|
|
|
|
ঝোপ থেকে ছিটকে এল হলুদ ‘বিদ্যুতের গোলা’ |
কাঞ্চন বন্দ্যোপাধ্যায় |
প্রায় সাড়ে ন’টা বাজে। অফিসে বেরোব বলে জুতোর ফিতে বাঁধছি, ফোনটা বেজে উঠল। একটু বিরক্ত হয়েই রিসিভারটা তুলেছিলাম। ওপাশে ভক্তিনগর থানার বড়বাবুর উত্তেজিত গলা। প্রথমে ভেবেছিলাম গুলমা থেকে হাতির পাল সাত সকালেই নেমে পড়েছে লিম্বু বস্তিতে। কিন্তু দ্রুত বলে যাওয়া তাঁর কথায় হাতি তো নয়, লেপার্ড শুনলাম যেন! পাল্টা ফোন করি থানায়। বড়বাবুর গলায় এ বার রীতিমতো আতঙ্ক‘আরে মশাই, লিম্বু বস্তিতে লেপার্ড ঢুকে পড়েছে। এর মধ্যেই তিন জন গুরুতর জখম। বাঘটা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, শিগগির আসুন।’
আর দেরি করিনি। সুকনা এলিফ্যান্ট স্কোয়াডে আমার অফিস থেকে দু’টো ডার্ট গান আর সিরিঞ্জ নিয়ে বারান্দায় বেরিয়েই মনোজকে (থাপা) হাঁক পাড়ি, ‘গাড়ি রেডি কর। লিম্বু বস্তিতে লেপার্ড!’ বাকিটা আর বলতে হয়নি। মিনিট তিনেকের মধ্যেই সন্তোষ, ধনীরাম, মনোজ ডবল ব্যারেল বন্দুক নিয়ে হাজির। এক ছুটে পিক-আপ ভ্যানে উঠেই দেখি গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বসে আছে ওরা। স্কোয়াডের এটাই নিয়ম। আমার গলার স্বরেই ওরা আঁচ করে নেয় ঘটনার গুরুত্ব। পিছনে না তাকিয়েই ওদের জানিয়ে দিই, ‘সবাই লাইফ জ্যাকেট পরে নাও, হেলমেট-ও। লেপার্ড ঠিক কতটা ভয়ঙ্কর তা তোমাদের নতুন করে বলার কিছু নেই। বেস্ট অফ লাক।’
|
বাঘে-মানুষে... |
|
শিলিগুড়ির লিম্বু বস্তিতে ঢুকে পড়েছিল চিতাবাঘটি। সেখানে তার খোঁজে যাওয়া এক বনকর্মীর উপরে
আচমকাই ঝাঁপিয়ে পড়ে সে। একে একে তার থাবায় ক্ষতবিক্ষত হন আট জন। মঙ্গলবার শেষ
বিকেলে বন দফতরের জালে ধরা পড়লেও আহত চিতাবাঘটি বাঁচেনি । -নিজস্ব চিত্র |
|
|
|
|
|
শালুগাড়ার পৌঁছতে দু-দুটো যান জট যে বাঁধা, জানতাম। ধনীরামকে তাই হুটার বাজাতে বলে দিয়েছিলাম। আধ ঘন্টার মধ্যে লিম্বু বস্তির রাস্তায় উঠেই বুঝতে পারলাম জনতা ফুটছে। গাড়ি থেকে নামতেই দেখি ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভক্তিনগরের পুলিশ। আর বৈকুণ্ঠপুরের ডিএফও ধর্মদেব রাই। তবে জনতা তাদের উপেক্ষা করেই সমস্বরে জানিয়ে দেয়, ‘ওতাই লেপার্ড ছ (ওখানেই লেপার্ডটা রয়েছে)!’ প্রায় দশ কাঠা পাঁচিল ঘেরা জমি। ফুট ছয়েক উঁচু পাঁচিল উজিয়ে মাথা তুলে কলার ঝাড়, জিগাই-এর ঝোপ আর বুনো ঘাস-ফার্ন। সব মিলিয়ে লেপার্ডের নিশ্চিন্ত আশ্রয়। এক লাফে আমরা ছ-জন পাঁচিলে উঠে পড়ি। কিন্তু নিচে তাকিয়ে চক্ষু চড়ক গাছ এই ঘন জঙ্গলের মধ্যে লেপার্ড খুঁজব কী করে!
মিনিট পঁচিশ কেটে যায়। ঝোপ লক্ষ করে দু-একটা ইটের টুকরো ফেলতে শুরু করি। আর, আচমকাই আমাদের চমকে দিয়ে আশশ্যাওড়ার একটা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসে সে। হলুদ-বিদ্যুতের মতো এক লাফে উঠে আসে পাঁচিলে। আর কী আশ্চর্য, সামনেই পেয়ে যায় বৈকুন্ঠপুরের এক বনকর্মীকে। অতি উৎসাহে যে কিছুক্ষণ আগে লাইফ জ্যাকেট না পরেই উঠে এসেছিল পাঁচিলে।
তাকে নিয়েই চিতাবাঘটি পড়ে পাশের নয়ানজুলিতে। চিৎকার করে সন্তোষকে বলি ঘুমপাড়ানি গুলি ছুঁড়তে।
এক লহমায় বাঘের বয়স, ওজন বুঝে নিয়ে গুলির ‘ডোজ’ ঠিক করতে হয়। হেরফের হলে বাঘটির মৃত্যুও হতে পারে। কিন্তু সন্তোষ গুলি ছোঁড়ার আগেই বাঘ এ বার আক্রমণ করে তাকেই। পাশেই ছিলাম আমি।
ছিটকে পড়ি। আতঙ্কিত মনোজ এ বার তার ডবল ব্যারেল থেকে গুলি চালায়। গুলির শব্দে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পাঁচিল টপকে লেপার্ড ফের হারিয়ে যায় পাঁচিলের ওপারে ফার্নের ঝোপে। |
|
চিতাবাঘের হানায় জখমদের চিকিৎসা চলছে শিলিগুড়ির একটি নার্সিংহোমে। ছবিটি তুলেছেন সন্দীপ পাল। |
তাড়াতাড়ি পুলিশের গাড়িতে তুলে আহত বনকর্মীদের হাসপাতালে পাঠিয়ে দিই। আর তারপরেই শুরু হয় আমাদের দ্বিতীয় দফার ‘অপারেশন লিম্বু-বস্তি।’ সময় পেরিয়ে যায়। ভিড় বাড়তে থাকে। শ্যাওলা ধরা পাঁচিলের উপরে চলতে থাকে আমাদের টহলদারি। কিন্তু তার দেখা নেই। আচমকা ঘড়ির দিকে চোখ পড়ে কখন বেলা গড়িয়ে দুপুর আড়াইটা। খেয়ালই নেই। এক বনকর্মী চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘স্যার ফায়ার করুন!’ তাকিয়ে দেখি জিগাই-এর ঝোপ থেকে উঁকি মারছে সে। কিন্তু ঘুম পাড়ানি গুলি ছোঁড়ার আগেই হারিয়ে যায়। এ ভাবেই চলতে থাকে লুকোচুরি। বেশ কয়েক বার। আলো কমতে থাকে। বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ জনতা রীতিমতো তেতে ওঠে। এক মহিলা চেঁচিয়ে বলেন, ‘লেপার্ড চাই লিয়েরে জানু পছ (লেপার্ড তোমাদের নিয়ে যেতে হবে)!’ বাধ্য হয়ে টায়ার আর ন্যাকড়ায় আগুন ধরিয়ে আমরা ঝোপের মধ্যে ফেলতে থাকি। আর তাতেই কাজ হয়।
হঠাৎ-ই প্রায় পনেরো ফুট লাফ দিয়ে চিতাটা গিয়ে পড়ে আমার পিকআপ ভ্যানের উপরে। দুই বনকর্মীকে নিয়ে সটান সে পড়ে মাটিতে। এক পুলিশ কর্মী গুলি ছুঁড়তে গেলে তাকে আঁচড়ে দেয় সে। আর তখনই তার উপরে মনোজ ছুঁড়ে দেয় জালটা। জালবন্দি চিতাবাঘের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে জনতাও। কোনওক্রমে বাঘটিকে খাঁচায় টেনে হিঁচড়ে তুলে ফেলি। গন্তব্য সোজা সুকনা। এর মধ্যেই খবর পাই, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব বনকর্মীদের খোঁজ নিয়েছেন।
কিন্তু ফিরে এসে জাল খুলতেই মনটা ভেঙে গেল। সারাদিনের ধকলে দম আটকে নিথর হয়ে গিয়েছে সেই চিতাবাঘ।
|
প্রতিবেদক সুকনা স্কোয়াডের রেঞ্জ অফিসার |
|
|
|
|
|