কলকাতা-ভিত্তিক একটি সংস্থা ‘টেকনো ইন্ডিয়া গ্রুপ’। তাদের কাজকর্মের প্রধান ক্ষেত্র শিক্ষা। শিক্ষার প্রসার নিয়ে নানা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তারা যুক্ত। তাদের পরিচালনাধীন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান সারা দেশে ছড়িয়ে আছে। শিক্ষা ছাড়াও সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই তাঁরা যথেষ্ট অবদান রেখেছে। এর মধ্যে চিত্রকলার প্রসারে তাদের উদ্যোগ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের ছবি তাঁরা সংগ্রহ করেন। নবীন শিল্পীদের তাঁরা নানা ভাবে উৎসাহিত করে। সল্টলেকের সেক্টর-পাঁচ-এ ইতিমধ্যেই তারা গড়ে তুলেছে একটি ‘আর্ট আর্কাইভ’। ভবিষ্যতে একটি স্থায়ী শিল্প-সংগ্রহশালাও গড়ে তোলার পরিকল্পনা আছে। চিত্রকলা নিয়ে এ রকম নানা প্রকল্পের অঙ্গ হিসেবেই তারা মাঝে-মধ্যে প্রতিষ্ঠিত ও নবীন শিল্পীদের একত্রিত করে শিল্পকর্ম শিবিরের আয়োজন করেন। সেখানে শিল্পীরা ছবি আঁকেন। পরস্পরের মধ্যে চিন্তাভাবনার বিনিময় হয়। বিনিময় হয় সাধারণ দর্শকের সঙ্গেও। এতে দর্শকের নান্দনিকবোধ সমৃদ্ধ হয়।
সম্প্রতি ‘মল্লার’ শিরোনামে এ রকমই একটি কর্মশিবিরের আয়োজন করেছিল তারা। এটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল কলকাতার বিবাদী-বাগের পশ্চিম প্রান্তের গঙ্গাবক্ষে ‘ফ্লোটেল’ নামে হোটেলের চারতলার একটি বড় হল জুড়ে। নদীতে ভাসমান এই পান্থশালায় শিল্পীরা ছবি এঁকেছেন। পশ্চিমে গঙ্গার বিস্তৃত পরিসর জুড়ে প্রবহমান জলস্রোত তাঁদের সৃজনপ্রক্রিয়ার প্রেক্ষাপট হিসেবে কাজ করেছে। এ বারের কর্মশালায় ১৩ জন শিল্পী অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ১৯৬০-এর দশক থেকে ১৯৮০-র দশকের মধ্যে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন এই সব শিল্পী। কয়েক জন ছিলেন যাঁরা ১৯৯০-এর দশকে কাজ শুরু করেছেন। |
ষাটের দশকের শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন বিজন চৌধুরী, প্রকাশ কর্মকার, যোগেন চৌধুরী, ধীরাজ চৌধুরী। সত্তরের দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন অলোক ভট্টাচার্য, কাঞ্চন দাশগুপ্ত ও দেবব্রত চক্রবর্তী। ওয়াসিম কপূর, আদিত্য বসাক ও সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৮০-র দশকেই নিজস্বতায় পৌঁছেছিলেন। এর পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন অতীন বসাক ও ছত্রপতি দত্ত। শিবিরে অংশগ্রহণকারী নবীনতমা শিল্পী ছিলেন তমালী দাশগুপ্ত।
এই শিল্পী নির্বাচনের মধ্য দিয়েই বোঝা যায়, আয়োজক সংস্থা চায় এই কর্মশিবির থেকে উঠে আসুক ১৯৬০-এর দশক থেকে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত বাংলার চিত্রকলার বিবর্তনের একটি চালচিত্র। এখানে আঁকা হল যে সব ছবি সেগুলি সংগৃহীত হবে তাদের পরিকল্পিত স্থায়ী সংগ্রহশালায়।
এখানে অন্তর্ভুক্ত ষাটের শিল্পীদের সকলেই সমাজবাস্তবতামূলক প্রতিবাদী চেতনাকে তাঁদের প্রকাশের একটি বিশেষ মাত্রা করে তুলেছিলেন। সেই সঙ্গে তাঁদের লক্ষ ছিল শিল্পের স্বকীয় আত্মপরিচয় গড়ে তোলা। এ জন্য পাশ্চাত্য আধুনিকতাবাদী আঙ্গিকের সঙ্গে দেশীয় ঐতিহ্যের সমন্বয় ঘটাতে চেষ্টা করেছেন তাঁরা। প্রকাশ কর্মকারের ছবির প্রথম পর্বে মানবতার অবক্ষয় রূপায়িত হত আদিমতা ও অভিব্যক্তিবাদের সমন্বয়ে। এখন তিনি যে নিসর্গ আঁকেন তার আপাত প্রশান্তির ভিতরেও সংক্ষুব্ধ তমসার কিছু অবশেষ খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবাদী চেতনাই যোগেন চৌধুরীর ছবির মূল উপজীব্য। তাঁর ছবির অভিব্যক্তিবাদী বা কল্পরূপাত্মক অনুষঙ্গের মধ্যেও বাংলার লৌকিকের রেখার বিন্যাস বিশেষ মাত্রা সৃষ্টি করেছে। লৌকিক আঙ্গিক দ্বারা এক সময় উদ্বুদ্ধ হয়েছেন বিজন চৌধুরীও। ধীরাজ চৌধুরীর দীর্ঘায়ত শীর্ণ অবয়বের কল্পরূপাত্মক প্রতিমাকল্পে দেশীয় ঐতিহ্যের নিবিষ্ট ভূমিকা থাকে।
কাঞ্চন দাশগুপ্ত ও ওয়াসিম কপূরের ছবির মূল ভিত্তি অনুপুঙ্খ স্বাভাবিকতা। তার ভিতর দিয়েই দু’জন দু’ভাবে প্রবহমান জীবনের শূন্যতার পরিসরকে রূপবদ্ধ করেন। দেবব্রত চক্রবর্তীর ছবিতে প্রাচ্যচেতনা ও পুরাণকল্পের কিছু অনুষঙ্গ থাকে। অলোক ভট্টাচার্যেরও মূল ভিত্তি স্বাভাবিকতা। আদিত্য বসাকের ছবিতে ফ্যানটাসি বা কল্পরূপ নানা ভাবে বিবর্তিত হয়ে এসেছে। গভীর জীবনবোধ ও বাস্তবচেতনা তাঁর ছবির বৈশিষ্ট। অতীন বসাক যদিও ১৯৯০-এর দশকের শিল্পী, তবু তাঁর ছবিতে পূর্ববর্তী প্রজন্মের অধ্যাত্মচেতনার কিছু অনুষঙ্গ এক সময় ছিল। তা থেকেই এখন উঠে আসছে কল্পরূপাত্মক প্রতিবাদী চেতনা। উত্তর-আধুনিক মনন ও আঙ্গিক নিয়ে নিবিষ্ট ভাবে যাঁরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন ছত্রপতি দত্ত তাঁদের অন্যতম। এই কর্মশিবিরের কাজেও এর পরিচয় আছে। |