|
|
|
|
শিশুকে কেন ‘রেফার’, এখন থেকে লিখতে হবে হাসপাতালের খাতাতেও |
দায় এড়ানোর জেরেই বিপর্যস্ত শিশু চিকিৎসা |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
বামনগাছির তমালের মেনিনজাইটিস ধরা পড়েছিল।
ছ’বছরের বাচ্চাটিকে শুধু স্যালাইন আর একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে বারাসত হাসপাতালের ডাক্তারেরা রায় দিয়েছিলেন, ‘এখানে আর কিছু করা যাবে না। বাঁচাতে হলে আরজিকরে নিয়ে যেতে হবে।’
মুর্শিদাবাদে রানিনগরের বাসিন্দা আনারুলের ছ’দিনের ছেলে মানারুল জন্ডিসে ভুগছে। রানিনগরের সরকারি হাসপাতাল তাকে বহরমপুর স্টেট জেনারেল হাসপাতালে পাঠিয়েছিল। তারা এক দিন রেখে ‘রেফার’ করে দেয় বিসি রায় হাসপাতালে। হতদরিদ্র আনারুল জমি বাঁধা রেখে বাচ্চাকে কলকাতায় এনে ভর্তি করেছেন। গাড়ি ভাড়াই যে তিন হাজার টাকা!
বসিরহাটের ১৬ দিনের শিশু ঋজু মণ্ডল জ্বরে ভুগছিল। ওখানকার ডাক্তার তার গায়ে হাত দিয়েও দেখেননি, পত্রপাঠ পাঠিয়ে দিয়েছেন বিসি রায়ে। মহকুমা কিংবা জেলা হাসপাতালের কথা তাঁর মনেই আসেনি!
জেলাস্তরে স্বাস্থ্য-পরিকাঠামোর উন্নতিতে রাজ্য সরকার কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে বটে, কিন্তু জেলা বা মহকুমা হাসপাতালের ‘দায়বদ্ধতা’ নির্দিষ্ট করে দেয়নি। যার খেসারত দিচ্ছে আমজনতা। প্রয়োজন থাকুক বা না-থাকুক, ন্যূনতম নিয়ম না-মেনে প্রথম চোটেই তমাল-মানারুল-ঋজুদের ‘রেফার’ করে দেওয়া হচ্ছে কলকাতায়। এবং কলকাতায় এসে লাভের লাভ তো কিছু হচ্ছেই না, উল্টে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে দিতে অসুস্থ শিশু আরও নেতিয়ে পড়ছে। তাকে নিয়ে মহানগরের ভিড় উপচানো হাসপাতালে মা-বাবা যখন ঢুকছেন, অনেক ক্ষেত্রেই কিছু করার থাকছে না।
|
শিশু চিকিৎসক কোথায়, কত জন |
|
|
এবং এরই পরিণতি বিসি রায়ের সাম্প্রতিক বিপর্যয়। নিয়ম না-মানা রেফারেল সিস্টেমের ‘অতিসক্রিয়তা’ রাজ্যের চিকিৎসা পরিকাঠামোকে কতটা বেহাল করে দিয়েছে, বিসি রায় শিশু হাসপাতালে দেড় দিনে ১৮টি শিশু মৃত্যুর ঘটনায় তা আরও এক বার সামনে এল। বাঁচানোর জন্য যাদের কলকাতায় আনা হয়েছিল, হাওড়ার সেই অভিজিৎ প্রতিহার, ক্যানিংয়ের আরিয়ান গাজি, বনগাঁর সখী মণ্ডল কিংবা তমলুকের আফরিন খাতুনের আর বাড়ি ফেরা হল না।
জেলা হাসপাতাল কী ভাবে দায় ঝেড়ে কলকাতায় রোগী পাঠায়, বামনগাছির তমালের পরিবারের সে অভিজ্ঞতা হয়েছে। ম্যানেনজাইটিসে আক্রান্ত ছেলেটিকে বারাসত হাসপাতাল রেফার করেছে আরজিকরে। অথচ সংক্রামক রোগের জন্য নির্দিষ্ট রয়েছে বেলেঘাটার আইডি হাসপাতাল। অর্থাৎ, কোনও তথ্য না-দেখেই রোগীকে কলকাতায় পাঠানো হয়েছে। অন্য দিকে আরজিকরে রোগীর চাপ বেশি বলে বাড়ির লোক তমালকে নিয়ে এসেছেন বিসি রায়ে।
দায় এড়ানোর প্রবণতা ও সমন্বয়ের অভাবের মাসুল এ ভাবেই গুনছে শিশুরা। স্বাস্থ্যের দায়িত্বে থাকা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বাস্থ্য দফতরের কর্তাদের কাছে প্রশ্ন তুলেছেন, মহকুমা হাসপাতালে না-থাকুক, জেলা হাসপাতালে কেন গুরুতর অসুস্থ শিশুর চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকবে না? কেন তাদের কয়েকশো মাইল উজিয়ে কলকাতায় নিয়ে আসতে হবে?
স্বাস্থ্য-কর্তাদের কাছে ব্যাপারটা অবশ্য মোটেই নতুন নয়। ২০০২ এবং ২০০৮-এ ওই বিসি রায় হাসপাতালেই অল্প সময়ে বেশ কিছু শিশুর মৃত্যুর পরে এ নিয়ে কম চর্চা হয়নি। যদিও তাতে তমাল-মানারুল-ঋজুদের কলকাতায় পাঠানো বন্ধ করা যায়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিয়মেরও ধার ধারা হচ্ছে না। অন্য হাসপাতালে রেফার করতে হলে ‘কারণ’টা রোগীর কার্ডে লিখে দেওয়ার কথা। বিধি অনুযায়ী, নির্দিষ্ট কারণ না-দেখিয়ে অন্যত্র রোগী রেফার করা যায় না।
কিন্তু গোটাটাই কাগজে-কলমে। নিয়ম কেউ মানেন না, এবং সে জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয় না। যেমন, মানারুলের কার্ডে লেখা ‘রেফারড টু বিসি রায় হাসপাতাল।’ তমাল মজুমদারের কাগজেও বারাসত হাসপাতাল স্রেফ ‘রেফারড টু আরজিকর’ লিখে দায় সেরেছে। বনগাঁ হাসপাতাল থেকে আসা দশ মাসের রিপন মণ্ডলের কাগজেও ডাক্তার লিখেছেন সেই একটাই কথা। কেন ওদের কলকাতায় পাঠানো হচ্ছে, তার কোনও উল্লেখ কোথাও নেই।
জেলা হাসপাতালগুলোর যুক্তি, তাদের পরিকাঠামো নেই। মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রোজ গড়ে ১৭০ জন ভর্তি হন। এর মধ্যে কলকাতায় স্থানান্তরিত করা হয় গড়ে ৮ জনকে। মেদিনীপুর থেকে কলকাতা অন্তত দু’ঘণ্টার রাস্তা। তার মধ্যে অনেকের অবস্থার অবনতি হয়। বহরমপুর জেলা হাসপাতালের ডাক্তারেরা জানিয়েছেন, সেখানে শিশুদের জন্য বরাদ্দ ২৫টি শয্যায় প্রায় সর্বদা ভর্তি থাকে অন্তত ৫০টি শিশু। চিকিৎসক সাকুল্যে চার জন!
দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলপি আবার অন্য সমস্যাকে তুলে ধরছে। গত সোমবার সেখানকার এক নার্সিংহোমে সময়ের চার মাস আগে জন্ম হয়েছিল এক শিশুর। ডাক্তারেরা জানিয়ে দেন, আশপাশের কোথাও এমন কম ওজনের অপরিণত শিশুর দেখভালের ব্যবস্থা নেই। ফলে তাকে কলকাতায় আনা ছাড়া বাড়ির লোকের গতি ছিল না। এ দিকে বিসি রায়ের ‘হাই রিস্ক ওয়ার্ড’ও দেড় বছর যাবৎ বন্ধ। ফলে এখানে এসেও খুব যে সুরাহা হয়েছে, তা নয়।
অন্য দিকে শিশু পড়ে গিয়ে বমি করলে যে চিকিৎসাটুকু গ্রামীণ হাসপাতালে দেওয়ার কথা, সেটাও জেলায় মিলছে না। পড়ে আহত হওয়া বনগাঁর দোগাছিয়ার দশ মাসের রিপনকে যেমন রাখতে চায়নি বনগাঁ হাসপাতাল। তাদের যুক্তি ছিল, রিপনের সিটি স্ক্যান করা দরকার। তাই তারা বিসি রায়ে রেফার করে দেয়। কিন্তু এখানে এসে বাড়ির লোক জানতে পারেন, বিসি রায়েও সিটি স্ক্যান হয় না! এ দিকে বাচ্চার অবস্থা অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। অগত্যা ঝুঁকি না-নিয়ে রিপনকে বিসি রায়েই ভর্তি করতে বাধ্য হন ওঁরা। হাসপাতাল সূত্রের খবর, তার অবস্থা আশঙ্কাজনক।
মুখ্যমন্ত্রী শুক্রবারও অভিযোগ তুলেছেন, গত ৩৪ বছরের বাম জামানায় শিশু চিকিৎসা-সহ রাজ্যের সার্বিক চিকিৎসা-পরিকাঠামোয় যে কতটা গলদ, বিসি রায়ের ঘটনায় তা আরও বেআব্রু হয়ে গিয়েছে। মমতার কথায়, “বিগত সরকার ত্রুটিগুলো বোঝার ও জানার চেষ্টা করেনি। সমস্তটা চেপে রেখেছে। ফলে সেগুলো এখন ভীষণ আকার নিচ্ছে।”
স্বাস্থ্য দফতরের রেকর্ড বলছে, কলকাতার আশপাশের এক-একটা জেলা থেকে গড়ে ৮-১০টি শিশুকে প্রতি দিন কলকাতায় পাঠানো হয়। এর মধ্যে সকলেই যে কলকাতার হাসপাতালে বেড পায়, তা নয়। শহরে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে কেউ কেউ মারাও যায়। জেলাগুলোয় কেন উন্নত পরিষেবা দেওয়া যাচ্ছে না?
দক্ষিণ ২৪ পরগনার স্বাস্থ্য-কর্তারা জানিয়েছেন, পরিকাঠামোর অভাব তো আছেই, উপরন্তু চিকিৎসকদের একাংশের দায় এড়ানো মনোভাবই এ জন্য দায়ী। হাওড়ার স্বাস্থ্য-কর্তারা একই ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বর্ধমান-বাঁকুড়া-নদিয়া থেকেও মিলেছে একই বক্তব্য। প্রতিকার কী?
নির্বিচারে রেফার করার প্রবণতা রুখতে ইতিমধ্যে ‘রেফার রেজিস্টার’ তৈরির কথা ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্য দফতর। কোনও রোগীকে কেন রেফার করা হচ্ছে, কোন পরিকাঠামো না-থাকায় রেফার করা হচ্ছে, রেজিস্টারে তা সবিস্তার জানাতে হবে। পাশাপাশি যেখানে রোগী পাঠানো হচ্ছে, সেই ‘রেফারেল’ হাসপাতালকেও খতিয়ে দেখতে হবে, ওই বক্তব্য ঠিক কি না।
আরও দাওয়াই দিচ্ছে প্রশাসন। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “রাজ্যের ব্লকস্তরে ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং জেলায় সুপার স্পেশালিটি সেন্টার থাকলে শহরের হাসপাতালে এত রোগীর চাপ বাড়ে না।” সেই সূত্র ধরে রাজ্যের স্বাস্থ্য-সচিব মানবেন্দ্রনাথ রায়ের ঘোষণা, “চলতি বছরেই বিভিন্ন জেলায় মোট কুড়িটি সিক নিউবর্ন কেয়ার ইউনিট খোলা হবে। তা হলে রাজ্যে শিশুদের একমাত্র রেফারেল হাসপাতাল বিসি রায়ের উপরে চাপ কমবে।”
বিসি রায়ে ২০০২ সালে ২৪ ঘণ্টায় দশটি এবং ২০০৮-এ ৪৮ ঘণ্টায় ১৫টি শিশুর মৃত্যুর পরে বামফ্রন্ট সরকার পরিকাঠামো গড়ে তোলার প্রায় একই ধরনের পরিকল্পনা আউড়েছিল। এ বার নতুন সরকারের প্রতিশ্রুতি কতটা কাজে পরিণত হয়, সেটাই দেখার। |
|
|
|
|
|