মনোরঞ্জন ১...
শেষ জাদুকর
ত্রিকার পাঠকদের মধ্যে যাঁরা গত বিষ্যুদবার লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়্যারে হ্যারি পটার সিরিজের শেষতম ছবির পিলে চমকানো প্রিমিয়ারের বৃত্তান্ত পড়ে ফেলেছেন, দুনিয়ার বাদবাকি সব পটার-ভক্তের মতোই উত্তেজনায় টগবগ করছেন এবং এই নাটকীয় ফিনালের শেষ অঙ্কটা দেখার জন্য অফিসে কবে ডুব মারব ভাবছেন সবিনয় তাঁদের জানানো যাক, এটা শুধু গল্পের আর্ধেকটা!
লন্ডনে এই ছবিটার মহামুক্তি আসলে আর পাঁচটা শুক্রবারের নিত্যনৈমিত্তিকতা আদপেই নয়, বরং একটা কঠিন সময়ের দমবন্ধ হাঁসফাঁস থেকে ছিটকে বেরোনোর এমন আকুল আর্তি এতে মিশে আছে যে, সাত সমুদ্র তেরো নদী পারের কলকাতা থেকে তা ঠাহর করা সত্যিই মুশকিল।
ব্যাপারটা কী রকম, সে কথাতেই আসছি।
অ্যাদ্দিনে কারওরই জানতে বাকি নেই, ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ডেথলি হ্যালোজ পার্ট টু’ (অতঃপর সংক্ষেপে যাকে আমরা দস্তুর অনুযায়ী শুধু ‘ডি এইচ টু’ বলেই সম্বোধন করব) আসছে শুক্রবার, মানে ১৫ জুলাই দুনিয়া জুড়ে রিলিজ করতে যাচ্ছে। আর এই প্রথম সাবেকি টুডি-র পাশাপাশি থ্রিডি-তেও, আইম্যাক্সে দেখা যাবে এই অসাধারণ বিনোদন। ওই উইকএন্ড থেকেই প্রায় গোটা ইউরোপ জুড়ে স্কুলের লম্বা সামারের ছুটি পড়ছে, কাজেই বাচ্চাদের নিয়ে ওডিওন বা সিনেওয়ার্ল্ডের সামনে মা-বাবার লাইন আগামী বেশ কিছু দিনের জন্য রুটিন দৃশ্য!
কাতার বা অস্ট্রেলিয়ায় দু’-এক দিন আগে-পরে হতে পারে, কিন্তু ওয়ার্নার ব্রাদার্সের ঘোষণা অনুযায়ী, ইট অল এন্ডস সেভেন ফিফটিন অর্থাৎ হ্যারি পটার নামক ইন্দ্রজালের হেস্তনেস্ত হয়ে যাচ্ছে ওই জুলাইয়ের পনেরোতেই, মানে মার্কিন কায়দায় যাকে বলে ‘সেভেন ফিফটিন’। দশ বছর ধরে যে হ্যারি আর লর্ড ভলডেমর্টের যুযুধান লড়াই গোটা দুনিয়াকে তটস্থ করে রেখেছে, দুনিয়া সেলুলয়েডে সেই যুদ্ধের শেষ কিস্তিমাত দেখে নেবে ওই দিনটাতেই।
আর সেই গণমুক্তির দিন কয়েক আগেই লন্ডন দেখে ফেলল ‘ডিএইচ টু’র ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার আর সেটা কিনা খোদ ট্রাফালগার স্কোয়্যারে! পাশেই লাগোয়া লেস্টার স্কোয়্যারে হলিউড থেকে বলিউড, প্রায় রোজই নানান ছবির প্রিমিয়ার তো জলভাত কিন্তু কে কবে শুনেছে, প্রিমিয়ারের লাল কার্পেট বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে ট্রাফালগার স্কোয়্যারের প্রশস্ত চাতালেও?
কিন্তু ইনি হ্যারি পটার বলে কথা, এবং শেষতম। অগত্যা স্কোয়্যারের খাড়া নেলসন কলামের পাশ কাটিয়ে, উবু হয়ে বসা সিংহদের কোল ঘেঁষে সেই রেড কার্পেট মাড়িয়ে এলেন ড্যানিয়েল র্যাডক্লিফ, রুপার্ট গ্রান্ট বা এমা ওয়াটসনের মতো পটার-তারকারা!
ইউ টিউবের লাইভ স্ট্রিমিংয়ের সুবাদে পটার-ভক্তরা সে সবই গোগ্রাসে গিলে ফেলেছেন টাটকা টাটকা এখন যথারীতি ফেসবুক, টুইটারে হাতে হাতে ঘুরছে সেই সব লিঙ্ক!
কিন্তু যেটা দুনিয়া দেখেনি, সেটা হল মাত্র সাত দিন আগে সেই একই ট্রাফালগার স্কোয়্যারের দৃশ্য! তিরিশে জুনের ভরদুপুরেই লন্ডনের প্রাণকেন্দ্র অচল হয়ে গিয়েছিল সরকারি কর্মচারী আর টিচারদের বেমক্কা স্ট্রাইকে! স্কুলের ক্লাস ফেলে, অফিসে ঝাঁপ ফেলে হাজার হাজার মানুষ সে দিন রাস্তায় নেমেছিলেন তাঁদের পেনশনে কোপ পড়ার প্রতিবাদে আর মিছিল-ফেস্টুন-প্ল্যাকার্ডে ট্রাফালগার স্কোয়্যার থেকে হোয়াইট হল বেয়ে ওয়েস্টমিনস্টার অবধি পুরো চত্বরটা চেহারা নিয়েছিল অবিকল কলকাতার ব্রিগেডের!
ফ্রি মার্চেন্ডাইজ, ব্লক বুকিংয়ের সুবিধে তো থাকছেই। এমনকী চাইলে
একটা গোটা হল-ই বুক করে নিতে পারেন প্রাইভেট শো-র জন্য।
প্রতিবারই মে দিবসে ট্রেড ইউনিয়নগুলো থেকে শুরু করে নানা ক্যাম্পেন গ্রুপ লন্ডনে হাজারো মিছিল বার করে, ট্রাফালগার স্কোয়্যারের জমায়েতে বিলি হয় বামপন্থী লিফলেট। এমনকী কিম জং ইলের জীবনী থেকে শুরু করে উগো চাভেজের দর্শন, কী না বিক্রি হতে দেখেছি ওই মে ডে-র বিচিত্র পসরায়!
তবে গোটা ব্যাপারটায় দারুণ পিকনিক-পিকনিক আমেজ যে থাকে তা কেউই অস্বীকার করবে না।
কিন্তু ব্রিটেনে ইদানীংকার আন্দোলনে সেই ফুর্তিটা উধাও। বরং একটা তিরতিরে আতঙ্কের চোরা স্রোত টের পাওয়া যাচ্ছে দিব্যি। বিপুল ঋণের ভারে ব্যতিব্যস্ত সরকার খরচ কমাতে নাজেহাল ডেভিড ক্যামেরন আর জর্জ ওসবর্ন মিলে আজ পেনশনে, তো কাল বেনিফিটে কোপ মারছেন ক্রমাগত আর হাজার হাজার লোক চাকরি খোয়াচ্ছেন অথচ বাড়ছে আয়কর, বাড়ছে ভ্যাট আর খাবার-দাবার, পেট্রলের দাম আর প্রতিনিয়তই একটু একটু করে রেগে যাচ্ছে, গুমরে উঠছে একটা হুল্লোড়ে, ফুর্তিবাজ জাতি। আরও সহজ করে বললে, এ বড় সুখের সময় নয়!
যে কারণে এত কথা বলা, সেটা হল বাইরের ঠাটবাট বাদ দিন, এই ২০১১-র লন্ডন পরিষ্কার একটা রিসেশন-ক্লান্ত, রিকেটি-অর্থনীতির শহর তাকে দু’দণ্ড শান্তি দিলেও বা দিতে পারে হ্যারি পটার!
সত্যিই এতটুকু বাড়িয়ে বলা নয় এটাই নির্মম বাস্তব! বিগত পুরো একটা দশক জুড়ে সারা দুনিয়াকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে একটা আদ্যন্ত ব্রিটিশ প্রোডাক্ট, এমন তুলনা তো আর একটাও নেই। যে যুগে জাগুয়ার কিংবা ক্যাডবেরির মতো ব্রিটিশ নাম টাটা-ফাটারা এসে বগলদাবা করে নিচ্ছে, সেখানে এই হ্যারি পটার নামক একটা ব্রিটিশ পণ্য দুনিয়া জুড়ে মারকাটারি ব্যবসা করে যাচ্ছে, ভাবতেও ভাল লাগে বইকী!
আর কে না জানে, হলিউডের মার্কিনি দাপটেও ব্রিটিশ জয়ধ্বজা উড়িয়ে রেখেছে দুই ড্যানিয়েল, মানে র্য়াডক্লিফ আর ক্রেইগ। এঁরাই যথাক্রমে স্ক্রিনের হ্যারি পটার আর জেমস বন্ড ...এক জন সদ্য কৈশোর পেরোনো, তীক্ষ্ম বুদ্ধির ঝিলিক-মাখা জাদুকর, আর অন্য জন মধ্য-চল্লিশের প্রখর যুবা, দুর্ধর্ষ ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিস এজেন্ট। এঁদের নিয়েই আপাতত ব্রিটেনের যাবতীয় গর্ব, ভাল লাগা, যে কারণে ‘ডি এইচ টু’ও এই রুদ্ধ্বশ্বাস সময়ে খুব জরুরি একটা অক্সিজেন!
সাধে কি আর মেতে উঠেছেন লন্ডনের খ্যাপাটে মেয়র বরিস জনসনও? ট্রাফালগার স্কোয়্যারে প্রিমিয়ার করার প্রস্তাবে সোৎসাহে শুধু সায়ই দেননি, পটারকে প্রোমোট করার কোনও চেষ্টাই তো বাদ দেননি জনসন। বাকিংহাম প্যালেসের মতো হ্যারি পটার নিজেও যে শহরে অসংখ্য পর্যটক টানতে পারেন, এই বোধোদয়ও হয়েছে মেয়রের। লন্ডনে সত্যিকারের কিংস ক্রস স্টেশনের যে প্ল্যাটফর্ম থেকে গল্পের হগওয়ার্টসের জাদু-স্কুলে যাওয়ার ট্রেন ছাড়ে, সেটার মতো নানা পটারীয় আকর্ষণ তুলে ধরা হচ্ছে পর্যটকদের কথা মাথায় রেখেই!
এ কারণে প্রথমেই বলছিলাম ‘ডেথলি হ্যালোজ পার্ট টু’র শুভমুক্তি শুধু একটা মেগারিলিজ নয়, ব্রিটেনের জন্য তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু!
এমনিতেই এই নতুন ছবিটায় একটা বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচি মার্কা ব্যাপার আছে, কারণ এটা হল হ্যারি পটারের সিরিজের সাত নম্বর বইটার আদলে আট নম্বর সিনেমা! শেষ বইটাকে স্রেফ ব্যবসায়িক স্বার্থে টেনে লম্বা করে দু’পার্টে সিনেমা করা হয়েছে, এমন একটা অনুযোগ প্রায়শই শোনা যায়, এবং অন্ধ পটার-ভক্তরা তাতে খুব একটা কান দেন না। তাঁদের যুক্তি হল, বইটা ভীষণই মোটা, কাজেই একটা সিনেমায় সেটার প্রতি সুবিচার করা যেত না। তামাম ব্রিটেনও কিন্তু এখন একমত - ‘ডেথলি হ্যালোজ’ দু’টো পার্টে করায় এ তল্লাটে অন্তত কেউই অখুশি নয়!
গত বছর যখন ‘ডি এইচ ওয়ান’ মুক্তি পেল, অনেক সমালোচকই বলেছিলেন, এমন গা-হিম করা, ভয়ে শিউরে ওঠা হ্যারি পটার মুভি আর একটাও হয়নি! চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী লর্ড ভলডেমর্টের শেষ রেশটুকু মুছে ফেলার জন্য হ্যারি আর ওর বন্ধু রন উইসলি বা হার্মিওনি গ্রেঞ্জারকে যে অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল, পর্দায় সেটা দেখে বুক শুকিয়ে গিয়েছিল অনেকেরই। ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ তো এমন কথাও লিখেছিল, সাপের ভয় থাকলে ছবিটা আদৌ দেখবেন কি না ভেবে দেখুন!
গণমুক্তির দিন কয়েক আগেই লন্ডন দেখে ফেলল
‘ডিএইচ টু’র ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার খোদ ট্রাফালগার স্কোয়্যারে!
তো ‘ডি এইচ টু’তেও তো সেই জিনিসের পুনরাবৃত্তি থাকছে?
পরিচালক ডেভিড ইয়েটসের কথা বিশ্বাস করলে বলতে হবে, একই ছবির দ্বিতীয় ভাগ হতে পারে, কিন্তু এটা হবে সম্পূর্ণ অন্য ধাতের জিনিস। টানটান উত্তেজনায় ঠাসা হ্যারি আর ভলডেমর্টের শেষ অঙ্কের লড়াই, মানে গোটা কয়েক নখ তো খুঁটে শেষ হবেই, কিন্তু পরিচালক কথা দিয়েছেন ছবিটা হবে ‘অপেরাটিক, কালারফুল আর ফ্যান্টাসি-ওরিয়েন্টেড’। অপেরার মতো সুর আর ছন্দের মসৃণ ওঠা-পড়া থাকবে, রং-ঝলমলে সেট আর নিসর্গ পাবেন (যেমন অনেকে ‘পার্ট ওয়ান’কে বলেছিলেন ভিজিট ব্রিটেন, মানে এখানকার পর্যটন বিভাগের বিজ্ঞাপন); আর সব চেয়ে বড় কথা, ছবিটা আপনাকে নিয়ে যাবে কল্পনা আর রূপকের এক স্বর্গীয় উচ্চতায়!
আজকের সমস্যা-কণ্টকিত ব্রিটেনের তো ঠিক এটাই চাই প্রতিটা জিনিসই একেবারে খাপে খাপে খেটে যায় দেশটার প্রয়োজনে, এবং আর্থসামাজিক বাস্তবতায়। সারা জীবন হ্যারি পটার এ দেশকে দু’হাত ভরে দিয়েছে, যাবার আগে শেষ বেলায় সে নিরাশ করবে তা কি হয়?
ব্রিটেনের দিন গিয়েছে, সন্ধেও নামে নামে, এখন হ্যারি কদ্দূর পার করাতে পারে আমরা সক্কলে সাগ্রহে সে দিকেই তাকিয়ে রইলাম!
First Page Patrika Next Item


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.