|
|
|
|
শিশুকে কেন ‘রেফার’, এখন থেকে লিখতে হবে হাসপাতালের খাতাতেও |
নিধিরাম বিসি রায়ে মেলে না রক্ত, নেই সিটি স্ক্যান |
নিজস্ব সংবাদদাতা• কলকাতা |
এ যেন এক ‘নেই’-এর রাজ্য!
২০০২ এবং ২০০৮-এ ক’দিনের ব্যবধানে বেশ কিছু শিশুর মৃত্যুর পরে হাসপাতালের পরিকাঠামো ঢেলে সাজার আশ্বাস দিয়েছিল রাজ্য সরকার। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র রেফারেল শিশু চিকিৎসাকেন্দ্র বিসি রায় শিশু হাসপাতালে সক্রিয় ভেন্টিলেটরের সংখ্যা চার থেকে আর বাড়েনি। তৈরি হয়নি রুগ্ণ নবজাতকদের পরিচর্যাকেন্দ্র, নেই স্ক্যান, নেই ব্লাড ব্যাঙ্ক। প্যাথোলজির ল্যাবও নিষ্ক্রিয়!
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ওই হাসপাতালে যে সব শিশু আসে, তাদের ৬০ শতাংশের শ্বাসকষ্ট থাকে। নানা ধরনের জ্বরের রোগীও আসে প্রচুর। পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পাওয়া বাচ্চার সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু জ্বরের জন্য রক্ত পরীক্ষার ল্যাবরেটরিই নেই হাসপাতালে! মাথার চোট কতটা, তা দেখার জন্য নেই সিটি স্ক্যানের বন্দোবস্ত। আর কোনও শিশুর অস্ত্রোপচারের পরে রক্তের দরকার পড়লে ছুটতে হবে এ দিক-ও দিক।
মঙ্গলবার রাত থেকে ৩৬ ঘণ্টায় ওই হাসপাতালে ১৮টি শিশুর মৃত্যুর পরে দু’-দু’টো তদন্ত কমিটি গড়েছিল রাজ্য সরকার। তিন সদস্যের এক কমিটিতে ছিলেন হাসপাতালের অধ্যক্ষ, সুপার ও পেডিয়্যাট্রিকের প্রধান। দুই সদস্যের অন্য কমিটিতে ছিলেন আরজিকরের চিকিৎসক মলয় দাশগুপ্ত এবং এনআরএসের চিকিৎসক বীরেন রায়।
|
|
ছেলেকে ভর্তি করেও উৎকণ্ঠা কাটছে না মায়ের। শুক্রবার
বিসি রায় হাসপাতাল চত্বরে ছবিটি তুলেছেন সুমন বল্লভ। |
শিশুমৃত্যু নিয়ে রোগীর আত্মীয়দের মূল অভিযোগ ছিল, এক শ্রেণির চিকিৎসক ও নার্স তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন। দুই কমিটিই চিকিৎসক ও নার্সদের কোনও গাফিলতি খুঁজে পায়নি বলে স্বাস্থ্য-সচিব মানবেন্দ্রনাথ রায় জানিয়েছেন। তবে পরিকাঠামোর নিরিখে হাসপাতালে যে ফাঁক রয়েছে, তা শুক্রবার স্বীকার করেছেন স্বাস্থ্য-সচিব। ওই ফাঁক ভরাট করতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
মানবেন্দ্রবাবু বলেন, জেলার হাসপাতালগুলোয় রুগ্ণ নবজাতক পরিচর্যাকেন্দ্র (সিক নিউবর্ন কেয়ার ইউনিট) গড়ে না-তোলা পর্যন্ত এই সমস্যা মিটবে না। কিন্তু বিসি রায়েই যেখানে এখনও তা খোলা যায়নি, সেখানে জেলায় জেলায় খোলার পরিকল্পনা কি অবাস্তব নয়? কেন এখনও বিসি রায়ে ওই কেন্দ্র খোলা হল না?
হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, জুলাই থেকেই তাঁদের ৪০ শয্যার ওই কেন্দ্র চালু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার জন্য যন্ত্রপাতি, অক্সিজেন লাইন কিছুই আসেনি। এ দিন স্বাস্থ্য-সচিব নিজে গিয়েছিলেন হাসপাতালে। তাঁর কাছে সাহায্যের আর্জি জানান চিকিৎসকেরা। অধ্যক্ষ মৃণালকান্তি চট্টোপাধ্যায় বলেন, “কিছু অসুবিধা ছিল। তবে অগস্টে ওই কেন্দ্র চালু হয়ে যাবে।”
অল্প ব্যবধানে এতগুলো শিশুর মৃত্যুর কারণ কী?
শিশু চিকিৎসকেরা বলছেন, জুন-জুলাইয়ে আবহাওয়ার কারণে শিশুদের জ্বর-সর্দি-শ্বাসকষ্ট-ভাইরাল সংক্রমণ-আন্ত্রিকের মতো রোগ বেশি হয়। ফলে হাসপাতালে রোগী আসার হার বাড়ে। উপরন্তু গুরুতর অসুস্থদের দূর জেলা থেকে কলকাতায় আনতে-আনতে তাদের অবস্থা আরও খারাপ হয়। এ দিনও বিসি রায়-কর্তৃপক্ষ বলেছেন, মঙ্গলবার রাত থেকে ৩৬ ঘণ্টায় যত শিশু এসেছিল, তাদের অধিকাংশ ছিল মরণাপন্ন। যাবতীয় পরিষেবা দিয়েও তাদের বাঁচানো যায়নি। এই মুহূর্তে হাসপাতালে এমন আরও প্রায় ১০-১১টি শিশু ভর্তি রয়েছে, যাদের অবস্থা অতি সঙ্কটজনক।
২০০২-এ শিশুমৃত্যুর ঘটনার পরে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সূর্যকান্ত মিশ্র প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছিলেন, হাসপাতালে ইনকিউবেটর, নিওনেটাল কিট, পোর্টেবল এক্স-রে মেশিন, সেমি অটো অ্যানালাইজারের মতো ১১ ধরনের যন্ত্র দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সিটি স্ক্যান বা ব্লাড ব্যাঙ্কের কথা কেন মনে হল না?
অধ্যক্ষ মৃণালকান্তিবাবু বলেন, “স্বাস্থ্য ভবন থেকে কোনও পরিকল্পনা তৈরি হয়নি। আমরা কী করব? এ বার দিয়েছে। তাই এ বার হবে।” কিন্তু গত প্রায় দেড় বছর ধরে হাসপাতালের হাই রিস্ক ওয়ার্ড, রেসপিরেটরি কেয়ার ওয়ার্ড এবং পেয়িং ওয়ার্ড সম্পূর্ণ বন্ধ কেন? অধ্যক্ষের ব্যাখ্যা, “বাড়ি সংস্কারের জন্য স্বাস্থ্য দফতরের অনুমতি নিয়েই ওগুলো বন্ধ রাখা হয়েছিল।” এরই মধ্যে একটি তথ্য এ দিন সামনে এনেছেন হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ। তাঁরা বলছেন, গত বছর অর্থাৎ ২০১০-এর জুনে বিসি রায়ে মোট ২৮৩টি শিশু ভর্তি হয়েছিল। তাদের মধ্যে মারা গিয়েছিল ৮৭ জন। সেখানে চলতি বছর জুনে ভর্তি হয়েছে ৩৯৫টি শিশু। তাদের ৮৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। সেই হিসেবে ২০১০-এর জুনে মৃত্যুর হার ছিল ৩০.৭৪%, এ বার তা ২১.৮%। অর্থাৎ পরিকাঠামোগত সমস্যা থাকলেও শিশুমৃত্যুর হার কমেছে বলে হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষের দাবি। বিসি রায়ে শিশুমৃত্যু নিয়ে প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিম এ দিন বলেন, “স্মরণযোগ্য কালের মধ্যে এত কম সময়ে এত শিশু মারা যায়নি। এই দুর্ভাগ্যজনক, দুঃখজনক ঘটনার পরে সরকারের বিভিন্ন দফতর ও রোগীদের পরিবারের মধ্যে ভারসাম্য রেখে কাজ হবে, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এর পরেও রাজনৈতিক বক্তব্য পেশ করা হচ্ছে সরকারের তরফে! রাজনৈতিক চাপানউতোরের সময় এটা নয়।” |
|
|
|
|
|