|
|
|
|
সম্পাদকীয় ১... |
পরীক্ষা রাজনীতির |
আন্না হাজারে এবং তাঁহার অনুগামীরা নিশ্চয়ই যারপরনাই উৎসাহিত। জাতীয় স্তরে যে লোকপাল প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁহারা তৎপর, রাজ্য স্তরে তাহারই অনুরূপ প্রতিষ্ঠান লোকায়ুক্ত আপাতত কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী এবং রাজ্য সরকার এবং শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টিকে মহা বিপাকে ফেলিয়াছেন। কর্নাটকের লোকায়ুক্ত সন্তোষ হেগড়ে ২০০৯ সালে এক বার অবৈধ খনির অনুমতি দানের প্রশ্নে কর্নাটক সরকারের বিরুদ্ধে কড়া রিপোর্ট দিয়াছিলেন। এ বার আবার দুর্নীতির অভিযোগ, এবং আরও বড় মাপের দুর্নীতি। লোকায়ুক্ত তাঁহার রিপোর্ট এখনও আনুষ্ঠানিক ভাবে দাখিল করেন নাই, কিন্তু তাহার বিবরণ সংবাদমাধ্যমে ‘ফাঁস’ হইয়া গিয়াছে এবং তিনি সেই বিবরণের সত্যতা অস্বীকার করেন নাই। লক্ষণীয়, দুর্নীতির অভিযোগ কেবল মুখ্যমন্ত্রী বি এস ইয়েদুরাপ্পার বিরুদ্ধে নহে। লোকায়ুক্ত বল্লারীতে আকরিক লোহার অবৈধ খনিগুলিকে অনুমোদন দেওয়া এবং সেই খনির লোহা বেআইনি ভাবে রফতানির ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী সহ রাজ্য মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য এবং শত শত অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগের তর্জনী নির্দিষ্ট করিয়াছেন। লোকায়ুক্ত বলিয়াছেন, বল্লারীর খনিতে কার্যত ‘মাফিয়া’ রাজ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, ‘প্রতিটি কর্মকর্তা’ তাহাতে জড়িত। তাঁহার রিপোর্টে অভিযুক্ত হইয়াছেন ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁহাদের সরকারও। তাঁহার তীব্র ভাষায় কর্নাটকে যাঁহারাই ক্ষমতায় আসিয়াছেন, (সরকারি) সম্পদের ভাণ্ডারে থাবা বসাইতে চাহিয়াছেন। স্পষ্টতই অভিযোগ কেবল এক জন ব্যক্তি বা একটি সরকারের বিরুদ্ধে নয়, অভিযোগ একটি রাজ্যের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলটির বিরুদ্ধে, রাজবৃত্ত যাঁহারা পরিচালনা করিতেছেন তাঁহাদের বিরুদ্ধে। এবং সেই সর্বগ্রাসী দুরাচার এক দিনের ব্যাপার নয়, তাহা দীর্ঘ কাল ধরিয়া শাখাপ্রশাখা বিস্তার করিয়াছে। সন্তোষ হেগড়ে যে ভাবে তীব্র মন্তব করিয়াছেন তাহা তাঁহার পদের সহিত মানানসই নহে। লোকপাল বা লোকায়ুক্তের মতো প্রতিষ্ঠান আদৌ কেন আবশ্যক, কেন মূলধারার বিচারব্যবস্থার মাধ্যমেই এই ধরনের দুরাচারের তথ্য উন্মোচন এবং অপরীধীদের শাস্তিবিধান করা যাইবে না, সেই প্রশ্নও উঠিবেই। কিন্তু আপাতত আরও বড় প্রশ্ন, এমন ব্যাপক এবং গভীর দুর্নীতির মোকাবিলা করিতে ভারতীয় রাজনীতি এবং প্রশাসন কত দূর তৎপর হইবে?
সংশয় গভীর। কর্নাটকের ক্ষেত্রেও সেই পরিচিত পরম্পরা দেখা গিয়াছে। সরকার তথা ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে বিরোধীরা মুখর হইয়াছেন। ক্ষমতাসীন দল আত্মপক্ষ সমর্থনে নানা যুক্তি এবং কুযুক্তি খাড়া করিতেছে। মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁহার মন্ত্রিসভার নৈতিক দায়িত্ব লইয়া কোনও প্রশ্ন থাকিতে পারে না। লোকায়ুক্তের রিপোর্টে বড় রকমের অভিযোগ থাকিলে সেই অভিযোগের যথাযথ তদন্তের স্বার্থে এবং নৈতিকতার দাবিতেও মুখ্যমন্ত্রী এবং অভিযুক্ত মন্ত্রীদের পদত্যাগ করাই বিধেয়। তাঁহার দলের প্রবীণ নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণী জৈন ডায়ারি সংক্রান্ত মামলায় অভিযুক্ত হইয়া তাহাই করিয়াছিলেন। দুর্ভাগ্য ভারতের, সেই দৃষ্টান্ত বিরল দৃষ্টান্তই থাকিয়া গিয়াছে। কিন্তু কর্নাটকের ক্ষেত্রে কেবল মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ যথেষ্ট হইবে না। বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল যদি অনাচারের শরিক হইয়া থাকে, তাহা হইলে নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করা আরও কঠিন হইতে বাধ্য। তাহার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন বিভিন্ন প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের সমবেত সদিচ্ছা এবং দৃঢ়তা। বিজেপির দুর্নীতি বনাম কংগ্রেসের দুর্নীতির তুল্যমূল্য বিচার এবং পারস্পরিক অভিযোগ-প্রত্যভিযোগের দুষ্টচক্র পরিত্যাগ করিয়া রাজনৈতিক নেতারা যদি প্রশাসনিক দুর্নীতি দূর করিবার একটি যথার্থ উদ্যোগ করেন, তাহা হইলে গণতন্ত্র জোরদার হইবে, রাজনীতিকদের মর্যাদাও বাড়িবে। যদি তাঁহারা ব্যর্থ হন, তবে, মনে রাখিবেন মঞ্চের ধারে আন্না হাজারে অপেক্ষমাণ, স্বাধীনতা দিবসে তাঁহার আন্দোলনের নবপর্ব জমিয়া উঠিলে কেবল প্রধানমন্ত্রীর লালকেল্লার বক্তৃতা ম্লান হইয়া যাইবে না, ভারতীয় রাজনীতিকরা সামগ্রিক ভাবেই আরও নিষ্প্রভ হইবেন। |
|
|
|
|
|