ব্যাগবন্দি শিশুর দেহ পড়শির আলমারিতে |
শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল • রঘুনাথপুর |
তার খোঁজ মিলছিল না বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে। শুক্রবার সকালে পড়শি দম্পতির বাড়ির আলমারিতে একটি ব্যাগের মধ্যে মিলল ছ’বছরের তমালিকা দেওঘরিয়ার দেহ।
এর পরেই অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর শহরের ব্লকডাঙা এলাকা। যার বাড়ি থেকে শিশুটির দেহ পাওয়া যায়, সেই যুবক মলয় ঘোষকে বেধড়ক মারধর করে জনতা। ওই বালিকার দেহ উদ্ধার করতে গিয়ে জনরোষে শিকার হয় পুলিশও। ক্ষুব্ধ এলাকাবাসীর মারে রঘুনাথপুরের এসডিপিও দ্যুতিমান ভট্টাচার্য, ওসি সাধন পাঠক-সহ ৪-৫ জন পুলিশ কর্মী জখম হন। সাধনবাবুকে প্রথমে রঘুনাথপুর মহকুমা হাসপাতাল ও পরে দুর্গাপুরের মিশন হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। |
তমালিকা দেওঘরিয়া |
প্রাথমিক ভাবে পুলিশের অনুমান, শ্বাসরোধ করে অথবা বিষ খাইয়ে তমালিকাকে খুন করা হয়েছে। খুনের উদ্দেশ্য রাত পর্যন্ত পুলিশ বুঝে উঠতে পারেনি। এসডিপিও বলেন, “মৃতদেহে আঘাতের কোনও চিহ্ন নেই। কী ভাবে খুন করা হল, তা ময়নাতদন্তের রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত বলা সম্ভব নয়।” মলয় ও তাঁর স্ত্রী প্রিয়াকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গণপিটুনিতে গুরুতর জখম মলয় সদর হাসপাতালে ভর্তি। ব্লকডাঙা এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকে তমালিকার পরিবার। বাবা মথুর দেওঘরিয়া গানের শিক্ষক। মা মিতালিদেবী অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী। একই চৌহদ্দিতে প্রায় ১৫-২০টি ভাড়া বাড়ি রয়েছে। বেসরকারি বিমা সংস্থার এজেন্ট মলয় দু’টি বাড়ি পরেই থাকে। |
|
স্থানীয় ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের স্কুলের প্রথম শ্রেণির ছাত্রী তমালিকা বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ার পরে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল।
রাত পর্যন্ত তার খোঁজ না মেলায় রঘুনাথপুর থানায় অভিযোগ করা হয়। এলাকায় পুলিশ যায়। দমকলকে আনিয়ে বাড়ির পাশের পুকুরে খোঁজ চালানো হয়। পুলিশ মাইকে প্রচারও করে।
নিহত স্কুলছাত্রীর মাসি মিঠু পাঠক জানান, দুশ্চিন্তায় বৃহস্পতিবার সারা রাত তিনি বাড়ির বাইরেই ছিলেন। এ দিন ভোরে ঘর বন্ধ করে মলয় ও প্রিয়াকে চলে যেতে দেখে তাঁর সন্দেহ হয়। তাঁর চিৎকারে আশপাশের লোক ওই দম্পতিকে আটকায়। স্থানীয়দের দাবি, গাড়িতে করে চুপিচুপি পালানোর ফন্দি এঁটেছিলেন ওই দম্পতি।উত্তেজিত জনতা ওই গাড়িটি ভাঙচুর করে ডোবার মধ্যে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করে। মিঠুদেবীর কথায়, “বৃহস্পতিবার গভীর রাত পর্যন্ত যখন আমরা পাগলের মতো মেয়েটাকে খুঁজছি, তখন মলয় আর প্রিয়াও আমাদের সঙ্গে ছিল। ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি ওদের মতলব!” |
|
জনতার মারে জখম মলয় ঘোষ। |
মিঠুদেবীর দাবি, “চেপে ধরে জেরা করতেই ওরা তমালিকাকে খুনের কথা কবুল করে।” এর পরেই পাড়ার যুবকেরা দরজা ভেঙে মলয়দের ঘরে ঢোকেন। আলমারি ভেঙে একটি ব্যাগ থেকে মেয়েটির দেহ পাওয়া যায়। হাত-পা-হাঁটু মুড়ে জোর করে দেহ ঢোকানো হয়েছিল ওই ব্যাগে। এই দৃশ্য দেখে খেপে ওঠেন এলাকাবাসী। মলয়কে বেধড়ক পিটিয়ে বাড়িতে ভাঙচুর চালান তাঁরা। চড়-থাপ্পড় খান প্রিয়াও। খবর পেয়ে ওসি-র নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনী এসে মলয়কে উদ্ধার করতে গেলে জনতার রাগ গিয়ে পড়ে পুলিশের উপরে।
এ দিন সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ওসি সাধনবাবুকে রাস্তায় ফেলে লাঠি, ইট দিয়ে পেটাচ্ছে উত্তেজিত জনতা। এসডিপিও অতিরিক্ত বাহিনী নিয়ে পৌঁছলে তিনিও আক্রান্ত হন। শাবল বা রড জাতীয় কিছু দিয়ে এসডিপিও-র পেটে আঘাত করা হয়। |
এর পরেই পুলিশ শূন্যে পাঁচ রাউন্ড গুলি চালায়। এলোপাথাড়ি লাঠি চালিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। মৃত বালিকার বাবার সঙ্গে এ দিন যোগাযোগ করা যায়নি। মা মিতালিদেবী ঘনঘন সংজ্ঞা হারাচ্ছিলেন। পুলিশকে মারধরের ঘটনায় এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিছু স্থানীয় যুবকের ক্ষোভ, “পুলিশ এসে রুটিন ঘুরে দেখেছে। কিছুই করেনি। অথচ পাশের বাড়ি থেকেই বাচ্চাটার দেহ পাওয়া গেল। পুলিশ একটু ভাল করে খুঁজলে হয়তো ওকে বাঁচানো যেত। সে জন্যই জনতার রাগ পুলিশের উপরে গিয়ে পড়ে।” |
স্ত্রী প্রিয়া |
|
তাঁদের আরও দাবি, অপহরণ করে তমালিকাকে পাচার করার ছক ছিল ওই দম্পতির। কিন্তু নিখোঁজ হওয়ার কথা জানাজানি হওয়ায় ভয়ে মেয়েটিকে খুন করা হয়।
এ দিন থানায় এসে প্রিয়াকে জেরা করেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সি সুধাকর। এসডিপিও বলেন, “খুনের কারণ স্পষ্ট নয়। ধৃত দম্পতিকে জেরা করা হচ্ছে। মৃতের বাবার সঙ্গেও কথা বলা হয়েছে।” |
নিজস্ব চিত্র |
|