|
ব্যাগ গুছিয়ে... |
রাবণের লঙ্কার সন্ধানে
এক দিকে সম্রাট অশোকের শান্তির বাণী, অন্য দিকে, রাম-রাবণের
যুদ্ধ মনে করিয়ে দেয় এই দ্বীপরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের প্রাচীন সম্পর্কের
থা। ঘুরে এসে লিখছেন অশোক সেনগুপ্ত |
|
পাহাড়ের বুক চিরে এঁকেবেঁকে এগিয়ে গিয়েছে রাস্তা। এ রাস্তা শ্রীলঙ্কার। এখানে রামায়ণের সেই পরশ পেতে আমরা একটি মন্দিরে নামলাম। পাহাড় আর রাস্তার মাঝে বেশ কিছুটা পাথর। সেখানেই তৈরি হয়েছে মন্দির অর্থাৎ ‘সীতা আম্মা’। সেই বন আজ না থাকলেও, মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ঝর্না। সীতাকে অশোকবনে রাবণের আটকে রাখার কথা যুগ যুগ ধরে আমরা পড়েছি। ‘সীতা আম্মায়’ যাওয়া পর্যটকেরা মানসচক্ষে দেখেন আর ভাবেন এই বুঝি সেই ঝর্না, যেখানে বসে চোখের জল ফেলতেন সীতা। মন্দিরে পাথরে আঁকা রামায়ণের নানা দৃশ্য। |
|
শুধুই কি সেই অশোকবন? শ্রীলঙ্কার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সম্রাট অশোকের নানা স্মৃতিও। এর অন্যতম প্রধান নিদর্শন কেলানিয়ায়। শ্রীলঙ্কা সফরের প্রথম দিনেই গিয়েছিলাম এখানকার ধর্মস্থানে। কলম্বো থেকে দূরত্ব মাত্র আট কিলোমিটার। রাস্তার ধার থেকে কিছুটা উপরে। পায়ে হেঁটে পথটুকু যেতে হল। সংস্কৃত ‘কল্যাণী’ থেকে এসেছে কেলানিয়া কথাটা। মূল বৌদ্ধমন্দিরের চার পাশে সাদা রঙের চারটি ‘বিহার’। মহীরূহ থেকে যে কত ঝুরি নেমে গিয়েছে তার
ইয়ত্তা নেই।
অশোককন্যা সঙ্ঘমিত্রা ভারত থেকে পবিত্র চারা নিয়ে গিয়ে প্রাচীন রাজধানী অনুরাধাপুরমে সেটি বপন করেন। তার একটি চারা পোঁতা হয় কেলানিয়ায়। কলিঙ্গ যুদ্ধের পরে অশোক বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নেন। তৃতীয় শতকে তিনি ঠিক করলেন ধর্মপ্রচারের জন্য ছেলে মহেন্দ্রকে সিংহলে পাঠাবেন। মেয়ে সঙ্ঘমিত্রা বায়না ধরলেন তিনিও যাবেন। অশোক ও তাঁর স্ত্রী দেবী মেয়েকে পাঠাতে রাজি নন। তবুও সঙ্ঘমিত্রাও নাছোড়বান্দা। শেষ পর্যন্ত তাঁর ইচ্ছের কাছে হার মানতে হল বাবা-মাকে। মেয়ের সঙ্গে সিংহল গেল বিশ্বস্ত একদল পরিচারিকা। |
|
এই দ্বীপরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘ দিনের অম্লমধুর সম্পর্ক। শ্রীলঙ্কায় তার বেশ কিছু নজির দেখলাম। যেমন সিগারিয়ার দুর্গ। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে রাজা ভালাগাম্বোর কুর্সি কেড়ে নেয় দক্ষিণ ভারতের হানাদারেরা। প্রাণ বাঁচাতে সে যাত্রায় রাজা পালালেও ১৪ বছর বাদে ফের দখল করেন তাঁর হারানো সিংহাসন। পঞ্চম শতকে লঙ্কারাজকে হত্যা করে তাঁর পুত্র কাশ্যপ ক্ষমতা দখল করেন। প্রতিশোধ নিতে চান কাশ্যপের সৎভাই। সিগারিয়ায় দুর্ভেদ্য দুর্গ তৈরি করে ১৯ বছর সেখানকার রাজত্ব চালান কাশ্যপ। সৎভাই ভারতীয় যোদ্ধাদের সাহায্য নেন। ওই যুদ্ধে কাশ্যপ খুন হন। |
|
সফরের দ্বিতীয় দিনে সাতসকালে আমরা গেলাম সিগারিয়ায়। জানলাম, সিংহ আর গিরি এই দু’টি কথা মিলে হয়েছে সিগারিয়া। শ্রীলঙ্কার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ অধুনালুপ্ত এই প্রাচীন নগরী। পঞ্চম শতকে ১৬ হাজার শ্রমিক তৈরি করেন এই নগরী। এক সময়ে কলেরার প্রাদুর্ভাবে আবাসিকরা এখান থেকে চলে যান। ঊনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে জঙ্গলাকীর্ণ এই পরিত্যক্ত নগরীর হদিশ পান ব্রিটিশ সেনারা। তৃতীয় দিন ক্যান্ডি যাওয়ার পথে আমরা গেলাম ডামবুলা। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে দক্ষিণ ভারতীয় শাসকরা লঙ্কায় হানা দেন। রাজা ভালগাম্বা রাজধানী অনুরাধাপুরম থেকে ডামবুলার নির্জন পাহাড়ের গুহায় পালিয়ে আসেন। ১৪ বছর বাদে তিনি সিংহাসন ফিরে পান। দুর্গম গুহাটি তিনি উপহার দেন বৌদ্ধ ভিক্ষুদের। পরবর্তী কালে এর পাদদেশে রাজা নিশানকমল তৈরি করেন কয়েকটি সুন্দর স্বর্ণমন্দির। এখানে দেখলাম ১০০ ফুট উঁচু বুদ্ধমূর্তি। মূর্তিটি ১৯৯৭ সাল থেকে তিন বছর ধরে তৈরি হয়। সুন্দর প্রমাণ আকারের মডেলের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে সারিবদ্ধ ভক্তরা ভগবানকে শ্রদ্ধা জানাতে যাচ্ছেন। |
|
এক দিকে সম্রাট অশোকের শান্তির বাণী, অন্য দিকে, রাম-রাবণের যুদ্ধ মনে করিয়ে দেয় এই দ্বীপরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের প্রাচীন সম্পর্কের কথা। সিগারিয়া, ডামবুলার প্রাচীন সাম্রাজ্যের ধবংসাবশেষ দেখতে দেখতেও মনে পড়বে এ রকম নানা কাহিনি। ‘লিটল ইংল্যান্ড’ বলে পরিচিত নূয়ারা এলিয়ার শোভা, সেখানকার চা-বাগান, নগোম্বোয় ছবির মতো সৈকত আর ধীবরগ্রাম, পিনাওয়ালায় হাতির অনাথ-আশ্রম, শৈলশহর ক্যান্ডি এ সবও দেখার সুযোগ পাবেন শ্রীলঙ্কা সফরে।
|
কী ভাবে যাবেন |
কলকাতা থেকে সরাসরি বিমান না থাকলেও চেন্নাই থেকে বিভিন্ন সময়ে চারটি সংস্থার উড়ান-পরিষেবা
আছে। কলম্বো যেতে সময় লাগে ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট। ২০১১-র ১৫ জুন তুতিকোরিন থেকে কলম্বোর
ক্রুজ চালু হয়েছে। এ দেশ থেকে সেটি ছাড়ে বুধ আর শুক্র সন্ধ্যা ছ’টায়। সময় লাগে ১৪ ঘণ্টা। |
|
কোথায় থাকবেন |
পাঁচতারা হোটেল থেকে সুলভে থাকার জায়গা সবই মিলবে কলম্বোয়। |
|
|
|