|
|
|
|
|
|
বেহাল মর্গ |
নরক গুলজার |
দেবাশিস ঘোষ |
শান্তনু ঘোষ |
ময়নাতদন্তের পরে মর্গ থেকে পরিচিত এক জনের মৃতদেহ নিতে এসেছিলেন এক দল যুবক। প্রত্যেকেই দাঁড়িয়েছিলেন মর্গ থেকে বেশ কিছুটা দূরে। কিন্তু কেউই ভিতরে যেতে রাজি হচ্ছেন না। শেষে অনেক টালবাহানার পরে নাকে রুমাল বেঁধে ভিতরে ঢুকলেন দু’-তিন জন।
শুধু ওই যুবকের দলই নয়, প্রায় প্রতি দিনই হাওড়া পুলিশ মর্গের সামনে এই দৃশ্য দেখা যায়। কারণ, মর্গের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, হাওড়া পুলিশ মর্গের চারপাশের পরিবেশ ও ভিতরের এমনই দশা যে সেখানে ঢুকলেই শরীর খারাপ লাগে। উৎকট গন্ধে টেকা দায়। চোখের সামনেই একটি ঘরে ফেলে রাখা হয় মৃতদেহগুলি। মর্গের চাতালে বালিশ, তুলো, নোংরা কাপড় ছড়ানো। চার দিকে আগাছা। স্থানীয় বাসিন্দা ও মর্গে আসা লোকজনের দাবি, দীর্ঘ দিন ধরেই হাওড়ার এই পুলিশ মর্গের বেহাল অবস্থা থাকলেও সংস্কারের ব্যাপারে প্রশাসন একেবারেই উদাসীন। পাশাপাশি, হাওড়া জেলা হাসপাতাল মর্গের বেহাল দশা নিয়েও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে শহরবাসীর। |
|
মধ্য হাওড়ার মল্লিক ফটকের কাছে জিটি রোড থেকে প্রবোধ ব্যানার্জি রোডে ঢুকে একটু এগোলেই ডান দিকে গলির ভিতরে হাওড়া পুলিশ মর্গ। দুর্ঘটনা ও অস্বাভাবিক কারণে মৃত্যু হলে মৃতদেহগুলি ময়নাতদন্তের জন্য এখানে আনা হয়। বাদ যায় না বেওয়ারিশ মৃতদেহও। সম্প্রতি এখানে গিয়ে দেখা গেল মর্গের বেহাল অবস্থার ছবি। প্রবোধ ব্যানার্জি রোড থেকে মর্গে ঢোকার গলিটির অবস্থাও বেহাল। সরু রাস্তার অধিকাংশই ভাঙাচোরা। পড়ে রয়েছে নোংরা আবর্জনা। রাস্তার উপরেই দাঁড় করানো রয়েছে ভ্যানরিকশা থেকে
বড় গাড়িও। গলিতে ঢুকতেই নাকে আসে পচা গন্ধ। মর্গের দেহ শনাক্তকরণ ঘরটির অবস্থাও বেহাল। গ্যারাজ ঘরের মতো একটি খোলা ঘরের চাতালে পড়ে রয়েছে ময়নাতদন্ত হওয়া মৃতদেহগুলি। কাটাছেঁড়া করা মৃতদেহগুলির উপরে কোনও আবরণ নেই। মর্গের কর্মীরা জানান, দাবিহীন দেহ রাখার ঘরটির শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র দীর্ঘ দিন খারাপ অবস্থায় পড়ে। ফলে দেহগুলিতে দ্রুত পচন ধরছে। সেখান থেকেই পচা গন্ধ পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। এখানকার এক কর্মী বললেন, “এমনিতেই মর্গটি খুব ছোট। মৃতদেহ রাখতেও অনেক সমস্যা হচ্ছে।” সব মিলিয়ে মর্গের এহেন বেহাল অবস্থায় ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ। তাঁদের কথায়, দুর্ঘটনা ও অস্বাভাবিক কারণে মৃত্যু যতটা না দুর্ভাগ্যজনক তার থেকেও বেশী দুর্ভোগ পোহাতে হয় মর্গ থেকে মৃতদেহ নিতে আসা লোকজনকে। অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় বাসিন্দাদেরও। |
|
যেমন, মর্গ থেকে পরিচিত এক জনের দেহ নিতে এসেছিলেন বেলুড়ের বাপি নায়েক। তাঁর কথায়: “প্রায় তিন ঘণ্টা বসে আছি। কিন্তু ডাক্তার না আসায় এখনও ময়নাতদন্ত হয়নি। পচা গন্ধের মধ্যে বসে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে। তার উপর এখানে অপেক্ষা করার কোনও নির্দিষ্ট জায়গা পর্যন্ত নেই।” আবার স্থানীয় বাসিন্দা আসপান জানকী রাওয়ের অভিযোগ, “মর্গ থেকে এত পচা গন্ধ বের হয় যে প্রবোধ ব্যানার্জি রোডের অধিকাংশ বাড়ির জানলা সব সময় বন্ধ রাখতে হয়।”
জেলার পুলিশ সুপার রবীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বলেন, “মর্গের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পূর্ত দফতরের। পুলিশ-মর্গটির আমূল সংস্কার দরকার। এ ব্যাপারে জেলাশাসকের সঙ্গে কথা হয়েছে। নতুন মর্গ তৈরির জন্য জমির খোঁজ চলছে।” হাওড়া পূর্ত দফতরের এক কর্তা বলেন, “জেলা পুলিশ ওই মর্গটির সংস্কারের জন্য পূর্ত দফতরের কাছে প্রস্তাব পাঠায়। আমরা শুধুমাত্র মেরামতির কাজটি করে দিই। তবে জেলা প্রশাসনের তরফে নতুন মর্গ তৈরির জন্য পরিকল্পনা হয়েছে। একটি জমিও দেখা হয়েছিল। কিন্তু একশোটি মৃতদেহ রাখা যায় এমন মর্গ তৈরি করতে গেলে আরও বড় মাপের জমির প্রয়োজন।” জেলাশাসক সঙ্ঘমিত্রা ঘোষ বলেন, “বিশেষ করে পুলিশ মর্গের অবস্থা খারাপ। সেটি সংস্কারের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। নতুন জমি পাওয়া গেলে আরও বড় মর্গ তৈরি করা হবে। |
|
বেহাল অবস্থা হাওড়া জেলা হাসপাতাল মর্গটিরও। হাসপাতাল চত্বরের ভিতরেই ডেপুটি চিফ মেডিক্যাল অফিসার (দুই)-এর অফিসের লাগোয়া ওই মর্গ। পাশেই রয়েছে নার্সদের আবাসন। হাসপাতাল সূত্রে খবর, হাসপাতালে মারা যাওয়া দাবিহীন দেহগুলি প্রথমে ওই মর্গেই রাখা হয়। পরে জেলাশাসকের কাছে লিখিত ভাবে জানিয়ে মল্লিক ফটকের কাছে পুলিশ মর্গে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অভিযোগ, হাসপাতালের মর্গটিতেও শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের সমস্যা রয়েছে। ফলে দ্রুত পচন ধরা মৃতদেহ থেকে কটু গন্ধ বের হয়। মর্গের দরজার নীচে বড় গর্ত। সেখান দিয়ে বেরিয়ে আসে বড় বড় ইঁদুর। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নার্স বললেন, “দরজা-জানলা সব সময়ই বন্ধ রাখতে হয়। বহু বার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। কাজের কাজ কিছু হয়নি।” একই অভিযোগ ডেপুটি চিফ মেডিক্যাল (দুই)-এর অফিসের কর্মীদেরও। ডেপুটি সিএমওএইচ (টু) প্রসূন দাস বলেন, “অফিসের লাগোয়া মর্গ থেকে দুর্গন্ধ বের হয়। বিষয়টি সুপারকে জানানো হয়েছে।” হাওড়া হাসপাতালের সুপার শুভ্রাংশু চক্রবর্তী বলেন, “মর্গের এয়ারকন্ডিশনার মেশিনগুলি ভাল ভাবে কাজ করছে না। এ ব্যাপারে জেলাশাসকের দফতরে রিকুইজিশন জমা দিয়েছি।”
সমস্যা রয়েছে হাসপাতালের মর্গ লাগোয়া বর্জ্য ফেলার ঘরটিতেও। অভিযোগ উঠেছে, সেখানে প্রসূতি বিভাগের বিভিন্ন বর্জ্য প্লাস্টিক প্যাকেটে ভরে ফেলে দেন সাফাইকর্মীরা। এ ছাড়াও হাসপাতালে মারা যাওয়া যে সব শিশুর মৃতদেহ তাদের পরিজনেরা নিতে চান না সেই দেহগুলিও ওই ঘরে রাখা হয়। কিন্তু ঘরটি নিয়মিত সাফাই করা হয় না। ফলে সেখান থেকেও পচা গন্ধ বের হয়। এ বিষয়ে শুভ্রাংশুবাবু বলেন, “হাসপাতালের মর্গের পাশের ঘরে প্রসূতি বিভাগের বর্জ্য ও মৃত শিশুদের দেহও রাখা হয়। সেটি সাফাইয়ের জন্য পুর স্বাস্থ্য বিভাগকে জানানো হয়। ওরাই এটা সাফাই করে।” কিন্তু নিয়মিত সাফাই হয় না কেন? পুরস্বাস্থ্য আধিকারিক শুভাশিস সরকার বলেন, “হাসপাতাল সাফাইয়ের জন্য আমাদের কাছে প্রস্তাব পাঠালে তবেই পুরসভার ঠিকাদার সংস্থা হাসপাতালের বর্জ্য ও মৃত শিশুর দেহ সাফাই করে। শিশুদের দেহ পরিষ্কার করার জন্য পুরসভা জেলাশাসকের দফতর থেকে টাকা পায়।” জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সাথী দত্ত বলেন, “হাসপাতালের মর্গটির সংস্কারের পরিকল্পনা রয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি কাজ হবে।”
|
ছবি রণজিৎ নন্দী |
|
|
|
|
|