|
|
|
|
বড়বাবু নিজেই জানেন না, দাপটে ঘুরছেন আর এক বড়বাবু |
অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য • কলকাতা |
কাঁধে তারা লাগানো খাকি পোশাক। মাথায় টুপি। বেল্টে আঁটা রিভলভারের খাপ।
গাড়ি থেকে নেমেই গটগট করে চলে যাচ্ছেন ‘রেড’ করতে। লম্বা-লম্বা সেলাম ঠুকছে তটস্থ সান্ত্রীরা। থানার নতুন বড়বাবু বলে কথা!
ডুবিয়ে দিল জুতোটাই।
শুক্রবার দুপুরে বারাসত আদালতে গাড়ি থেকে নেমে যখন এগিয়ে যাচ্ছেন, খটকা লেগেছিল দু’এক জন পুলিশকর্মীর। কিন্তু দেখেই মনে হচ্ছে, বড়কর্তা গোছের কেউ হবেন। চলেওছেন সোজা লকআপের দিকে। ‘তদন্তের প্রয়োজনে’ এক অপরাধীর সঙ্গে কথা বলবেন।
প্রথমে একটু কিন্তু-কিন্তু। শেষে সাহস করে আদালতের এক পুলিশকর্মী জিজ্ঞাসা করেই ফেলেন, “স্যার, আপনি?” টুপির নীচ থেকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে কর্তা বলেন, “ওসি, আমডাঙা।” |
|
“কিন্তু স্যার...” পুলিশকর্মীর কথা আটকে যায়। আসলে আমডাঙা থানার ওসি বলতে আদালতের সমস্ত পুলিশকর্মীই চেনেন ছ’ফুটের উপর লম্বা, বিশাল চেহারার মনিরুল ইসলাম সরকারকে। টুপির নীচ থেকে ঝটিতি জবাব আসে, “আমি বদলি হয়ে নতুন এসেছি।”
আশ্চর্যের কিছু নয়। গত দু’সপ্তাহের মধ্যে উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, এসডিপিও থেকে শুরু করে তাবড় পুলিশকর্তারা বদলি হয়েছেন। নতুন কর্তাদের সবাইকে এখনও ঠিকঠাক চিনে উঠতে পারেনি পুলিশ মহল। তখনই একটি মামলার প্রয়োজনে আদালতে এসেছিলেন আমডাঙা থানার এক এএসআই। নতুন ‘বড়বাবু’ দেখে তিনিও হতভম্ব। “একটু আগেই থানা থেকে বড়বাবু আমায় আদালতে পাঠালেন, আর এর মধ্যেই বদলি হয়ে গেলেন!” পাশের কনস্টেবলের কানে বিড়বিড় করেন তিনি।
এই পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। কিন্তু ঘোঁট পাকাল সেই জুতো।
হঠাৎই দোলতলা পুলিশ লাইন থেকে আসা সশস্ত্র বাহিনীর এক কনস্টেবলের চোখে পড়ে, নতুন বড়বাবুর পায়ে পুলিশের বুট নয়, নামী বহুজাতিক সংস্থার জুতো। ফিসফাস শুরু হয়ে যায়। হতভম্ব ভাব কাটিয়ে এএসআই ফোন করেন আমডাঙা থানায়। ফোন ধরেন খোদ মনিরুল। চমকে ওঠে গোটা থানা। মনিরুলের কথায়, “কী সাংঘাতিক কাণ্ড ভাবুন! আমি সঙ্গে সঙ্গে ওই বড়বাবুকে আটকাতে বলি।”
কিন্তু আটকাবে কে? কী ভাবে? |
|
এই গাড়িতেই ঘুরছিলেন ওই ব্যক্তি। - নিজস্ব চিত্র |
আদালতের কর্মীরা দেখছেন, টুপির নীচ থেকে ফোন চলে গিয়েছে খোদ পুলিশ সুপারের কাছে! মোবাইল ফোনে ‘বড়সাহেব’কে তিনি বলছেন, “স্যার, কোর্টের পুলিশ আমার সঙ্গে ইল বিহেভ করছে। ইয়েস স্যার... ওকে স্যার... এখানে যারা রয়েছে, নামগুলো জানাচ্ছি।” কর্মীরা ফের থতমত। আর, তাঁদের সে ভাবেই দাঁড় করিয়ে রেখে মোবাইলে কথা বলতে বলতে সেরেস্তার ভিড়ে মিলিয়ে যান নতুন বড়বাবু।
সামনে-পিছনে ইংরেজিতে ‘পুলিশ’ লেখা গাড়িটি অবশ্য নিয়ে যাননি। ঘোর কাটতেই পুলিশকর্মীরা হইহই করে ছুটে গিয়ে সেটি আটক করেন। কাছেই বারাসত থানা থেকে পুলিশ আসে। চালককে চেপে ধরেন সবাই। চালক রবিউল ইসলাম নির্বিকার মুখে বলেন, “আরে, উনিই তো আমডাঙা থানার নতুন বড়বাবু! বারাসতে ঘর ভাড়া নিয়েছেন। এই গাড়িও। আমায় নিয়েই কয়েক জায়গায় ‘রেড’ করেছেন। কাল তো বসিরহাটে তদন্তের পরে সিনেমাও দেখলেন। দিলখোলা মানুষ।”
একই রকম ‘নিশ্চিন্ত’ বাড়িওয়ালাও। ইয়াসিনকে নিয়েই বারাসতের আড়িপবাড়ি এলাকায় সেই ভাড়াবাড়িতে গিয়ে পুলিশের চক্ষু চড়কগাছ। ঘরে সযত্নে সাজানো তারকাখচিত আরও খাকি পোশাক, পুলিশের ব্যাটন, ডায়েরি। আর ছিল ইয়াসিন আলি নামে একটি লোক। নিজেকে ‘বড়বাবু’র কাজের লোক বলে পরিচয় দিয়েছিল সে। পুলিশ তাকেই পাকড়াও করে। জেরায় সে জানিয়েছে, পুলিশের পরিচয় দিয়ে ভয় দেখিয়ে তারা ডাকাতি-ছিনতাই করে বেড়াত। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের অপরাধীদেরও যোগ রয়েছে। পুলিশের অনুমান, তেমন কোনও অপরাধীর জন্যই ‘বড়বাবু’ এ দিন আদালতে হাজির হয়েছিলেন।
গাড়িতে লালবাতি, ‘পুলিশ’ ও ‘প্রেস’ স্টিকার লাগিয়ে অপরাধের ঘটনা অবশ্য নতুন নয়। ক’দিন আগেই নিউটাউনে লালবাতি লাগানো গাড়ি নিয়ে ছিনতাইয়ের ঘটনায় তিন জন ধরা পড়েছে। জেলা পুলিশ সুপার চম্পক ভট্টাচার্য বলেন, “গাড়ির চালক আর ইয়াসিনকে জেরা করে সেই বড়বাবুকে ধরার চেষ্টা চলছে।” নবাবের জুতো ধরিয়ে দিয়েছিল ছদ্মবেশী সিরাজদ্দৌলাকে। ‘বড়বাবু’ কিন্তু ধরা পড়েও পড়েননি। |
|
|
|
|
|