|
|
|
|
|
|
উত্তর কলকাতা
জে বি রায় |
রোগ কাটেনি |
জয়তী রাহা |
দু’বছর যাবৎ বন্ধ প্রসূতি বিভাগ। ধুঁকছে ফার্মেসি। ‘পঞ্চকর্ম’ বিভাগে ম্যাসাজ দেওয়ার কেউ নেই। ওষুধপত্রও ঠিকমতো পাওয়া যায় না। এক জনও ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল অফিসার নেই। জেনারেল সার্জন ও গাইনি সার্জনের অভাব। অভাব স্বাস্থ্যকর্মীরও। মেডিক্যাল কলেজের অবস্থাও তথৈবচ। গবেষণাগার বন্ধ। সব মিলিয়ে জেরবার অবস্থা জে বি রায় স্টেট মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের। আয়ুর্বেদ চর্চা ও আয়ুর্বেদ চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার উদ্দেশ্যে কবিরাজ যামিনীভূষণ রায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন হাসপাতালটির। রাজা দিনেন্দ্র স্ট্রিটের ওপর জে বি রায় স্টেট মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালটি তাঁরই নামাঙ্কিত।
বিংশ শতকের শুরুতে এর প্রতিষ্ঠা হলেও ষাটের দশকে এটিকে অধিগ্রহণ করে সরকার। হাসপাতালটির বর্তমান অবস্থা কী?
১২০ শয্যার হাসপাতালটির এক তলায় রয়েছে বহির্বিভাগ ‘কায় চিকিৎসা পুরুষ,’ ‘কায় চিকিৎসা মহিলা,’ ‘রোগ বিজ্ঞান ও জরা প্রতিষেধক,’ ‘ইমার্জেন্সি’-সহ বেশ কিছু বিভাগ। রয়েছে বিনামূল্যে ওষুধ বিতরণের বিভাগও। দোতলার সম্পূর্ণটাই স্ত্রী রোগ সংক্রান্ত অন্তর্বিভাগ। রয়েছে সুসজ্জিত লেবার রুম। কিন্তু, গত প্রায় দু’বছর ধরে বন্ধ প্রসূতি বিভাগ। এক সময় স্ত্রী রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে সুনাম ছিল হাসপাতালটির। হাসপাতাল কর্মীদের দাবি, প্রসূতি বিভাগ বন্ধ থাকার মূল কারণ, সারাইয়ের কাজ চলছিল। পরবর্তীকালে এই বিভাগ শুরু করা যায়নি জেনারেল সার্জন না থাকার জন্য।” আয়ুর্বেদ চিকিৎসার ক্ষেত্রে ভূমিকা থাকে অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসারও। |
|
অথচ দীর্ঘ দিন ধরে এখানে কোনও অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসক নেই। ফলে এই বিভাগে রোগী ভর্তি বন্ধ।
উপরের তলগুলিতে রয়েছে মহিলা ও পুরুষদের জন্য পৃথক ‘মেডিক্যাল’ ও ‘সার্জিক্যাল’ অন্তর্বিভাগ। রয়েছে বড় ও ছোট অপারেশন থিয়েটার। হাসপাতালটির কর্মীরা জানান, এক সময় গর্ব ছিল ‘রসশালা’ (আয়ুর্বেদিক ফার্মেসি) এবং ‘পঞ্চকর্ম’। ১৭৩ রকম ক্যাপসুল, ট্যাবলেট ও অন্যান্য ওষুধ তৈরি করত ‘রসশালা’। বর্তমানে দক্ষ শ্রমিকের অভাবে ধুঁকছে এই বিভাগ। এখন বড়জোর যে ২৫-৩০ রকমের গুঁড়ো ওষুধ তৈরি হয়, তা-ও প্রয়োজনের তুলনায় কম। হাতে গোনা চতুর্থ শ্রেণির কয়েক জন কর্মী ওষুধ বানানোর
কাজ চালাচ্ছেন।
পারকিনসনস ডিজিজ, আর্থ্রাইটিস-সহ স্নায়ুর বিভিন্ন অসুখের চিকিৎসা হয় ‘পঞ্চকর্ম’ বিভাগে। রোগীকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে ম্যাসাজ দেওয়া হয় এই বিভাগ থেকে।
এর জন্য প্রয়োজন দু’জন বিশেষজ্ঞ, দু’জন ম্যাসাজকর্মী-সহ কিছু চিকিৎসক। কিন্তু এখন এক জন বিশেষজ্ঞই আছেন। কোনও ম্যাসাজকর্মী নেই। ফলে হাউসস্টাফরাই দেখভাল করছেন এই বিভাগ। অভিযোগ উঠেছে, রোগীকে ম্যাসাজের পদ্ধতি দেখিয়ে প্রাথমিক ওষুধ দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে বিপাকে পড়ছেন রোগীরা। যেমন, শ্রীরামপুর থেকে আসা পার্বতী চক্রবর্তীর কথায়: “অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসার জন্য আসছি দু’সপ্তাহ ধরে। ওষুধ এখানে পাই না বলে খুব সমস্যা হচ্ছে।” পুরনো যন্ত্রপাতি, ওষুধের অভাব এবং কর্মীর ঘাটতি যে পঞ্চকর্মের সুনামে বাধা হচ্ছে মানছেন চিকিৎসকদের একাংশ। উপযুক্ত কর্মীর অভাবে একই দশা ‘প্যাথলজি’ বিভাগেও। |
|
হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, চার জন ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল অফিসার থাকার কথা। নেই এক জনও। জেনারেল সার্জন ও গাইনি সার্জনের অভাব। প্রয়োজনের তুলনায় স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা অর্ধেক। ৯৩-এর জায়গায় আছেন ৩২ জন চতুর্থ শ্রেণির কর্মী।
অথচ, এক সময় এই হাসপাতালটি ছিল অনেকেরই ভরসার জায়গা। স্থানীয় বাসিন্দা সুজিত ভৌমিকের কথায়: “হাতের কাছে আরজিকর হাসপাতাল থাকা সত্ত্বেও এলাকার মানুষ কোনও দিন ওখানে যেতেনই না। এত ভাল পরিষেবা পাওয়া যেত জে বি রায় থেকে। সঙ্গে রোগ নিরাময়ের দারুণ ওষুধ। এখন ও সবের পাট চুকে গেছে।”
ছাত্রছাত্রীদের অভিযোগ, বেহাল মেডিক্যাল কলেজও। উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরির আশ্বাস দিয়ে বছর ঘুরে গেলেও বন্ধ রয়েছে গবেষণাগার। প্রায় পনেরো হাজার দুষ্প্রাপ্য বই ও পাণ্ডুলিপিতে ঠাসা গ্রন্থাগারের সংরক্ষণ হচ্ছে না ঠিকমতো। কলেজের ছাত্র সংগঠনের সভাপতি অনুজ অগ্রবাল বলেন, “গ্রন্থাগারিক না থাকায় চতুর্থ শ্রেণির দু’জন কর্মী কাজ চালাচ্ছেন। কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা নিজেরাই এসে বই খুঁজতে হিমসিম খেয়ে যান। তাই লাইব্রেরিতে বসে পড়ার আগ্রহটাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বেশির ভাগের।”
কলেজ ও হাসপাতালের পরিকাঠামো প্রতি বছর পরিদর্শন করতে আসে সেন্ট্রাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ান মেডিসিন (সিসিআইএম)। পরিকাঠামোয় সন্তুষ্ট হলে তবেই স্বীকৃতি (অ্যাফিলিয়েশন) মেলে কলেজের। অনুজবাবুর অভিযোগ, সিসিআইএম-এর স্বীকৃতি পেতে গত দু’বছর যথেষ্ট বেগ পেয়েছে কলেজ। পরিকাঠামোগত অসন্তোষের কারণে গত বার নির্দিষ্ট সময়ের মাসখানেক বাদে তা পাওয়া গিয়েছিল। এ বারে এখনও স্বীকৃতি আসেনি। |
|
রোগী কল্যাণ সমিতির প্রধান এবং স্থানীয় ১২ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর স্মরজিৎ ভট্টাচার্য বলছেন, “হাসপাতাল সংক্রান্ত বিস্তর অভিযোগ রয়েছে মানুষের। গত ন’-দশ বছরে ধীরে ধীরে কার্যত শেষ করা হয়েছে হাসপাতালটিকে। হাসপাতালে কোনও মর্গ নেই। রীতিমতো আবর্জনার আস্তাঁকুড় হয়েছিল। মাস দেড়েক আগে আমরা সে সব পরিষ্কার করিয়েছি। হাসপাতাল ও কলেজ নিয়ে সুপার ও প্রিন্সিপালের সঙ্গে এক মাস আগে আমাদের বড় বৈঠক হয়েছে। কোনও পরিবর্তন হয়নি। তবে চেষ্টা চালিয়ে যাব এর উন্নতির জন্য।”
যদিও পরিচালন সংক্রান্ত ত্রুটির যাবতীয় অভিযোগ নস্যাৎ করছেন হাসপাতাল ও কলেজের ভারপ্রাপ্ত সুপার ও অধ্যক্ষ সঞ্জীব সামন্ত। তিনি বলেন, “হাসপাতাল ও কলেজ কর্মীর অপ্রতুলতার বিষয়ে বার বার স্বাস্থ্যভবনে লিখিত ভাবে জানিয়েছি। কিন্তু কোনও সদুত্তর মেলেনি।” ওষুধ তৈরির ঘাটতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “স্বাস্থ্য দফতর টেন্ডার না ডাকায় গত এক বছর যাবৎ ওষুধ তৈরির কাঁচামাল কিনতে সমস্যা হচ্ছে।” তবে, সিসিআইএম সংক্রান্ত জটিলতার প্রশ্নে সুপার ও অধ্যক্ষ কোনও উত্তর দিতে রাজি হননি।
ওষুধ তৈরির ঘাটতি প্রসঙ্গে ডিজি (আয়ুষ) রাকেশকুমার ভাট বলেন, “ভারত সরকারের একটি সংস্থার মাধ্যমে বর্তমানে ওষুধ কেনা হয়। তাই আগের মতো সে ভাবে ওষুধ তৈরি হয় না। ওষুধ তৈরির জন্য সম্প্রতি কিছু উন্নত যন্ত্রপাতি বসানো হয়েছে হাসপাতালে। কর্মী নিয়োগ করা গেলে পুরোদমে শুরু হবে সেই কাজ।” হাসপাতালের চিকিৎসক, প্রফেসর, নার্স, চতুর্থ শ্রেণির কর্মী এবং টেকনিক্যাল কর্মীর অভাব প্রসঙ্গে তাঁর দাবি, “আগের রাজ্য সরকারকে এ বিষয়ে জানানো হয়েছিল। যেহেতু সরকারি স্তরে পিএসসি-র মাধ্যমে নিয়োগ সম্ভব, তাই এ ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই। বর্তমান সরকার পিএসসি-র বদলে রিক্রুটমেন্ট বোর্ড গঠনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এতে নিয়োগ পদ্ধতি আগের থেকে দ্রুত হবে বলে আশা করি। তা হলেই একমাত্র হাসপাতাল ও কলেজের যাবতীয় সমস্যার সমাধান সম্ভব।” সিসিআইএম-এর স্বীকৃতি প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য: “এ জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষ বা ছাত্রছাত্রীদের কোনও সমস্যা হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে না।” |
|
|
|
|
|