ্গে কি তেন্ডুলকরের বিশ্বাসী বন্ধুত্ব স্থাপন হয়েছে? না কি সংসারে দশ-বারো দিন কাটিয়ে ফেলার পরেও এখনও তাঁরা পরস্পরের অপরিচিত? কেমন মনে হল, উত্তরটা দ্বিতীয়টার দিকেই ঝুঁকে। কোচ হিসেবে কার্স্টেন নিজের গুরু মনে করেন ফ্লেচারকে। কিন্তু সচিনের সঙ্গে দূরত্ব ভাঙার ব্যাপারে কার্স্টেনের নমনীয় ব্যক্তিত্ব আর কম বয়সটাও বোধহয় দারুণ কাজ করেছিল। ভারতীয় অনুশীলনে যার যার শরীরী ভাষা যদি ট্র্যাফিক সিগন্যাল হয়, তা হলে ফ্লেচার-তেন্ডুলকর সিগন্যাল যেন এখনও লাল। সবুজ হয়নি। |
|
‘বিশ্বাসী বন্ধুত্ব’ এখনও অস্পষ্ট।-এএফপি |
নেটে তাঁকে প্রতিদিন থ্রোয়িং ডাউন প্র্যাক্টিস দিতেন কার্স্টেন। কাঁধের ওপর থেকে প্রতিদিন অন্তত হাজার বল ছুড়তেন। অভিনব এই অনুশীলন করানো থেকে দু’জনের বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হয়ে যায়। বাষট্টি বছরের ফ্লেচারের পক্ষে ওই অনুশীলন করানো সম্ভব নয়। তিনি নেটে পাঠাচ্ছেন ফিল্ডিং কোচ ট্রেভর পেনিকে। পেনি ওয়ারউইকশায়ারের ক্রিকেটার। একটা সময় শ্রীলঙ্কার সহকারী কোচ ছিলেন। কিন্তু এই বল ছোড়া একটা নির্দিষ্ট গতি, নির্দিষ্ট ছন্দ দাবি করে। কার্স্টেন তাতে অভ্যস্ত ছিলেন। টিমমেট হার্সেল গিবসকে বহু বছর আগেও তিনি একই অনুশীলন করিয়েছেন। তাই সচিনে অভ্যস্ত হতে অসুবিধে হয়নি। কিন্তু পেনি ঝট করে মানাবেন কী করে? তা-ও এই শেষ জুলাইয়ের খুঁতখুঁতে সচিনকে। লর্ডসে রান না পেয়ে যিনি মানসিক ভাবে আরও খুঁতখুঁতে হয়ে রয়েছেন। পেনির ট্রেনিং যথেষ্ট উপযুক্ত হচ্ছে না বুঝে বন্ধু হরভজন এ দিন নেটে ছুটে আসেন সচিনের কাছে। লর্ডসে ২১৮ রান দিয়ে মাত্র এক উইকেট পাওয়া সর্দার নিজেই চাপে। ওয়াসিম আক্রম তো পরামর্শ দিয়েছেন হরভজনকে বসিয়ে ভারতের উচিত অমিত মিশ্রকে খেলানো। ইংল্যান্ড লেগস্পিনার খেলতে বরং সমস্যায় পড়বে। এই অবস্থাতেও হরভজন নিজে নেটে বল বসিয়ে বন্ধুকে থ্রোয়িং ডাউন করালেন অন্তত এক ঘণ্টা।
ট্রেন্টব্রিজ ড্রেসিংরুমে ঢুকতে যাওয়ার সময় দাড়ি কেটে ফেলা পরিচ্ছন্ন চেহারার সচিন আনন্দবাজারকে জানিয়ে গেলেন, জ্বরটা সেরেছে। কিন্তু এত অ্যান্টিবায়োটিক তার জন্য গিলতে হয়েছিল যে, শরীরটা খুব দুর্বল হয়ে রয়েছে। গান অ্যান্ড মুর ব্যাট তৈরির বিশ্ববিখ্যাত কম্পানিতে তাঁর ব্যাট প্রাক্-ট্রেন্টব্রিজ শেষ পরিচর্যার জন্য পাঠালেন সচিন। কাছ থেকে তখন দেখলাম তাঁর নতুন সিরিজের ব্যাট। অ্যাডিডাস-এরই। কেবল এই সিরিজে কাঠের ওপর মোটা করে লেখা ‘মাস্টার ব্লাস্টার’। যেখানে দাঁড়িয়ে তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছে তার ঠিক পিছনেই কাউন্টির স্মারক-ঘর। লম্বা করে প্রাচীন আমলের ব্যাটগুলো সব ঝোলানো। গ্রেস থেকে লারউড। প্রাচীন সেই ব্যাটগুলো দেখলে মনে হবে এক্ষুনি উইলো গাছের ডাল কেটে বুঝি তৈরি করা হল। এত সরু। আর মনে হবে বিভিন্ন আমলের মধ্যে আসলে সন্তোষজনক কোনও তুলনাই সম্ভব নয়! সরঞ্জাম এবং খেলার নিয়ম যেখানে এত বদলেছে!
ট্রেন্টব্রিজ মাঠটা ছোট। নটিংহ্যামশায়ারও কাউন্টি হিসেবে বড় কিছু জায়গা নয়। যাদবপুর, গড়িয়া আর টালিগঞ্জ মেলালে যা হবে সেই সাইজ। কিন্তু ক্রিকেট মাঠটার একটা গমগমে ইতিহাসের গন্ধ আছে। সচিন যেখানে ঢুকে গেলেন সেখান থেকেই ব্র্যাডম্যান বেরিয়ে আসতে বলেছিলেন তাঁর দলকে। স্ট্যান ম্যাকেবের সেই ২৩২ দেখার জন্য। বলেছিলেন, দেখে নাও। দু’চোখ ভরে দেখে নাও। এ জিনিস আর কখনও দেখবে না। ম্যাকেব-কে টিম ডাকত ‘নেপার’। কারণ তাঁকে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের মতো দেখতে ছিল। আর তাঁর শরীরে ব্যর্থতার ভয় বলে কোনও বস্তু ছিল না।লর্ডস-অর্জিত অসম্মান মোছার জন্য ভারতেরও এখন চাই ‘ম্যাকেব’। যিনি ভয়ডরহীন আক্রমণ করবেন ট্রেমলেটদের। কিন্তু সেটা কে করবে? যুবরাজ সিংহকে যেমন অসম্ভব যত্নে অনুশীলন করানো হল তাতে মনে হচ্ছে, একটা বিকল্প হিসেবে তৈরি রাখা হচ্ছে। গম্ভীর সুস্থ না থাকলে। এমনকী মুকুন্দ-কে বসিয়ে যদি খেলানো যায়। যুবরাজ টিমে থাকলে পেসারদের লম্বা বোলিং স্পেলের মাঝে খানিক কমা বা সেমিকোলন হতে পারেন। নইলে ধোনিকে সেই গ্লাভস খোলার জন্য তৈরি থাকতে হবে। ইশান্ত শর্মা এরই মাঝে লম্বা চুল পুরো উড়িয়ে দিয়েছেন। ক্রিকেটারদের কুসংস্কার হল, যে যেমন ভাবে সাফল্য পায় তাকে ধরে রাখা। হাল্কা দাড়ি থাকা অবস্থায় রান পেলে পরের ম্যাচে হাল্কা দাড়ি রেখে দেওয়া। ইশান্তকে ব্যতিক্রম মনে হল। না কি লর্ডস টেস্ট হারার শোকে ওই দিনই বিসর্জন দিলেন তাঁর এত দিনের ‘স্টাইল স্টেটমেন্ট’। টিমে যিনি ইশান্তের অনুপ্রেরণা এবং সর্বক্ষণ যাঁর কাছে টিপস নেন সেই জাহির খান কাছেই হাঁটাহাঁটি করছেন। মুখে খেলা করছে এমন অদ্ভুত যন্ত্রণা যেন তিনি কোনও পপ সিঙ্গার, যাঁর লেটেস্ট, প্রচুর হাইপ হওয়া অ্যালবামের সলিলসমাধি ঘটেছে। এমনিতে বললেন, “ঠিক আছি।” আসলে ঠিক নেই এবং ট্রেন্টব্রিজে নেই।
ইংল্যান্ড শিবিরের আগাম এখানেই ২-০ এগিয়ে যাওয়াজনিত তড়পানোর মধ্যে ভারতের আস্থাজনক একটা তথ্য শেষ সফরে এই নটিংহ্যামেই ভারত হারিয়েছিল ইংল্যান্ডকে। আর অনাস্থাজনক তথ্য লারউড, বিল ভোস-দের স্মৃতিবিজড়িত মাঠে নয় উইকেট নিয়ে ইংল্যান্ডকে ভেঙেছিলেন এই জাহির খান।
লন্ডন অলিম্পিক নিয়ে আজ এখানে খুব মাতামাতি হচ্ছে। আর ঠিক এক বছর পর এই দিনে শুরু হচ্ছে ২০১২-র অলিম্পিক। ট্রাফালগার স্কোয়ারে একটা বড় ঘড়ি বসানো রয়েছে অলিম্পিকের জন্য। এক কালে ট্রাফালগার স্কোয়ারের সেরা দ্রষ্টব্য ছিল নেলসনের মূর্তি। সেরা আকর্ষণ পায়রা খাওয়ানো (যা এখন জরিমানা সাপেক্ষ)। আপাতত অলিম্পিক ঘড়িটা হল ট্যুরিস্টদের ছবি তোলার সবচেয়ে জনপ্রিয় স্পট। অলিম্পিক ঠিক কত দিন, কত মিনিট, কত সেকেন্ড দূরে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব ফুটে উঠছে ঘড়িতে।
ক্রিকেটমহলের অবশ্য এই ঘড়িতে কাজ নেই। কাজ আছে ঘড়ির পিছনের লম্বা সিঁড়িতে। অ্যাসেজ জিতে খোলা দোতলা বাসে শহর ঘোরার সংবর্ধনা শেষ হয়েছিল ট্রাফালগার স্কোয়ারে। সালটা ছিল ২০০৫। স্থানীয় রেডিওতে আজ বলছিল, এক নম্বর র্যাঙ্কিং পেয়ে গেলে আবার ট্রাফালগার স্কোয়ারে জমায়েত হোক। টিম নাহয় এ বার যাক ট্রাফালগার স্কোয়ার থেকে বাকিংহাম প্যালেস। এক-এক সময় মনে হবেই যে, লর্ডস টেস্ট জিতে বুঝি ইংল্যান্ড ক্রিকেটমহলের নত্বষত্ব লোপ পেয়েছে! |
|
|
|
|
|