|
|
|
|
দুই কাশ্মীরে যোগই শান্তির সূত্র, গুরুত্ব সন্ত্রাস দমনেও |
অগ্নি রায় • নয়াদিল্লি |
শান্তিপ্রক্রিয়ায় এ বার উজ্জ্বল জুলাই-বৈঠক!
গত জুলাইয়ে ইসলামাবাদে ভারত-পাকিস্তান বিদেশমন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনা ভেস্তে গিয়েছিল। আর এই জুলাইয়ে পাকিস্তানের নতুন বিদেশমন্ত্রী হিনা রব্বানি খারের সঙ্গে ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণের আলোচনা ইতিবাচক ভাবে শেষ হয়েছে বলেই কূটনৈতিক মহলের মত। আজ নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে দুই বিদেশমন্ত্রীর বৈঠকে পারস্পরিক আস্থা বাড়াতে মূলত দুই কাশ্মীরের মধ্যে যোগাযোগ আরও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
পাকিস্তানের কনিষ্ঠতম বিদেশমন্ত্রী পোশাকের রং নিয়ে আজ বৈঠক শুরুর আগেই জল্পনা শুরু হয়েছিল। হিনার পরনে ছিল ‘অফ হোয়াইট’ রঙের সালোয়ার-কামিজ। যা দেখে অনেকের মনেই প্রশ্ন, শান্তির আবহ তৈরি করতেই কি এমন রং বেছেছেন পাক বিদেশমন্ত্রী? বৈঠক শেষে বোঝা গেল, সেই জল্পনা একেবারে ভিত্তিহীন নয়। গত জুলাইয়ের তিক্ততা মুছে এ বার বজায় থাকল শান্তির রঙই।
‘মতপার্থক্যের’ বহু জায়গাই অবশ্য এখনও রয়েছে। বৈঠকের পরে দু’দেশের নেতৃত্ব তা স্বীকারও করেছেন। কিন্তু একই সঙ্গে জানিয়েছেন, ধাপে ধাপে তা কমিয়ে কী ভাবে ‘মতৈক্যের’ জায়গাগুলো আরও বাড়ানো যায়, সেই সূত্র খোঁজাই তাঁদের আশু কূটনৈতিক লক্ষ্য। সবিস্তার যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করে দুই কাশ্মীরের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানো-সহ বিভিন্ন বিষয়ে নতুন আস্থাবর্ধক পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। সন্ত্রাস মোকাবিলায় সহযোগিতা বাড়ানো থেকে শুরু করে ভারত-পাকিস্তান যৌথ কমিশনকে পুনরুজ্জীবিত করার সিদ্ধান্তও হয়েছে। সন্ত্রাসবাদ নিয়ে ভারতের উদ্বেগও বিশদ জায়গা পেয়েছে ওই বিবৃতিতে। পরে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে বৈঠকে তাঁকে পাকিস্তানে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান হিনা। এর আগে মোহালিতে বিশ্বকাপে ভারত-পাক সেমিফাইনাল দেখতে এসে তাঁকে একই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন পাক প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি। |
|
বাঙ্ময়: যৌথ বিবৃতির সময় দুই বিদেশমন্ত্রী, এস এম কৃষ্ণ
এবং হিনা রব্বানি। বুধবার নয়াদিল্লিতে। পিটিআই |
মুম্বই সন্ত্রাসের পরেও পাকিস্তানের সঙ্গে এ দফার শান্তি আলোচনা মনমোহন-দর্শনেরই ফসল। ঘরোয়া রাজনীতির চাপ উপেক্ষা করে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী তিনি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বরাবরই মনে করেন, সমস্যার সমাধানে আলোচনার বিকল্প নেই। পাশাপাশি সীমান্তকে অপ্রাসঙ্গিক করে দিয়ে দু’দেশের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানো দরকার। ২০০৯-এ মিশরের শর্ম-অল-শেখ বা এক বছর আগে ভুটানের থিম্পুতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে সেই সূত্রই তুলে ধরেছিলেন মনমোহন। গত জুলাইয়ে বিদেশমন্ত্রীদের বৈঠকে আলোচনার সেই প্রক্রিয়া বড় ধাক্কা খেয়েছিল। তবে এ বছরের প্রথম দিকে সেই থিম্পুতেই বিদেশসচিবদের বৈঠকে ঠিক হয়েছিল, দুই দেশের মধ্যে সুসংহত আলোচনা (যদিও তা সরকারি ভাবে বলা হচ্ছে না) ফের শুরু করা হবে। ফলে এ দিনের বৈঠকে ফুটে উঠল সেই ‘থিম্পু-স্পিরিট’ও। ভারতের বিদেশসচিব নিরুপমা রাও-ও বললেন সেই কথাই।
এমন নয় যে মুম্বই সন্ত্রাসে অভিযুক্তদের মামলা দ্রুত শেষ করা নিয়ে আজ কোনও পাকা কথা পেয়ে গেল নয়াদিল্লি। এ কথাও ঠিক, গত কাল ভারতে নেমেই পাক বিদেশমন্ত্রী হুরিয়ত নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করায় সাউথ ব্লক অসন্তুষ্টও। তবে ভারতীয় কর্তাদের বক্তব্য, এই অস্বস্তির জায়গাগুলো মুক্ত কণ্ঠে তুলে ধরে সর্বোচ্চ স্তরে চাপ তৈরির জন্যও আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। বৈঠকের পর ভারতীয় বিদেশসচিব নিরুপমা রাওয়ের বক্তব্য, “বহু ক্ষেত্রেই মতবিরোধ রয়েছে। সেগুলো আদৌ খাটো করে দেখছি না। পাক নেতৃত্বকে জানিয়েছি, সন্ত্রাস এবং হিংসামুক্ত পথেই এগোতে হবে। আমাদের চেষ্টা, আলোচনার পথে উন্নততর পরিস্থিতি তৈরি করা।” বিদেশমন্ত্রী কৃষ্ণর কথায়, “আমাদের অনেকটা রাস্তা পাড়ি দিতে হবে। তবে তা করতে হবে খোলা মনে। আজকের আলোচনায় সেটাই হয়েছে।” পাশে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের নতুন বিদেশমন্ত্রী হিনা রব্বানি খারও বললেন, “আমি নজর করে দেখেছি, দু’দেশেরই মানসিকতার পরিবর্তন হয়েছে। পাকিস্তানের মানুষ ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব চাইছেন।” শুধুই কি তাই? বললেন, “ভারতের বিদেশমন্ত্রী আমায় জানালেন, দিল্লিতে কমনওয়েলথ গেমস-এর মার্চপাস্টে ভারতের পরে সব থেকে বেশি হাততালি পেয়েছিল পাকিস্তানই।” সব মিলিয়ে বিতর্ক এড়িয়ে আন্তরিকতার আবহ তুলে ধরার চেষ্টায় আজ কমতি ছিল না দু’পক্ষেই।
কূটনৈতিক সূত্রের বক্তব্য, আজ আলোচনার শুরুতেই হুরিয়তের সঙ্গে হিনার বৈঠক নিয়ে নয়াদিল্লির অসন্তোষের কথা জানানো হয়েছে পাক নেতৃত্বকে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে হিনা রব্বানি কিন্তু আজ বৈঠকের পর ‘কাশ্মীর’ শব্দটিই উচ্চারণ করেননি। বিদেশ মন্ত্রকের দাবি, ভারতের অসন্তোষকে অন্তত সাময়িক ভাবে হলেও মর্যাদা দিতে এই নীরবতা। পাক বিদেশসচিব সলমন বশিরকেও গত কালের হুরিয়ত নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে
তিনি বলেন, “সব কিছুকে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়ার দরকার নেই।” |
আস্থার পথ |
|
• দুই কাশ্মীরের মধ্যে বাস প্রতি সপ্তাহে |
• ভ্রমণের আবেদনের নিষ্পত্তি ৪৫ দিনে |
• যৌথ বাণিজ্য দু’দিনের বদলে ৪ দিন |
• আপাতত ২১টি পণ্যের কেনাবেচা |
• টেলিফোন যোগাযোগে উন্নতি |
• দু’পারের ব্যবসায়ীদের নিয়মিত বৈঠক |
|
ভারত-বিরোধী সন্ত্রাস দমনে পাকিস্তানকে যে হাতে কলমে কিছু করে দেখাতে হবে এবং মুম্বই হামলায় জড়িতদের দ্রুত শাস্তি দিতে হবে সেই দাবিতেও আজ সরব হয়েছেন ভারতীয় নেতৃত্ব। যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘দু’দেশের বিদেশমন্ত্রীই একমত যে শান্তি ও নিরাপত্তার প্রশ্নে ধারাবাহিক সন্ত্রাস একটি চ্যালেঞ্জ। সন্ত্রাসদমনে দু’দেশের সহযোগিতা শক্তিশালী করার বিষয়ে জোর দেওয়া হবে বলে স্থির হয়েছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকগুলির মধ্যেও যোগাযোগ বাড়ানো হবে যাতে সন্ত্রাসবাদীরা সাজা পায়।’ পরে পাকিস্তানে মুম্বই-অভিযুক্তদের মামলার ধীরগতি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে পাক বিদেশসচিব বলেন, “আমি জানি কিছু ক্ষেত্রে অনেকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে। তবে এ ব্যাপারে অনেক কিছুই করা হচ্ছে, যা বাইরে থেকে বোঝা যাবে না। অযথা বিদ্বেষ বাড়িয়ে লাভ নেই।” পরে অবশ্য ভারতীয় একটি টিভি চ্যানেলকে হিনা রব্বানি বলেন, “পাকিস্তানের স্বার্থেই মুম্বই মামলা দ্রুত শেষ করা প্রয়োজন। তবে পাকিস্তানের মানুষ এ প্রশ্নও তো তুলছেন, সমঝোতা বিস্ফোরণ মামলাতেই বা এত সময় লাগছে কেন?”
আবার কাশ্মীর সমস্যার সমাধান নিয়ে পাকিস্তানের তরফে বিভিন্ন সময়ে যে ভাবেই চাপ দেওয়া হোক না কেন, এ ব্যাপারে বরাবরই ‘ধীরে চলো’ নীতি নিয়েই এগিয়েছে নয়াদিল্লি। মনমোহন সিংহ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর কাশ্মীরের মাটিতে দাঁড়িয়ে স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছিলেন, ভারতের সীমান্ত নতুন করে আঁকার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তবে সীমান্তকে ‘অপ্রাসঙ্গিক’ করে দিয়ে দু’দেশের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ আরও বাড়ানোর আহ্বানই করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এক বছর আগে থিম্পুর পার্শ্ববৈঠকেও কাশ্মীর নিয়ে এই অবস্থানেই অনড় ছিলেন মনমোহন। আজ তাঁর সেই কূটনৈতিক দর্শনকেই বাস্তবে পরিণত করে দেখাতে পেরেছে ভারত। যৌথ বিবৃতিতে দু’দেশের নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর বাণিজ্য ও যোগাযোগ বাড়াতে একাধিক পদক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুই দেশ। যার মধ্যে রয়েছে, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের সময় বাড়ানো (দুই থেকে চার দিন), দু’দেশের তরফেই ২১টি করে পণ্য বাণিজ্যের জন্য চিহ্নিত করা, টেলি-যোগাযোগকে শক্তিশালী করার মতো বিষয়গুলি। এ ছাড়া, শ্রীনগর-মুজফ্ফরাবাদ এবং পুঞ্চ-রাওয়ালকোট বাস পরিষেবার দিন বাড়ানো, সীমান্তের অন্য পারে যাওয়ার জন্য আবেদন-প্রক্রিয়াকে সরল করা, ছ’মাসের জন্য ‘মাল্টিপল ভিসা এন্ট্রি’ দেওয়ার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে।
বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি যে ক্রিকেট-কূটনীতিকে জিইয়ে তুলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ, এ দিন তাকেও এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন পাকিস্তানের নতুন বিদেশমন্ত্রী। পোলো-প্রেমী হিনা বৈঠকে ভারতের দেশমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন, দু’দেশের ক্রিকেট সিরিজ ফের চালু করতে। টেনিসে পারদর্শী কৃষ্ণও কন্যা-সম হিনাকে উৎসাহ দিয়ে বলেন, হকি-সিরিজও চালু করতে উৎসাহী নয়াদিল্লি। তার আগেই অবশ্য ভারতের প্রবীণ বিদেশমন্ত্রী তাঁকে বলেছেন, ভারতের জনসংখ্যার অর্ধেকের গড় বয়স হিনারই সমান!
তাই পাক বিদেশমন্ত্রী নিশ্চয় ভারতের মানুষের মন বুঝতে পারবেন! |
|
|
|
|
|