সরাসরি দুর্নীতির অভিযোগ, প্রবল চাপে ইয়েদুরাপ্পা
আঁচ মিলেছিল ফাঁস হওয়া রিপোর্টেই। তবু অনড় ছিলেন তিনি। কর্নাটকের লোকায়ুক্তের রিপোর্টে দুর্নীতির দায়ে সরাসরি অভিযুক্ত হওয়ার পরে, এ বার কী করবেন কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী বি এস ইয়েদুরাপ্পা?
উত্তরটা স্পষ্ট হয়নি গভীর রাতেও। বিজেপি-র এক শীর্ষ নেতা আজ রাতে বড়জোর এইটুকু বলতে পেরেছেন, “ইয়েদুরাপ্পার যাওয়াটা প্রায় নিশ্চিতই। তবে সেটা মসৃণ ভাবে হবে, নাকি বিদ্রোহের পথে, সেটা বলা যাচ্ছে না।” সতর্ক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরাও। কারণ, খোদ লালকৃষ্ণ আডবাণী, সুষমা স্বরাজরা আগে এক বার চেষ্টা চালিয়েও পেরে ওঠেননি। পঞ্চায়েত নির্বাচন আসন্ন ও রাজ্যের শক্তিশালী লিঙ্গায়েত ভোট ব্যাঙ্ক তাঁর দিকেই এই যুক্তি দেখিয়ে সে যাত্রায় ক্ষমতায় থেকে যান ইয়েদুরাপ্পা। তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরাও মানছেন, লোকায়ুক্তের রিপোর্ট পেশ হওয়ার পরে তাঁর মুখ্যমন্ত্রী পদে থেকে যাওয়ার দাবিটা অনেক দুর্বল হয়ে গেল। শক্ত হল তাঁদের হাত, দলে যাঁরা তাঁর অপসারণ চাইছেন।
লোকায়ুক্তের রিপোর্ট পেশের পরই রাজধানীতে আজ দফায় দফায় বৈঠকে বসেন বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতারা। তলব করা হয় ইয়েদুরাপ্পাকেও। বেঙ্গালুরু থেকে এখানে পৌঁছানোর পরে রাতে নিতিন গডকড়ীর বাড়িতে বৈঠকে বসেন তিনি। অরুণ জেটলি, বেঙ্কাইয়া নায়ডু, রাজনাথ সিংহের মতো দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারাও যোগ দেন বৈঠকে। দলীয় সূত্রের ইঙ্গিত, ইয়েদুরাপ্পা অনড় থাকলে তাঁকে পদে রেখেই রাজ্যে নির্বাচন করিয়ে সঙ্কট সামলানো যায় কি না, তা নিয়েও ভাবছেন শীর্ষ নেতারা। সে ক্ষেত্রে ভোটের প্রচারে দল বলতে পারবে ইয়েদুরাপ্পা পক্ষপাতের শিকার। কারণ, অতীতে একই ভাবে সরকারি ক্ষমতা প্রয়োগ করা সত্ত্বেও কংগ্রেসে বড় কোনও নেতার বিরুদ্ধেই আঙুল তোলেননি লোকায়ুক্ত। সেই সঙ্গে এ-ও বলা যাবে, রিপোর্টে আনা অভিযোগগুলির প্রায় সবই বিচারাধীন মামলা। আইনকে নিজের পথেই চলতে দেওয়া উচিত।
এখনও আত্মবিশ্বাসী। নিতিন গডকড়ীর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন ইয়েদুরাপ্পা। নয়াদিল্লিতে। পিটিআই
কর্নাটক মন্ত্রিসভায় কাল রিপোর্টটি নিয়ে আলোচনা হবে। সে কারণে নিয়ে আলোচনা হবে। সে কারণে কালই ইয়েদুরাপ্পা ফিরে যাবেন রাজ্যে। গডকড়ীরও নাগপুর যাওয়ার কথা। গভীর রাত পর্যন্ত আলোচনা গড়ালেও ছবিটা স্পষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা কাল সকালে।
কর্নাটকে অবৈধ খনন নিয়ে রাজ্য সরকার লোকায়ুক্ত বিচারপতি সন্তোষ হেগড়েকে রিপোর্ট দিতে বলেছিল ২০০৬ সালে। সেই রিপোর্ট আজ রাজ্যের মুখ্যসচিবের কাছে জমা দেওয়া হল। মূল রিপোর্ট ৯৪৩ পাতার। সংযোজনী-সহ ধরলে মোট ২৫ হাজার ২২৮ পাতা। রিপোর্টে অবৈধ খননের জন্য মুখ্যমন্ত্রী ইয়েদুরাপ্পাকে সরাসরি অভিযুক্ত করে বলা হয়েছে, এ ব্যাপারে বারবার বলা সত্ত্বেও রাজ্য সরকার কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে ২০০৬ থেকে চার বছরে রাজ্য সরকারের মোট ১৬ হাজার ৮৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আর তার রাস্তা করে দেওয়ার জন্য অবৈধ খননে জড়িত কয়েকটি খনন সংস্থা মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়েছে ইয়েদুরাপ্পার পরিবারকে। তাঁর পরিবার একটি সংস্থাকে বেঙ্গালুরুর উপকণ্ঠে ১.৪ কোটি টাকা দামের জমি ২০ কোটি টাকায় বিক্রি করেছে। দেখা যাচ্ছে, সংস্থাটি সরকারের খনন সংক্রান্ত কাজে জড়িত।
এই সব অভিযোগের ভিত্তিতে দুর্নীতি দমন আইনে ইয়েদুরাপ্পার বিরুদ্ধে মামলা করার সুপারিশ করা হয়েছে রিপোর্টে। এর একটি কপি রাজ্যপাল হংসরাজ ভরদ্বাজকেও পাঠানো হয়েছে। তিনি রিপোর্টটি খতিয়ে দেখে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ পাঠাবেন বলে আগেই জানিয়ে রেখেছেন। এ দিন রিপোর্ট পেশের পর সাংবাদিক বৈঠকে হেগড়ে বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে যা ব্যবস্থা নেওয়ার তা রাজ্যপাল বা সুপ্রিম কোর্টই নিতে পারে।” দুর্নীতির নমুনা দিতে গিয়ে সাংবাদিক বৈঠকে হেগড়ে বলেন, “নিজেদের আর্থিক অবস্থা তেমন ভাল না হওয়া সত্ত্বেও একটি সংস্থা ইয়েদুরাপ্পার পরিবারকে ঘুষ দিতে ধার করে টাকা নিয়েছিল। কয়েকটি সংস্থা আবার ঘুষ দিয়েছিল চেকে। মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের এক জনের পরিচালিত ট্রাস্টে একটি খনন সংস্থা ১০ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছিল। ওই ট্রাস্টের সঙ্গে খনন সংস্থার কোনও সম্পর্ক নেই। ওই খনন সংস্থার জমি সংক্রান্ত চুক্তিতেও বেশ কিছু গরমিল রয়েছে। দুর্নীতি রোধ আইনে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করেছি।”
বিজেপি-র সিংহভাগ নেতাই মনে করছেন, এর পরেও ইয়েদুরাপ্পাকে মুখ্যমন্ত্রীর পদে রেখে দেওয়াটা কৌশল হিসেবে ঠিক হবে না। কারণ তাতে দুর্নীতির প্রশ্নে কংগ্রেসকে কোণঠাসা করা যাবে না। তাই ইয়েদুরাপ্পাকে সরাতে হলে সেটা করতে হবে সংসদের বাদল অধিবেশন শুরুর আগেই। কিন্তু কর্নাটকের জাতপাত ও দলীয় নানা সমীকরণের প্রশ্নে তাঁকে সরিয়ে দেওয়াও মোটে সহজ কাজ নয়। লোকায়ুক্তের রিপোর্ট ফাঁস হওয়া সত্ত্বেও তাই ইয়েদুরাপ্পাকে মুখ্যমন্ত্রী পদে রাখা না-রাখার প্রশ্নটিকে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন গডকড়ীরা। লোকায়ুক্তের রিপোর্ট পেশ হলে আইনি পথে কী ভাবে তার মোকাবিলা সম্ভব, তার পথও খুঁজতে শুরু করেছিলেন দলের আইন বিশেষজ্ঞ নেতা অরুণ জেটলি।
• দুর্নীতি রোধ আইনে মামলার সুপারিশ ইয়েদুরাপ্পার বিরুদ্ধে
• মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারকে ঘুষ অবৈধ খননকারী সংস্থার
• পরিবারের এক সদস্যের ট্রাস্টকে ১০ কোটি টাকা অনুদান খননসংস্থার
• খননসংস্থাকে ২০ কোটি টাকায় জমি বিক্রি ইয়েদুরাপ্পা পরিবারের
• অবৈধ খননের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেয়নি বিজেপি সরকার
• ১৬ হাজার ৮৫ কোটি টাকা ক্ষতি সরকারের (২০০৬-১০)
• আরও অভিযুক্ত দেবগৌড়া-পুত্র কুমারস্বামী, সস্ত্রীক কংগ্রেস সাংসদ অনিল লাড, বিজেপির রেড্ডি ভাইরা
লোকায়ুক্তের রিপোর্টে ইয়েদুরাপ্পার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এতটাই প্রত্যক্ষ যে এর পরও তাঁকে রেখে দিলে জাতীয় রাজনীতিতে বিপাকে পড়বে দল। কিন্তু বিজেপি-র কাছে সমস্যা নানাবিধ। প্রথমত, ইয়েদুরাপ্পা সহজে ইস্তফা দেওয়ার পাত্র নন। দ্বিতীয়ত, ইয়েদুরাপ্পাকে সরানো সম্ভব হলে তাঁর উত্তরসূরি কে হবেন, সেটিও মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তৃতীয়ত, ইয়েদুরাপ্পা নিজে নির্বাচনে গিয়ে জনমত নেওয়ার দাবি করছেন। এই বিষয়গুলিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বিজেপি আর একটু সময় নিতে চাইছে। সে কারণে আপাতত সুদীর্ঘ রিপোর্টটিকেই ঢাল করছে তারা। রিপোর্ট পেশের পরেই আডবাণীর বাড়িতে কর্নাটক নিয়ে বৈঠক করেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। যদিও বৈঠকের পর বাইরে এসে রবিশঙ্কর প্রসাদ বলেন, “টু-জি নিয়ে দলের কৌশল কী হবে, সেটি আলোচনার জন্যই এই বৈঠক আগে নির্ধারিত ছিল। আর লোকায়ুক্তের রিপোর্ট পড়েই আমরা পদক্ষেপ করব।”
শুধু ইয়েদুরাপ্পাই নন, তাঁর সরকারের প্রায় ছ’শো জন অফিসার, বিজেপি-তে ইয়েদুরাপ্পার বিরোধী রেড্ডি ভাইরা, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জেডিএস-এর এইচ ডি কুমারস্বামীর বিরুদ্ধেও অনিয়মের অভিযোগ আনা হয়েছে রিপোর্টে। কংগ্রেসের কোনও বড় নাম না থাকায় কিছুটা স্বস্তিতে কংগ্রেস। রাজ্যসভার কংগ্রেস সাংসদ অনিল লাডের নাম থাকলেও এস এম কৃষ্ণ কিংবা ধর্ম সিংহকে রেহাই দেওয়া হয়েছে। তাই ইয়েদুরাপ্পার ইস্তফার দাবিতে এখন তেড়েফুঁড়ে নেমেছে কংগ্রেস। দলের নেতা বি কে হরিপ্রসাদ বলেন, “যে বিজেপি মুখে নৈতিকতার কথা বলে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে, এই রিপোর্ট আসার পরেই ইয়েদুরাপ্পার ইস্তফা দেওয়া উচিত ছিল। তিনি ইস্তফা না দিলে অবিলম্বে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া উচিত বিজেপি নেতৃত্বের।” কংগ্রেসের মুখপাত্র শাকিল অহমেদ রিপোর্ট আসার পর সুষমা স্বরাজ ও অরুণ জেটলির দিকেই তোপ দাগেন। তিনি বলেন, “আগে বলা হত রেড্ডি ভাইদের মন্ত্রী করেছেন সুষমা স্বরাজ। তার পর সুষমা নিজেই বলেছেন, অরুণ জেটলি কর্নাটকের দায়িত্বে আসার পরেই রেড্ডি ভাইয়েরা মন্ত্রী হয়েছেন। বিজেপি-র এই অন্তর্কলহ থেকেই স্পষ্ট, দলের শীর্ষ নেতৃত্ব কর্নাটকের এই দুর্নীতির সুফল ভোগ করেছেন।”
Previous Story Desh Next Story


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.