|
|
|
|
|
|
সূর্য ডোবার পালা... |
মায়াবী সন্ধ্যায় হঠাৎ মনে হতেই পারে এই বুঝি ‘অন্য রকম’
কোনও অভিজ্ঞতা হবে। বুক দুরুদুরু, সঙ্গে মুগ্ধতা। ঘুরে এলেন সুচন্দ্রা ঘটক |
ভেসে আসছে অচেনা সাঁওতালি গানের সুর। বাঁশি বাজছে দূরে কোথাও। টেন্টের নীল পর্দাটা সরালেই হাতছানি দিয়ে ডাকছে মহুয়া গাছের পিছনে লুকিয়ে থাকা কুসুমরঙা ডুবন্ত সূর্য। তার পিছু নিয়েই পৌঁছনো যাবে ওই সবুজ পাহাড়ে। দেখা যাবে সন্ধে নামার পালা।
আর একটু পরেই জঙ্গলের আকাশ আস্তে আস্তে হবে কমলা থেকে বেগুনি। তার পরে ঘন কালো। এক এক করে ফুটে উঠবে ক্ষীণ, উজ্জ্বল, আরও উজ্জ্বল তারারা। রাতের জঙ্গলে রাস্তা খুঁজে নিতে হবে শুধু সে সব তারারই ভরসায়।
রূপকথা নয়। শহর ছেড়ে বেরোলে মাত্র কয়েক ঘণ্টার পথ। মুরগুমা।
কিছুক্ষণ পরে বাঁশির আওয়াজ আর একটু স্পষ্ট হবে। সুরের ঘোর ভাঙবে মাঝেমাঝে ঘুঙুরের ছমছম, মাদলের শব্দে। আশপাশে যে জনবসতি রয়েছে, তার ভরসা এই শব্দই শুধু। দূর গ্রামে কোনও এক বাড়ির উঠোনে বসে তখন চলছে সান্ধ্য আড্ডা। সঙ্গে পরের পালার মহড়া। কান পেতে থাকলে ভেসে আসতে পারে টুসু-ভাদুর সুরও।
|
|
সেখানে বিকেলের পর থেকে চলে নাচ-গান। সারা দিনের কাজের পরে গ্রামের ছেলেরা ছো নাচের অভ্যাস করেন। দলে থাকে কিছু খুদে শিল্পীও। মাঝেমধ্যে সে পালা দেখার সৌভাগ্য হয় পর্যটকদের। তবে মহলার সময়ে নয়। বায়না করে তাঁদের নিমন্ত্রণ করতে হয় নিজেদের রিসর্টে।
সূর্য ডোবার পরে এই অঞ্চল পুরোই অন্ধকার। হ্যালোজেন জ্বালিয়ে পালা দেখার জন্য উপযুক্ত। কাছের কয়েকটা গ্রাম থেকে শিল্পীরা আসেন। ছো নাচে রাম-রাবণের পালা অথবা দুগ্গা-অসুরের লড়াইয়ে জমজমাট হয়ে উঠবে যে কোনও সন্ধ্যাই। হাতে সময় থাকলে সেই দলেরই কোনও শিল্পী শুনিয়ে যাবেন দু’কলি ঝুমুর অথবা টুসু। অন্ধকার অচেনা জঙ্গলে পথ হারানোর রেশ তখনও গানের তালে তোলপাড় তুলবে মনে।
সন্ধের জঙ্গলে গা ছমছম করেই। বড় বড় গাছের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ে যাবে টেন্ট থেকে বেরোনোর আগে রিসর্টের কেয়ারটেকার জলধরদার দেওয়া সাবধানবার্তা। “আশপাশে কীসের আওয়াজ হচ্ছে, একটু খেয়াল রাখতে হবে। অনেক কিছুই তো থাকে জঙ্গলে।” মায়াবী সন্ধ্যায় হঠাৎ মনে হতেই পারে এই বুঝি ‘অন্য রকম’ কোনও অভিজ্ঞতা হবে। বুক দুরুদুরু, সঙ্গে মুগ্ধতা। পথ চলতে চলতে কখনও একটু হাঁপিয়ে গিয়ে দু’দণ্ড জঙ্গলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্রাণভরে শ্বাস নেওয়া। তারই সঙ্গে শুষে নেওয়া কোনও জংলি ফুলের অচেনা ঘ্রাণ। নিজের মধ্যে জমিয়ে রাখা অন্তত পরের ছুটি পর্যন্ত।
এরই ফাঁকে বেখেয়ালে দলছুট হয়ে যাওয়া। অসহায় ভাবে টাওয়ার ছাড়া ফোনটা হাতড়াতে হাতড়াতেই ফের দলছুট পাগলা হাতির কথা মনে করা। পথ ভুল করে থমকে গিয়ে নতুন কোনও পাখির ডাক। আবার অচেনা বন্য গাছের পাশে ভয়ে সিঁটিয়ে ঈশ্বরকে ডাকতে উপরে তাকালেই আলকাতরা-রঙা আকাশে তারার কারুকার্য বলবে আরও একটু হারিয়ে যেতে। ভয়-মেশানো মুগ্ধতা তখন একান্ত আপন। কোন ফাঁকে রোজের পরিচিত অভিজ্ঞতাগুলো চলে গিয়েছে বহু দূর। বাস-ট্রাম-অটো, ধর্মতলার মোড় সবই ততক্ষণে অন্য দুনিয়ার। নিয়ন আলোর ব্যস্ত সন্ধ্যাগুলো দূরে যেতে যেতে ক্রমশ ঝাপসা।
|
|
হঠাৎ সাইকেলের ঘন্টি। ভাঙল মুগ্ধতার ঘোর। সঙ্গীদের দেখা মেলেনি তখনও। স্থানীয় এক যুবক কাজ সেরে ফেরার পথে বলে দিলেন, পথ ভুল হয়েছে।
দু’দিনের জন্য অযোধ্যা পাহাড়ের কোলে এই জঙ্গলের এক অংশ অনায়াসে হয়ে যেতে পারে একান্ত আপন। সপ্তাহান্তে চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি না থেকে আরও একটু বেশি পাওয়া গেলে ক্ষতিই বা কী!
গরমের দুপুরেও রোদের তাপ এড়াতে বার বার মন ফিরবে ওই জঙ্গলেরই দিকে। সন্ধ্যাগুলো অবশ্য অনেক ঠান্ডা। গরম যতই বাড়বে, ঝলমলে আকাশ, নিঝুম চারপাশ নিশ্চয়ই বার বার টানবে অরণ্যের দিকেই। শহরের ধোঁয়া-ভরা আকাশে যে সব তারা কখনও দেখা যায় না, সে সবের সন্ধানেই যাওয়া যায় পুরুলিয়া শহর থেকে আরও দু’ঘণ্টার রাস্তা পেরিয়ে, বেশ কয়েকটি গ্রাম ছাড়িয়ে মুরগুমার ড্যামের পাশে, অযোধ্যা পাহাড়ের নীচে। রিসর্ট থেকে বেরিয়ে কয়েক পা গেলেই সেই ড্যাম। শোনা যায়, এখানকার বর্ষা খুব রূপসী।
হাতে যদি আর একটা দিন বেশি থাকে, তবে ঘুরে আসা যায় আশপাশের কোনও গ্রাম থেকেও। দু’দিন ছো নাচের পালা দেখে যে গ্রামের নাম সবার আগে টানবে, তা হল ‘চড়িদা’। মুরগুমা থেকে গাড়ি ভাড়া করে গেলে ঘণ্টা দুয়েকের পথ।
শহরের মানুষের কাছে চড়িদার পরিচয় মুখোশ বানানোর গ্রাম হিসেবে। ছো নাচের মুখোশ বানানোই বেশির ভাগ গ্রামবাসীর পেশা। কলকাতায় বিভিন্ন মেলায় যত ছো মুখোশ আসে, তার অধিকাংশই নাকি তৈরি হয় সেই গ্রামে। |
|
বাড়ির উঠোনে কচিকাচাদের কাজ দেখতে দেখতেই শুরু করা যায় কোনও একটা রোববার। এই দিনটা স্কুল ছুটি থাকে বলে, সকাল থেকেই বাবা-কাকাদের কাছে মুখোশ বানানো শেখার জন্য রাখা থাকে। কয়েক পা দূরে দূরে বিভিন্ন বাড়ির উঠোনে বসে চোখ আঁকা, রং করা, মুখোশ রোদে দেওয়ার ব্যস্ততা। বাতিল সিডি দিয়ে বানানো রাম-রাবণের মুকুট। আর ঘরের ভিতরে সাজানো থাকে তৈরি মুখোশ।
ওই গ্রামে যাওয়া-আসার পথেই চোখে পড়ে যাবে স্থানীয়দের রোজনামচা। তবে রাতে টেন্টে ঢোকার আগে শান্ত ড্যাম আর হাতছানি দিয়ে ডাকা গম্ভীর জঙ্গল মনে করাবে, চেনা জীবনের ব্যস্ততা অনেক দূরের। |
|
|
কী ভাবে যাবেন |
ট্রেনে পুরুলিয়া। সেখান থেকে ৪৩ কিলোমিটার।
গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়, রিসর্টেও আগে থেকে গাড়ির জন্য বলে রাখা যায়। |
|
কোথায় থাকবেন |
বেসরকারি থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। |
সঙ্গে রাখুন |
অবশ্যই টর্চ। রাখা ভাল ছাতা, টুপিও। |
|
|
ছবি: পারমিতা দে |
|
|
|
|
|