অনটনে গর্ভস্থ শিশুকে বেচতে চান বাবা-মা
র্ভ ভাড়া দিয়ে রোজগার নয়, নিজেরই ভাবী সন্তানকে আগাম বিজ্ঞাপন দিয়ে ‘বিক্রি’ করতে চাইছেন এক অন্তঃসত্ত্বা।
‘বিক্রি’র বিষয়টি বিজ্ঞাপনে সরাসরি উল্লেখ করা নেই। সেখানে ‘দত্তক’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু সেই বিজ্ঞাপন দেখে যোগাযোগ করলে, বাচ্চার জন্য দাবি করা হচ্ছে তিন লক্ষ টাকা।
জুন মাসের এক রবিবার সংবাদপত্রের ব্যক্তিগত কলমে প্রকাশিত হয়েছিল ছোট্ট বিজ্ঞাপনটি। লেখা ছিল, সুরজিৎ চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর স্ত্রী প্রিয়ঙ্কা আর্থিক অনটনে পড়ে সন্তান দত্তক দিতে চান। সঙ্গে একটি ফোন নম্বর। আনন্দবাজারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে ফোন ধরেন প্রিয়ঙ্কা। জানান, তিনি আসন্নপ্রসবা। জন্মের পরেই সন্তানকে দিয়ে দিতে চান। বদলে তাঁর তিন লাখ টাকা দরকার। কেন সন্তান বিক্রি করতে চাইছেন?
ন’মাসের অন্তঃসত্ত্বার উত্তর, “ব্যবসায় মার খেয়ে রাস্তায় নেমে এসেছি। খাওয়ার পয়সা নেই। প্রচুর দেনা। পাশে কোনও আত্মীয়-বন্ধু নেই। আমাদের পাঁচ বছরের একটা ছেলে আছে। ছেলেটাকে বাঁচাতে গেলে পেটের বাচ্চাটাকে বিক্রি না-করে উপায় নেই।” যে পদ্ধতিতে প্রিয়ঙ্কারা সন্তান বিক্রির পরিকল্পনা করছেন, তা-ও বেশ অভিনব। প্রিয়ঙ্কাই জানান, পুরো প্যাকেজ তিন লাখের। প্রথমে তাঁকে যাবতীয় ‘মেডিক্যাল চেকআপ’ করাতে হবে। যিনি সন্তানটি কিনবেন, তাঁর নাম করেই চেকআপের সময় নিজের পরিচয় দেবেন প্রিয়ঙ্কা। সন্তানের জন্মের জন্য তিনি যে হাসপাতালে ভর্তি হবেন, সেখানেও প্রিয়ঙ্কার নাম লেখা হবে না। লেখা হবে, যিনি সন্তান নিতে চান সেই মহিলার নাম। বাচ্চার বাবার জায়গাতেও ওই মহিলার স্বামীর নাম লেখা হবে। ফলে তাঁদের নামেই হাসপাতালের কাগজ ও শিশুটির জন্মের ‘সার্টিফিকেট’ হয়ে যাবে। হাসপাতালের সব খরচ মেটানোর পর তিন লাখের মধ্যে যা পড়ে থাকবে, তা নগদ দিতে হবে প্রিয়ঙ্কাদের। টাকা নিয়ে তাঁরা শহর ছেড়ে চলে যাবেন।
আপাতত বালি স্টেশনের কাছে এক মেসবাড়িতে চিলেকোঠার ভাড়া ঘরে প্রিয়ঙ্কাদের সংসার। সেখানে পৌঁছে দেখা গেল, ঘরের চার দিকে ছড়ানো স্যুটকেস, জামাকাপড়, কয়েকটি বাংলা উপন্যাস, স্টিরিও, অডিও সিডি। দরজায় দাঁড়ানো বছর তিরিশের এক মহিলা বললেন, “আমিই প্রিয়ঙ্কা। ভিতরে আসুন।” পাশে বছর পাঁচেকের একটি ছেলে।
যখন বুঝলেন দ্বিতীয় সন্তান প্রতিপালন করতে পারবেন না, তখন সময় মতো গর্ভপাত করালেন না কেন? প্রিয়ঙ্কার কথায়, “সন্তান বিক্রি করব তো আগে ভাবিনি। গর্ভাবস্থার ছ’মাস পার হওয়ার পরে পরিবারে আর্থিক বিপর্যয় এল। তখন আর বাচ্চা নষ্ট করা যায় না।” কিন্তু শিশু বিক্রি করা তো বেআইনি! প্রিয়ঙ্কার উত্তর, “অত সব আইন-টাইন জানি না। কেউ তো শখ করে এ সব করে না। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে তবেই কেউ নিজের সন্তান বিক্রির কথা ভাবে।”
দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেল কী ভাবে? প্রিয়ঙ্কার বয়ান অনুযায়ী, ২০০৩ সালে বাড়ির অমতে তাঁদের বিয়ে হয়েছিল। তখন হাওড়ার শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে পুরীতে একটি হোটেল লিজ নেন তাঁরা। অংশীদার ছিলেন সুরজিতের এক বন্ধু। মাস ছ’য়েক আগে সুরজিতের সেই বন্ধু নাকি ব্যাঙ্ক থেকে সব টাকা তুলে উধাও হয়ে যান। তত দিনে প্রিয়ঙ্কা দ্বিতীয় বার মা হতে চলেছেন। তখনই দু’জনে মিলে গর্ভস্থ সন্তান বিক্রির পরিকল্পনা করেন। ইতিমধ্যে কয়েক জনের সঙ্গে দরদস্তুরও হয়েছে।
কারা এসেছিলেন কিনতে? তাঁরা কি জানতেন না যে এই ভাবে বাচ্চা কেনা বেআইনি? প্রিয়ঙ্কা জানান, শ্যামবাজার ও ভবানীপুর থেকে দু’জন ভদ্রলোক ফোন করেছিলেন। আর, সল্টলেক থেকে এক দম্পতি দেখা করতে এসেছিলেন। তাঁদের ইতিমধ্যেই দু’টি ছেলে রয়েছে। প্রিয়ঙ্কারমনে হয়েছিল, বাচ্চা যখন রয়েইছে, তা হলে তাঁর বাচ্চাকে কিনে অন্য কোনও কাজে ব্যবহার করতে পারেন ওই দম্পতি। তাই তাঁদের সন্তান দিতে রাজি হননি তিনি। প্রিয়ঙ্কার কথায়, “ওঁরা সবাই বলছিলেন, সরকারি নিয়ম মেনে দত্তক নেওয়ায় অনেক ঝামেলা। অনেক সময় লাগে। তাই তাঁরা এই ভাবে সহজে বাচ্চা পেতে চাইছেন।”
কতটা সত্যি বলছেন প্রিয়ঙ্কারা? আনন্দবাজারের পক্ষ থেকে খোঁজ নেওয়া হয়েছিল পুরীর হোটেলে। কিন্তু সেখান থেকে জানানো হয়, এ রকম কোনও দম্পতিকে তাঁরা কখনওই হোটেল লিজ দেননি। বিষয়টি তখন জানানো হয় বালি থানায়। পুলিশ অফিসারদের সামনে প্রিয়ঙ্কা ও সুরজিৎ স্বীকার করেন, তাঁদের বয়ানে অনেক মিথ্যা ছিল। তবে ব্যবসায় সর্বস্বান্ত হওয়া এবং আর্থিক সঙ্কটে মরিয়া হয়ে সন্তান বিক্রির পরিকল্পনা করার ব্যাপারটি সাজানো নয়। বয়ান বদলে সুরজিৎ এখন বলেন, “পুরীতে হোটেল লিজ নিইনি। ওখানে কাপড়ের ব্যবসা ছিল। মার খেয়ে যাই। বাজারে প্রচুর দেনা। তাই অনেক বার নাম বদল করে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। বাচ্চা বিক্রি না করলে আর পথ নেই। কারণ, আমাদের কোনও আত্মীয় সাহায্য করছেন না।” এ সব কথা শুনে প্রিয়ঙ্কাদের গ্রেফতার করল না পুলিশ? বালি থানার তরফে উত্তর, “ওঁরা এখনও সন্তান বিক্রি করেননি। সন্তান জন্মের পরে তাকে বিক্রি করলে ওঁদের ধরা হত। তবে ওই কাজ যাতে তাঁরা না করেন, সে জন্য সতর্ক করা হয়েছে।”
কতটা মরিয়া হলে গর্ভস্থ সন্তান বিক্রি করে টাকা জোগাড় করার কথা ভাবে মানুষ? মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যালের মতে ওই দম্পতি মানসিক ভাবে অসুস্থ। তাঁর বক্তব্য, “বোঝাই যাচ্ছে, বাবা-মা অত্যন্ত ‘ম্যানিপুলেটিভ’। শিশুটি তাঁদের কাঙ্খিত নয়। টাকার জন্য রীতিমতো হিসাব কষেই সব পরিকল্পনা করেছেন।” সমাজতত্ত্ববিদ প্রশান্ত রায় অবশ্য বলছেন, “বহু যুগ ধরেই আমাদের সমাজে টাকার জন্য শিশু বিক্রি লুকিয়ে-চুরিয়ে চলে আসছে। গ্রামের দিকে সেটা আরও বেশি। কোনও মারাত্মক অসহায়তা বা প্রয়োজন থেকেই মানুষ এমন চরম সিদ্ধান্ত নেয়। প্রিয়ঙ্কাদের ক্ষেত্রে হয়তো আর্থিক বিপর্যয় সেই ভূমিকাটা নিয়েছিল।” এই ঘটনার কথা জানিয়ে যোগাযোগ করা হলে রাজ্য সমাজকল্যাণ দফতরের সচিব রিনচেন টেম্পোর প্রতিক্রিয়া, “এ তো মারাত্মক ঘটনা! বিজ্ঞাপন দিয়ে শিশু বিক্রি হচ্ছে! বাচ্চাটিকে কিনে কেউ তো পাচারও করে দিতে পারে।
আইন মেনে দত্তক দেওয়ার ক্ষেত্রে শিশুটির উপর সরকারের যে নজরদারি থাকে, অবৈধ পথে সেটা তো থাকবে না!”
প্রিয়ঙ্কার চোখে কিন্তু জল। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে শুধু বলছেন, “ওর বাবার অনেক দোষের জন্য আজ আমার এই অবস্থা। কিন্তু এই ছেলেই আমার সব। ওকে মানুষ করতে গেলে পেটের বাচ্চাটাকে বিক্রি না করে উপায় নেই। আপনারা বলছেন, এই ভাবে বিজ্ঞাপন দিয়ে বাচ্চা বিক্রি করা বেআইনি। এখন জানাজানি হয়ে গিয়েছে। আর হয়তো তা করতেও পারব না। কিন্তু বাচ্চা জন্মালে মানুষও করতে পারব না।”
First Page Swasth Next Story



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.