জোট গড়ে পুরভোটে জেতার মাত্র ১২ দিনের মাথায় ভাইস চেয়ারম্যান পদ নিয়ে মনোমালিন্যের জেরে রায়গঞ্জে কংগ্রেস-তৃণমূলের মধ্যে ‘দূরত্ব’ তৈরি হল। ভাইস চেয়ারম্যান পদ না-পেয়ে রায়গঞ্জ পুরসভায় বিরোধী দলের আসনে বসার সিদ্ধান্ত নিল তৃণমূল।
রাজ্য সরকারে শরিক হিসাবে থেকেও বৃহস্পতিবার তৃণমূলের ব্রিগেড সমাবেশে যায়নি কংগ্রেস। দলের একাংশের অভিযোগ, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। তৃণমূলের পাল্টা বক্তব্য, আমন্ত্রণ জানানোর জন্য প্রদীপবাবুকে ফোন করেও যোগাযোগ করা যায়নি। ওই ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই রায়গঞ্জের ঘটনা জোট-শিবিরে ‘ঈষৎ অস্বস্তি’ তৈরি হয়েছে।
রায়গঞ্জ পুরসভায় নয়া পুরবোর্ড গঠিত হয়েছে শুক্রবার। পুরসভায় চেয়ারম্যান পদে ফের শপথ নিয়েছেন জেলা কংগ্রেস সভাপতি এবং অধুনা বিধায়ক মোহিত সেনগুপ্ত। ভাইস চেয়ারম্যান পদে তিনি বেছে নেন তাঁর দলেরই রণজকুমার দাসকে। মোহিতবাবুর যুক্তি, “জোট গড়ার সময়ে তৃণমূল ভাইস চেয়ারম্যান পদ চায়নি। কয়েক দিন আগে হঠাৎ করে চিঠি দিয়ে ভাইস চেয়ারম্যান পদ দাবি করে! এখন তৃণমূলকে ওই পদ ছাড়া সম্ভব নয়। তবে আমরা তৃণমূলের সঙ্গে যে ভাবে জোট করে পুর নির্বাচন করেছি, সে ভাবেই পুর-বোর্ড পরিচালনা করতে চাই।”
কিন্তু পুর-বোর্ড পরিচালনায় কংগ্রেসকে সাহায্য করা দূরে থাক, এ দিন জেলার তৃণমূল নেতা তিলক চৌধুরী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, আগামী কোনও নির্বাচনে উত্তর দিনাজপুর জেলায় কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁরা জোট গড়বেন না। পুরসভার পরিচালনার ক্ষেত্রে কোথাও কোনও অনিয়ম নজরে পড়লেই তাঁরা আন্দোলনে নেমে পড়বেন। তিলকবাবু বলেন, “মোহিতবাবুরা জোট চান না। বিধানসভা নির্বাচনেও কংগ্রেস আমাদের বিরুদ্ধে গোঁজ প্রার্থী দেয়। তার পরেও দলের নির্দেশে আমরা রায়গঞ্জ পুর নির্বাচনে জোট করেছিলাম। কিন্তু কংগ্রেস আমাদের প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা দেয়নি। দলেরই নির্দেশে এ বার থেকে জেলার সমস্ত নির্বাচনে আমরা একা লড়াই করব।” পুরসভার বিরোধী দলের আসনে বসার সিদ্ধান্তে তাঁদের দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সায় রয়েছে বলে দাবি করেছেন তিনি। |
জোট ছেড়ে এ বার থেকে জেলায় একা চলার ব্যাপারে যে দাবি তিলকবাবু করেছেন, তা অবশ্য সমর্থন করেননি তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায়। তাঁর পরিষ্কার বক্তব্য, “এই রকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক্তিয়ারই তিলকবাবুর নেই। এই বিষয়টি রাজ্য নেতৃত্বই ঠিক করেন।” তবে রায়গঞ্জ পুরসভার ক্ষেত্রে কী ঘটেছে, সে ব্যাপারে বিশদ খবর না-নিয়ে সবিস্তার মন্তব্য করতে চাননি মুকুলবাবু। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যও বলেন, “বিষয়টি আমি সবিস্তার জানি না। তবে ইতিমধ্যেই আমি মোহিতকে জানিয়ে দিয়েছি যে, যা কিছু হবে, তা স্থানীয় স্তরেই আলোচনা করে ঠিক করতে হবে।”
রায়গঞ্জের ঘটনায় জেলার রাজনীতিতে অবশ্য চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। রাজ্যে জোট গড়ে ভোটে লড়া হলে প্রচলিত রীতি হল, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন-পাওয়া দলকে ক্ষমতাসীন প্রধান দল ভাইস চেয়ারম্যান কিংবা উপপ্রধানের আসনটি ছাড়বে। বামেদের সমর্থন নিয়ে শিলিগুড়িতে একক ভাবে ক্ষমতা দখল করা নিয়ে বিবাদ মেটার পরে কংগ্রেস ডেপুটি মেয়রের পদটি তৃণমূলকেই ছেড়ে দিয়েছে। উপরন্তু রাজ্যে একক ভাবে ক্ষমতায় আসা তৃণমূলের সঙ্গে এমন ‘বিবাদে’ জড়িয়ে পড়ার পিছনে কংগ্রেসের কোনও রাজনৈতিক কৌশল কাজ করছে কি না, সেই প্রশ্নও উঠছে। এই পরিস্থিতিতে রায়গঞ্জ শহর বামফ্রন্টের আহ্বায়ক নীলকমল সাহার মন্তব্য, “শুরুতেই কংগ্রেস-তৃণমূলের মধ্যে যে গোলমাল শুরু হয়ে গেল, তাতে রায়গঞ্জের উন্নয়ন স্তব্ধ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছি। তৃণমূল বিরোধী আসনে বসলে রাজ্য সরকার রায়গঞ্জ পুর-বোর্ডের উন্নয়নে টাকা দেবে কি না, সন্দেহ!”
মোহিতবাবু অবশ্য তৃণমূলের বিরোধিতার কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, “যখন জোট হয়, তখন চেয়ারম্যান পদ নিয়েই আলোচনা হয়। আমাকেই চেয়ারম্যান হিসাবে তৃণমূল মেনে নেয়। অন্য কোনও পদ নিয়ে আলোচনা হয়নি। তৃণমূল চাইলে তিনটি চেয়ারম্যান-পারিষদের কোনও একটি নিতে পারে।” তিলকবাবু অবশ্য এ দিন পত্রপাঠ ওই প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছেন। তাঁর কড়া মন্তব্য, “আমরা ভিখারি নই! চেয়ারম্যান-পরিষদের পদ আমাদের লাগবে না! আমরা কারও দয়ায় রাজনীতি করি না! আসন সমঝোতার সময়ে আমরা মোহিতবাবুকে চেয়ারম্যান হিসাবে মেনে নিই। জোট ধর্ম মেনেই তো কংগ্রেসের ওই পদটি আমাদের ছেড়ে দেওয়া কর্তব্য ছিল।” প্রসঙ্গত, ২৫ ওয়ার্ডের রায়গঞ্জ পুরসভার কংগ্রেসের ১৭টি, তৃণমূলের ৫টি এবং সিপিএম, সোসালিস্ট পার্টি ও নির্দলের একটি করে আসন রয়েছে। |