|
|
|
|
|
|
|
বাইশ গজের গোলন্দাজ |
চেহারাটা বিশাল, কুস্তির রিংয়েই বেশি মানায়! মহম্মদ নিসার। বলে এমনই
জোর, মনে হত বিনা বারুদে গোলা ছুড়ছেন। রানা সেনগুপ্ত |
২৫ জুন। লর্ডসের মাঠ। প্রথম টেস্ট ম্যাচের জন্য ইংল্যান্ড বা তৎকালীন এমসিসি-র অধিনায়ক ডগলাস জার্ডিনের সঙ্গে পাক্কা ছ’ফুট দু’ইঞ্চির একটা চেহারা টস করতে ড্রেসিং রুমের বাইরে বেরিয়ে এল। এই ব্যাটসম্যান কিন্তু প্রথম ইংল্যান্ড সফরে ভারতের অধিনায়ক বা সহঅধিনায়ক, কিছুই ঘোষিত হননি। সে যুগে দলে যতই বাঘাবাঘা ক্রিকেটার থাকুন না কেন, দলের অধিনায়ক-সহঅধিনায়ক হতেন কোনও দেশীয় রাজ্যের রাজা বা রাজকুমার। ইংল্যান্ড সফরও ব্যতিক্রম ছিল না। দলের অধিনায়ক আর সহঅধিনায়ক হয়েছিলেন পোরবন্দরের রাজা আর লিম্বাড়ির কুমার। কিন্তু পোরবন্দরের রাজা একটা বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন সে-বার। ইংল্যান্ডে নেমেই তিনি দলের অধিনায়কত্বের দায়িত্বটা হোলকারবাসী ব্যাটসম্যান সি কে নাইডুর হাতে তুলে দেন। টস ভাগ্যই সে-দিন জিতিয়ে দিল বিখ্যাত অধিনায়ক জার্ডিনকেই।
১৯৩২ সালের ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে এই টেস্ট ম্যাচের আগে সফরকারী ভারতীয় দল সম্পর্কে ইংলিশ প্রেস উৎসাহই দেখায়নি। এলেবেলে দলটার সঙ্গে ইংল্যান্ড অনায়াসে জিতবে, এমনই একটা ধারণা করে মাঠে এসেছিলেন দর্শকেরাও। ইনিংসের গোড়াপত্তন করতে নামলেন ইংল্যান্ডের অতি বিখ্যাত ওপেনিং জুটি হাবার্ট সর্টফ্লিক ও পার্শি হোমস। সি কে যে বোলারের হাতে বল তুলে দিলেন, তাঁর চেহারাটা মোটাসোটা। ক্রিকেটের মাঠের চেয়ে তাঁকে যেন কুস্তির রিংয়েই মানায়! তিনি মহম্মদ নিসার। পৃথিবী বা ভারতের সর্বকালের সেরা ফাস্ট বোলারদের তালিকায় তাঁর নাম উপরের দিকেই থাকবে। প্রায় ৩০ গজের মতো রান-আপ নিয়ে নিসার ছুটলেন বল করতে। শুরু হল ভারত-ইংল্যান্ড সর্বপ্রথম টেস্ট ম্যাচটির। ১৯৩২ সালের এই ম্যাচকে স্মরণ করতেই হচ্ছে, কারণ লর্ডসের মাঠে ফের ২১ জুলাই থেকে মুখোমুখি হয়েছে দু’দল নিজেদের মধ্যে শততম টেস্ট ম্যাচ খেলতে। এই টেস্টটা আবার পৃথিবীর বুকে ২০০০তম টেস্ট! |
|
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য |
নিসারের বোলিং সম্পর্কে একটা প্রবাদ খুবই চালু ছিল। তিনি বিনা বারুদে গোলা ছুড়তে পারতেন। তাঁর বলের এতটাই জোর ছিল যে, সে যুগের ক্রিকেট লেখক তাতে বিস্মিত হতেন। নিসারের গোলন্দাজি ইংল্যান্ডের শিবিরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিল। স্কোর বোর্ডে মাত্র ১১ রানের মধ্যে ফিরে গেলেন বিখ্যাত দুই ওপেনার সর্টফ্লিক আর হোমসকে। কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই নিসারের গোলায় ফের আউট ফ্রাঙ্ক উলি। স্কোর বোর্ডে তখন ১৯-৩। নিসার, লালা অমর সিংহ আর জাহাঙ্গীর খানকে নিয়ে তৈরি ভারতের নতুন বলের আক্রমণ মোকাবিলা করতে গিয়ে প্রবাদপ্রতিম ইংল্যান্ড দলের নাস্তানাবুদ অবস্থা!
অথচ মাত্র কয়েক মাস আগে এই দলটাই অস্ট্রেলিয়ার মাটিতেই অস্ট্রেলিয়াকে ৪-১ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজে হারিয়েছিল! সেই সিরিজের নাম ‘বডি লাইন’। ডগলাস জার্ডিনের ধুরন্ধর ক্রিকেট-মস্তিষ্ক সিরিজে একটা আক্রমণকে তুলে আনে। জাডির্র্ন নিজে তাঁর এই পরিকল্পনাকে ‘লেগ থিয়োরি’ বলে ডাকতেন। ইংল্যান্ডের ফাস্ট বোলার হ্যারল্ড লারউড, টেট, বিল ভোস, বিল বাওয়েসকে দিয়ে অনবরত ব্যাটসম্যানের শরীর লক্ষ্য করে বল করিয়ে যেতেন জার্ডিন। তাঁর এই লেগ থিয়োরির ধাক্কা অস্ট্রেলিয়া সামলাতে পারেনি। স্যর ডন ব্রাডম্যানের মতো বিখ্যাত রানমেশিনও বিগড়ে গিয়েছিল এই আক্রমণের মুখে পড়ে। কিন্তু সত্যিকারের ফাস্ট বোলিংয়ের মুখে পড়ে ইংল্যান্ডের ব্যাটিংও যে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে, নিসার-অমর সিংহ-জাহাঙ্গীর খানেরা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন। ক্রিকেট দৈত্য ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংসে ২৫৯ রানেই গুটিয়ে গেল। খোদ জার্ডিন, উইকেট রক্ষক লেস অ্যামিসকে নিয়ে প্রচণ্ড না লড়লে, অবস্থা আরও খারাপ হত। নিসার পেলেন ৯৩ রানের বিনিময়ে পাঁচ উইকেট।
ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংসে নিসার মাত্র একটা উইকেট পেয়েছিলেন। তাতে কী! ভারতীয় শিবিরে আরও দুই জোর গতির বোলার যে ছিলেন! শুরুতে ইংল্যান্ডকে ধাক্কাটা দেন অমর সিংহ। সর্টফ্লিক নাইডুর হাতে কটআউট। তার পরেই ঝাঁপালেন জাহাঙ্গীর খান। শিকার হোমস, উলি আর ওয়ালি হ্যামন্ড। ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংস গুটিয়ে গেল ২৭৫-এ। ক্রিকেট দুনিয়াকে বুঝিয়ে দিলেন ভারতীয়েরা আমরা বারবার ঝাঁকুনি দিতে তৈরি! তবে ভারতীয় ব্যাটিং তাসের ঘরের মতো ভেঙে না পড়লে, জিততে ইংল্যান্ডকে আরও প্রচুর ঘাম ঝরাতে হত। ইংল্যান্ডের দুই বিল ভোস আর বাওয়েসের আগুনে বোলিং-এ সামান্য রানেই গুটিয়ে যায় ভারতের দুই ইনিংস। দুই বিল ২০টার ভেতর ১১টা উইকেট নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেন। তবে জার্ডিন তাঁর এই বিশ্বখ্যাত ব্যাটসম্যানদের ভারতীয় ফাস্ট বোলিংয়ের সামনে নতজানু হয়ে পড়াকে মানতে পারেননি। তাঁর মতে, সাইট স্ক্রিনের উপরে সাদা আসনগুলি তাঁর ব্যাটসম্যানদের ওভারপিচ বল দেখার সমস্যা তৈরি করেছিল। তাই তাঁর তিন ‘হিরো’ ব্যাটসম্যান হোমস, হামন্ড ও অ্যামিস ওভারপিচ বলেই আউট হয়েছিলেন। ২৫ থেকে ২৮ জুন, চার দিনেই শেষ হয় ভারত-ইংল্যান্ড সর্বকালের প্রথম টেস্ট ম্যাচ। লর্ডসের মাঠে টেস্ট ম্যাচ জিততে ভারতকে অপেক্ষা করতে হয় ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত। তার আগে ওভালে ইংল্যান্ড প্রথম সিরিজ জেতেন ভারতীয় অধিনায়ক ওয়াড়েকর ১৯৭১ সালে।
তবে ভারতীয় ফাস্ট-মিডিয়াম বোলারদের, বিশেষত মহম্মদ নিসার, লালা অমর সিংহকে নিয়ে ব্রিটিশ মিডিয়া উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েছিল। গোটা সফরে নিসার দখল করেছিলেন ৯৭টি উইকেট। গড়ে মাত্র ১৪.০ রানের বিনিময়ে। অমর সিংহের সংগ্রহ ছিল ১১১টি উইকেট। উইজডেন বলেছিল, ইংল্যান্ডের মাটিতে দেখা সেরা বোলারের নাম লালা অমর সিংহ। ইংল্যান্ডের ক্রিকেট বোদ্ধা সি বি ফ্রাই বলেছিলেন, নিসারের বলের গতি লারউডের চেয়েও বেশি। নিসার মূলত আউটসুইং বল করতেন। তাঁর লুকোনো অস্ত্র ছিল আচমকা ব্যাটসম্যানের শরীরের ভেতরে ঢুকে আসা প্রচণ্ড গতির ডেলিভারি। হাওয়ার অনুকূলে নিসার আর হাওয়ার বিরুদ্ধে বল করতেন অমর সিংহ। তিনি ইন ও আউট, দু’ধরনের সুইং-ই করাতেন। তাঁর লুকোনো অস্ত্র একটা ধীর গতির অফ কাটার। ওয়ালি হ্যামন্ডের মনে হয়েছিল, অমর সিংহের অফের দিক থেকে ধেয়ে আসা বলগুলিতে বজ্রবিদ্যুতের শক্তি ছিল। দুই পেসারের একটা মিল ছিল চেহারায়। দু’জনেই ছিলেন অধিনায়ক নাইডুর মতোই, ছ’ফুট দু’ইঞ্চি লম্বা। জাহাঙ্গীরের বলের জোর ছিল নিসারের চেয়ে কম আর অমর সিংহের চেয়ে বেশি।
অমর সিংহ মাত্র ২৯ বছর বয়েসে মারা গিয়েছিলেন। হয়তো তাই তাঁকে নিয়ে তেমন আলোচনা ভারতীয় ক্রিকেটের অলিগলিতে ছড়ানো নেই। আছে নিসারকে নিয়ে। সে-কালের স্নাতক নিসার পেশায় ছিলেন বেঙ্গল-নাগপুর রেলের প্রথম শ্রেণির অফিসার। যতই বিশাল চেহারা আর বলের জোর থাক না কেন, নিসারকে কখনও ফাস্ট বোলারদের কুখ্যাত মেজাজ ‘দেখাতে’ কেউ দেখেনি। তাঁকে বলা হতো ‘জেন্টল জায়েন্ট’ বা শান্ত-ভদ্র দৈত্য। অকারণে বাউন্সার দেওয়া পছন্দ করতেন না। ভারতে তাঁর আমলে কোয়াট্রাঙ্গুলার বা পেন্টাগুলার ক্রিকেট ম্যাচ হত চার বা পাঁচটি দলকে নিয়ে। এমনই একটি ম্যাচে অধিনায়কের নির্দেশ পেয়েও তিনি সি এস নাইডু ও সুঁটে বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো টেলএন্ডারদের বাউন্সার দেননি। আর একবার চোয়ালে চোট পাওয়া কর্তিক বসুকে বাউন্সার দিতে নিসারকে আদেশ করেন দলের অধিনায়ক। বারবার তাঁর নির্দেশের শেষে নিসার বাউন্সার দিলেন ঠিকই, কিন্তু সব বাউন্সারই পড়েছিল অফ স্টাম্পের অনেক বাইরে।
|
|
|
|
|
|