প্রতি পক্ষ
পর্দার নেপথ্যে
পনার কষ্ট হয় না? মানে, একটা গ্লানি বা ওই ধরনের কিছু...
আচমকা এই প্রশ্নবাণে চন্দন রায়সান্যাল মোটেই বিস্রস্ত হলেন না, এমনকী অবাকও হলেন কি না বোঝা গেল না, শুধু আলতো হেসে বললেন, কেন?
ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা-র ছাত্র, হবিব তনবির-এর মতো মানুষের সঙ্গে কাজ করেছেন, অথচ আপনাকে দেখলেই লোকে চিৎকার করে, ‘মিখাইল মিখাইল’, মানে ‘কামিনে’...
কিন্তু, এটাই তো হওয়ার ছিল, আপনি কি অন্য রকম কিছু আশা করেছিলেন? চন্দন একই রকম সপ্রতিভ, এবং সটান।
না, মানে, ধরুন এই যে আপনি নিজের গাঁটের কড়ি দিয়ে মঞ্চে ব্রেশট-এর নাটক প্রযোজনা করেছেন, প্রসেনিয়ন প্রডাকশনস নামে আপনার একটা নিজস্ব নাট্যদল আছে, ‘কামিনে’-র সময়েই আপনি মুম্বইয়ের একটি প্রেক্ষাগৃহে ব্রেশট-এর ‘দ্য রাইজ অ্যান্ড ফল অব দ্য সিটি অব মহগিনি’ অবলম্বনে নাটক মঞ্চস্থ করেছেন, লোকে যদি সে সব খবর রাখতেই না চায়, একটা খারাপ লাগা কাজ করে না?
করে না, কারণ আমি জানি যে এটাই হওয়ার, এটাই হবে। আচ্ছা, কেট ব্ল্যানশেট বলতেই কী মনে পড়ে বলুন তো?
ওই তো শেখর কপূর-এর ‘এলিজাবেথ’ ছবিটায় যিনি ‘এলিজাবেথ’ করেছিলেন... ঠিক। আরও একটু মনে করলে হয়তো বলবেন, ‘লর্ড অব দ্য রিংস’, বা মার্টিন স্করসিস-এর ‘অ্যাভিয়েটর’-এ ছিলেন, সেরা সহ-অভিনেত্রীর ‘অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড’-ও পেয়েছিলেন, কিন্তু ভদ্রমহিলা যে খুবই উঁচু মানের মঞ্চাভিনেত্রী, স্বামী অ্যান্ড্রু আপটন-এর সঙ্গে তিনিও যে সিডনি থিয়েটার কম্পানি-র ‘আর্টিস্টিক ডিরেক্টর’, সেটা ক’জন মনে রাখেন? সিডনিতে এক বার ওঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। উনিও জানেন, লোকজনের কাছে হলিউডই ওঁর পরিচয়।
সুতরাং, এখানে লোকে যদি আমাকে দেখে ‘মিখাইল মিখাইল’ বলে চেঁচায়, একটুও অবাক হই না। সিনেমা এখানে জনজীবনের যে স্তর পর্যন্ত গিয়েছে, নাটক আদপেই ততটা যায়নি। চলচ্চিত্র উৎসব যে মাপে হয়, নাটক নিয়ে উৎসব তার ভগ্নাংশও হয় না। আগামী পঞ্চাশ বছরেও হবে বলে মনে হয় না। তাই এ রকমই চলবে।
চন্দন রায় সান্যাল এ রকমই সুবিন্যস্ত। প্রশ্ন করা হলে উত্তর তৎক্ষণাৎ, এবং অতিরিক্ত কিছু নয়। খানিকটা আঁচ করা যায়, কেন গণিতে সাম্মানিক স্নাতক পড়তে গিয়েছিলেন। যা চান, মোটেই ভুল করে চান না, এবং ঠিকঠাক খেয়াল রাখেন, কী ভাবে স্ফূর্তির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া যায় পরিমিতিবোধ। অথচ, জীবনের সেই মিতব্যয়ী ধাঁচেই যে আটক পড়বেন, তা নয়। তা না হলে সব ছেড়েছুড়ে ‘দিল চাহতা হ্যায়’ দেখে বিরাট অনুপ্রাণিত হয়ে কেউ আচমকা মুম্বই পাড়ি দেয়! তার পরে প্রচুর লড়াই, বিশাল ভরদ্বাজের সঙ্গে পরিচয়, তার পরে ‘কামিনে’, এবং বাকিটা ছোটখাট একটা ইতিহাসের শুরু। চন্দন নিজেই বলেন, বিশাল-এর সঙ্গে আলাপ একটা ‘ঘটনা’, কারণ শুধু ‘কামিনে’-ই নয়, প্রয়োজনে আরও নানা ব্যাপারে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন বিশাল। একটা ছবির ‘অফার’ এসেছে, সেই চরিত্রটা করব কি না, কিংবা ব্রেশট-এর অমুক নাটকটা পাচ্ছি না, নিজের সংগ্রহ থেকে সেটি পড়তে দেওয়া, চন্দন রায়সান্যালের কাছে বিশাল ভরদ্বাজ খুব বড় একটি আশ্রয়।
সেই জন্যই কি আপনি বলেছেন যে, ‘কামিনে’-র হিরো তো আসলে বিশাল ভরদ্বাজ!
চন্দন হাসলেন।
ফের বলা হল, লোকে যতই বলুক ‘চার্লি’, মানে শাহিদ কপূর ওই ছবির ‘নায়ক’, দেখলাম আপনি একটা সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ও সব হিরো-ফিরো বাজে কথা...হিরো তো আসলে বিশাল ভরদ্বাজ!
চন্দন হাসতে হাসতে বললেন, এখনই বললেন না, ‘চার্লি’, মানে শাহিদ কপূর-ই হিরো...
হ্যাঁ, ‘চার্লি’, মানে শাহিদ কপূরের দ্বৈত চরিত্র, তার একটা নাম তো ‘চার্লি’-ই ছিল!
হুঁ, ঠিক। কিন্তু, কথাটা একটু ভুলও। ছবিটার মুখ্য একটা চরিত্র ‘চার্লি’, গল্পটা অনেকটা তাকে নিয়েই চলেছে, সেই অর্থে যদি ধরেন তা হলে ‘চার্লি’ হয়তো ‘হিরো’, কিন্তু কোনও এক জন অভিনেতা সেই চরিত্রে অভিনয় করেছেন, তিনি হঠাৎ ‘হিরো’ হতে যাবেন কেন?
চন্দন, এ সব তো ব্রেশটিয় কথাবার্তা, ‘চরিত্র’ এক, অভিনেতা ‘এক’, তিনি অভিনয়ের সময় চরিত্রে মধ্যে ঢুকছেন...
না, এটা নিছকই তাত্ত্বিক কচকচি নয়। আমি বিশ্বাস করি যে ‘হিরো’ শব্দটা আমরা একটু ভুল ভাবে ব্যবহার করি। ক্যামেরার সামনে বিরাট নাচ-গান-মারামারি করলেন যিনি, তাঁকে হঠাৎ ‘হিরো’ বলে মানতে হবে কেন? আমাদের সবারই নিজের নিজের মনে এক-একটা ‘হিরো’ থাকে, থাকে না, বলুন? আজ আমিও তো আমার ভাইয়ের কাছে ‘হিরো’ হতে পারি, ও ভাবতে পারে, ঠিক আছে, সব ছেড়েছুড়ে মুম্বই গিয়ে শেষে একটা জায়গায় তো এসেছে দাদা, আমি ওর কাছে ‘হিরো’-র আসন পেতেই পারি, তাই ‘হিরো’ বলতে কী বুঝব, তা নিয়ে একটু ভাবনাচিন্তা দরকার।
জুন মাসের ভিজে কলকাতায় এ রকমই অনেক কথা হল চন্দন রায়সান্যালের সঙ্গে। ‘অপরাজিতা তুমি’ ছবির শুট উপলক্ষে কিছু দিন পরেই পাড়ি দেবেন বিদেশ।
শেষ প্রশ্ন ছিল, বছর পাঁচেক পরে নিজেকে কোথায় দেখতে চান?
বাফটা, গোল্ডেন গ্লোব, অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড।
আর নাটক?
ব্রডওয়ে।
চন্দন রায়সান্যালের হাসি বৃষ্টি-দিনে রোদ্দুরের মত ঝিলিক দিল!
Previous Story

Kolkata

Next Story




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.