|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
ফুটে ওঠে শিল্পীর অসামান্য কল্পনাশক্তি |
সম্প্রতি আকৃতি গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হল অখিলচন্দ্র দাসের একক প্রদর্শনী। দেখে এলেন মৃণাল ঘোষ |
আকৃতি গ্যালারিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত অখিলচন্দ্র দাসের ভাস্কর্য প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘প্রজেকশন অব ডিজজয়েন্টেড টাইমস’। কিন্তু কোনও অসংবদ্ধ সময়ের প্রত্যক্ষ বর্ণনা তাঁর এই কাজগুলোতে নেই। এই অবয়বী রচনায় এক বা একাধিক প্রতিমাকল্পের সমন্বয়ে শিল্পী কিছু প্রতীক তৈরি করেছেন যা এই সংকটাপন্ন সময়ের অন্তর্লীন শূন্যতাকে আভাসিত করে। এই প্রতীক গড়ে উঠেছে প্রতিমাকল্পের বিশেষ উপস্থাপনায়। উপস্থাপনার অনন্য অভিনবত্বই এই কাজগুলোকে নির্দিষ্ট সময়ের গতি থেকে বের করে এনে চিরন্তন মূল্যবোধে সম্পৃক্ত করে। কল্পরূপ থেকে নিষ্কাশিত এই প্রতিমাকল্পে কখনও বাস্তবকে রূপান্তরিত করে, কখনও পুরাণকল্পের আভাস এনে শিল্পী যে ভাবে বাস্তব ও পরাবাস্তবের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় প্রতিমাকল্পকে প্রতীকী-ব্যঞ্জনায় আভাসিত করে তোলেন, তাতেই তাঁর অনন্য নান্দনিক বোধের পরিচয় থাকে। শিরোনামও দিয়েছেন ‘ফ্যানটাসমেগোরিয়া’। কল্পরূপাত্মক অভিব্যক্তিই এই রচনাগুলির বৈশিষ্ট্য। এই কল্পরূপই গভীর ব্যঞ্জনা এনেছে। |
|
শিল্পী: অখিলচন্দ্র দাস |
প্রায় সব কাজেই তিনি ব্যবহার করেছেন দু’টি মাধ্যম ব্রোঞ্জ ও কাঠ। যেমন ‘ফ্যানটাসমেগোরিয়া ২১’ রচনাটি একটি ধাবমান ষাঁড়ের রূপায়ণ। ষাঁড়ের শরীরটি ব্রোঞ্জের ঢালাই-এ তৈরি। সিন্ধু সভ্যতার যুগ থেকে এই ষাঁড় ভারতীয় ভাস্কর্যে খুবই পরিচিত। এর ভিতর পুরাণকল্পেরও কিছু ব্যঞ্জনা থাকে। সবুজ আলো-ছায়ার বিচ্ছুরণ পশুটির গতিভঙ্গিতে বিশেষ এক মাত্রা আনে। বর্ণের এক বিপরীত আবহ তৈরি করেন শিল্পী নীচে ও ওপরে কাঠের ছায়াচ্ছন্ন বাদামির বিশেষ বুনোটে। যে ভূমির উপর পশুটি দাঁড়িয়ে আছে সেটি কাঠের তৈরি। পশুটির পিঠের উপর যে আচ্ছাদন সেটিও কাঠের চাদরের বিন্যাসে করা। রচনাটির সমগ্র অভিব্যক্তিতে কিছু বৈশিষ্ট্য এনেছে যা এই দৃপ্ত, প্রতিবাদী গতিভঙ্গিকে পূর্বতন বিভিন্ন প্রকাশভঙ্গি থেকে স্বতন্ত্র এক অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে। ‘ফ্যানটাসমেগোরিয়া-২৪’ একটি উড়ন্ত বৃহদাকার পাখির পতনের দৃশ্য। এই পতন মানবিক অস্তিত্ব বা অভিলাষের পতনের স্মারক হয়ে উঠতে পারে। এই দু’টি কাজকে বলা যেতে পারে একক প্রতিমাকল্পে বিধৃত এই প্রদর্শনীর অন্যতম সহজ রচনা। এর ভিতর দিয়েই তাঁর কাজের মূলগত বৈশিষ্ট্যকে বোঝা যায় সহজে।
অখিল ১৯৯০-এর দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত প্রতিভাবান তরুণ ভাস্করদের অন্যতম। ১৯৮০-র দশক পর্যন্ত আমাদের ভাস্কর্যে রূপবিন্যাসের যে ধরন চলে আসছিল নব্বইয়ের দশকে এসে সেই ধারায় বিপুল পরিবর্তন হয়। অখিলের কাজে এই দুই ধারার সংযোগ রয়েছে।
অন্যতম দৃষ্টান্ত বৃহদাকার মাছ নিয়ে করা রচনাটি। মাছের শরীর কাঠ দিয়ে তৈরি। লেজ ও পাখনা ব্রোঞ্জের। মাছের মাথাটি কেটে ফেলা হয়েছে। শরীর থেকে তা বিচ্ছিন্ন। মাঝখানে রয়েছে শূন্য পরিসর। তার দু’ পাশে দু’ জন মানুষ। এই প্রতীক অনেক কথা বলে। এ রকম একটি প্রতিমাকল্প নির্মাণ শিল্পীর অসামান্য কল্পনা-ঋদ্ধতার পরিচায়ক। আবিশ্ব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদীচেতনা পরিস্ফূট হয়েছে অনেকগুলো কাজেই। কাঠের ডিম্বাকৃতি প্ল্যাটফর্মের উপর স্থাপিত ব্রোঞ্জে তৈরি বৃহদাকার একটি ডিম্বাকৃতি গোলক। সেই গোলকের উপর অবস্থান করছে বন্দুক উঁচিয়ে এক জন মানুষ। আর একটি রচনায় কাঠে তৈরি ভূমির উপরে বসে আছে সন্তপ্রতিম এক জন ব্রোঞ্জে গড়া মানুষ। তার দু’ হাত উপরে তোলা। তাতে ধরা রয়েছে কাঠে তৈরি মেঘের মতো ছড়ানো একটি চাদর। তার উপরে বিভিন্ন দিকে বন্দুক উঁচিয়ে রয়েছে অজস্র মানুষ। বসে থাকা মানুষটির উপস্থাপনায় প্রচ্ছন্ন এক আধ্যাত্মিকতার আবরণ আছে। তারই উপর হিংসার মেঘ। এ রকম দ্বন্দ্বাত্মক উপস্থাপনাতেই শিল্পী এই সময়কে ধরতে চান। একটি শীর্ণ, দীর্ঘ মানুষ কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে একটি হিংস্র বাঘ। আপাত শান্ত একটি বাঘ দাঁড়িয়ে আছে। তার পিঠের উপর হেঁটে যাচ্ছে তিনটি ব্যাঘ্রশাবক। এ রকম প্রতিমাকল্পে সন্ত্রাস উঠে আসে। অবয়বী, অনেক সময় আখ্যানমূলক প্রতিমাকল্পে ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিক বিশ্ববীক্ষাকে মিলিয়ে দেন শিল্পী--তাতেই তাঁর কৃত্বিত্ব। |
|