|
|
|
|
কমরেডদের চিঠির জবাব দিতে কলম ধরছেন ‘সেনাপতি’ বুদ্ধদেব |
সন্দীপন চক্রবর্তী • কলকাতা |
তাঁর অন্যতম প্রিয় লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ একদা লিখেছিলেন, ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’। বিগত বামফ্রন্ট সরকারের পরাজিত ‘কর্নেল’ কিন্তু চিঠি পাচ্ছেন। লিখছেন দলের কমরেডরাই। আর সেই সব চিঠির মধ্যে এ বার বাছাই-করা কয়েকটির উত্তরও দেবেন ‘কর্নেল’!
বিগত বামফ্রন্ট সরকারের প্রধান সেনাপতি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে এই নতুন দায়িত্ব দিয়েছে তাঁর দল সিপিএম। ভোটে হারার পর থেকেই রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে আলিমুদ্দিনে নানা প্রশ্ন এবং অভিযোগ জানিয়ে দলের কর্মী-সমর্থকদের চিঠি আসছিল। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবু আলিমুদ্দিনে বসেই সে রকম বহু চিঠি পড়েছেন। এর পরে সিপিএম রাজ্য নেতৃত্ব আলোচনা করে ঠিক করেছেন, সেই সব চিঠির মধ্যে থেকে ঝাড়াই-বাছাই করে বিভিন্ন প্রশ্ন বা অভিযোগের উত্তর এ বার থেকে দেবেন বুদ্ধবাবুই। দলের এক পলিটব্যুরো সদস্যের কথায়, “দলের কমরেডদের জিজ্ঞাসার জবাব দেওয়া এ বার থেকে বুদ্ধবাবুর অন্যতম দায়িত্ব। কয়েকটি জেলার দায়িত্বও নতুন করে ওঁকে দেওয়া হচ্ছে। তবে কোন কোন জেলা, সে ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক সিলমোহর বাকি আছে।” |
|
নির্বাচনে বিপর্যয়ের পর থেকে বিভিন্ন অভিমত জানিয়ে দলীয় কমরেডরা সরাসরিই আলিমুদ্দিনে চিঠি পাঠাতে শুরু করেন। সিপিএমের সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় নিচু তলা থেকে উপরের দিক পর্যন্ত বিভিন্ন কমিটির মাধ্যমে এমনিতেই ভোটে হার-সহ নানা বিষয়ে বিশ্লেষণ উঠে আসে। বুদ্ধবাবুর মনে হয়েছে, এই জাতীয় চিঠিও তেমন ভাবেই বাস্তব পরিস্থিতি বুঝতে সাহায্য করবে। রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দলের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটও এ নিয়ে বুদ্ধবাবুর সঙ্গে কথা বলেছেন। রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, “দলের কমরেডদের মধ্যে অনেক সময়েই অনেক বিষয়ে প্রশ্ন থাকে। তার উত্তর না-পেলে সংশয় বা বিভ্রান্তি তৈরি হয়। এমনিতেই দলের নানা স্তরে রাজনৈতিক এবং সাম্প্রতিক সব বিষয়ে সবিস্তার আলোচনার সুযোগ আছে। সেই সঙ্গেই ভেবে দেখা হয়েছে, কমরেডদের সঙ্গে রাজ্য নেতৃত্বের একটা আদানপ্রদানের ব্যবস্থা চালু থাকলে তাতে আখেরে কর্মীদেরই উপকার হবে।”
আলিমুদ্দিনে যে সব চিঠি এখনও পর্যন্ত এসেছে, তার মধ্যে অনেকগুলিই স্থানীয় স্তরে কোনও নেতার বিরুদ্ধে অন্যান্য কর্মীর ক্ষোভ বা অভিযোগ। স্রেফ পারস্পরিক ক্ষোভের বৃত্তান্ত জমা পড়লে তার উত্তর দেওয়া সব সময় প্রয়োজন বলে মনে করছেন না সিপিএম নেতৃত্ব। দলের কোনও সিদ্ধান্ত, অবস্থান বা রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে প্রশ্ন উঠলে বা বিভ্রান্তি তৈরি হলে, তা কাটানোই তাঁদের আসল উদ্দেশ্য। দরকারে কমরেডদের এই ধরনের চিঠি থেকে উঠে-আসা মত ভবিষ্যতে দলীয় রিপোর্ট তৈরির উপাদান হিসেবেও ব্যবহার করা হবে।
তবে চিঠির উত্তর দেওয়ার কাজটা বুদ্ধবাবুর পক্ষে যথেষ্ট ‘স্বস্তিদায়ক’ হবে না! ইতিমধ্যেই আসা বিভিন্ন চিঠির বিষয়বস্তু থেকে তার খানিকটা ইঙ্গিত মিলছে। বেশ কিছু কমরেড প্রশ্ন তুলেছেন, রাজ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্ট জনেদের একটি বড় অংশ বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছেন দেখেও বিষয়টিকে কেন গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হল না? রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের আক্রমণের চেয়েও বিশিষ্টদের সমালোচনা জনমানসে অনেক বেশি প্রভাব ফেলবে, এটা দল কেন বুঝল না? প্রশ্ন উঠেছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে ‘কুৎসিত মন্তব্য’ (খোদ বুদ্ধবাবু যাকে বলেছিলেন ‘ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ’) করার পরেও প্রাক্তন সাংসদ অনিল বসুকে কেন শুধু তিরস্কার করে ছেড়ে দেওয়া হল? আবার এই প্রশ্নও আসছে, নন্দীগ্রাম-পর্বের ‘৯৯% দায়’ ছিল লক্ষ্মণ শেঠের। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল, ভাবমূর্তির সমস্যাও ছিল। তা সত্ত্বেও দল কেন কখনওই তাঁর বিরুদ্ধে এক পা-ও এগোতে পারল না? এই সব জিজ্ঞাসা মেটানো আলিমুদ্দিনের পক্ষেও যে খুব ‘সুখকর’ হবে না, বলাই বাহুল্য! তবু কাজটায় হাত দেবেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী।
ক্ষমতা হারানোর পর থেকে দু’বেলা শুধু বাড়ি থেকে আলিমুদ্দিন যাতায়াত এই দাঁড়িয়েছে বুদ্ধবাবুর রোজনামচা। চিঠি খতিয়ে দেখে ভেবেচিন্তে জবাব দেওয়ার সময় তাঁর হাতে থাকবে। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের কথায়, “উনি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন নিজের ওয়েবসাইটে প্রশ্নের জবাব দেওয়া শুরু হয়েছিল। তখন বেশি প্রশ্নই হত সরকারি কাজ বা প্রশাসন পরিচালনা সংক্রান্ত। এখন অভিমুখটা দলের কাজে থাকবে।”
অতএব আলিমুদ্দিনের দো’তলার ঘরে কফির পেয়ালা হাতে নিয়ে চিঠির জবাব দিতে তৈরি হচ্ছেন প্রেসিডেন্সি কলেজের বাংলা সাহিত্যের এক প্রাক্তন ছাত্র। গত ১০ বছর রাজ্যপাট সামলে এসে দলের ভিতরে-বাইরে বিস্তর ক্ষোভের স্তূপের উপরে বসে নতুন দৃষ্টিতে যাঁকে পৃথিবীকে দেখতে হচ্ছে! এবং ঘটনাচক্রে, যাঁর অন্যতম প্রিয় শখ রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’ থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া! |
|
|
|
|
|