ব্যাগ গুছিয়ে...

মেঘেরা চলে চলে যায়...
খানে রোদ্দুর ঢাকা পড়েছে মেঘের আস্তরণে। আমরা হঠাৎই পৌঁছে গিয়েছি যেন মেঘের এক সাম্রাজ্যে, যেখানে শনশনে হাওয়ায় কনকনে ঠান্ডার ছোবল। অথচ রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে একাধিক তুষারমণ্ডিত পর্বতশৃঙ্গ নাকি এখানে ফ্যাশন-প্যারেড করে। কিন্তু আজ তারা সবাই এখন মেঘের বোরখার আড়ালে।
দোচু-লা। ৩১১০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই গিরিপথ ধরেই থিম্পু থেকে পুনাখা বা ওয়াংদি-ফোদ্রুং পৌঁছতে হয়। রোদ-ঝলমলে সকালে থিম্পু থেকে রওনা হয়ে দোচু-লার পাঁচ কিলোমিটার আগে যখন সঘন পাইনের ছায়াঘেরা ছোট্ট, সুন্দর জনপদ হংৎসোতে পৌঁছলাম, তখনও নীল আকাশে রোদের মেলা। অথচ সেখান থেকে টানা চড়াইপথে দোচু-লায় পৌঁছতেই আবহাওয়ার আমূল পরিবর্তন। পাহাড়ের মাথায় প্রায় গোলাকার এক সমতলভূমি। ঠিক তার মাঝখানে ধাপে ধাপে ১০৮টি চোর্তেনের সমাহারে নির্মিত হয়েছে একটি বৃহৎ গোলকার চোর্তেনমঞ্চ। সেখানেও সমানে চলেছে মেঘ-আলোর লুকোচুরি খেলা। আর এক পাশে দোচু-লা মনাস্ট্রি। ভুটানি কারুকার্য সম্বলিত সুন্দর একটি তোরণদ্বার পেরিয়ে অনেকখানি সিঁড়ি গিয়ে উঠেছে মনাস্ট্রিতে। ভারি সুন্দর পরিবেশ।
উড়ন্ত মেঘের আর্দ্র-আদর গায়ে মেখে চোর্তেনমঞ্চের বুকে ঘুরে বেড়ানো ও দোচু-লা মনাস্ট্রি দর্শনের পরে প্রায় আধ ঘণ্টার অপেক্ষাতেও মেঘরাজের মানভঞ্জন হল না। ফলে তুষারমণ্ডিত শৃঙ্গ দর্শনের সাধ অপূর্ণ রেখেই আমাদের এগোতে হল ওয়াংদি-ফোদ্রংয়ের (চালু নাম ‘ওয়াংদি’) পথে।
দোচু-লার পরে পথ আবার নিম্নমুখী। আর উচ্চতা হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গেই মেঘের জাল ছিঁড়ে ধীরে ধীরে দেখা দিচ্ছে নীল আকাশ, খাদের ও পারের পাহাড়ে জেগে উঠছে ছোট ছোট সুন্দর উপত্যকা আর ধাপচাষের নয়নাভিরাম শোভা। পথের পাশে বহু দূরে দূরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দু-চারখানা গ্রাম্য কুঁড়ে, আর বাড়ির উঠোনের মতো সংলগ্ন কিছুটা জমিতে বিবিধ শাকসব্জির চাষ। নজর কাড়ে এ পথে গ্রাম্য ভুটানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। সুমসৃণ পথে লাম্পেরে, থিল্যেগাঁও পেরিয়ে
পৌঁছলাম লোম্বেসায়। এখানে থেকেই বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে একটি রাস্তা গিয়েছে পুনাখায়। আর সোজা পথে আমরা চললাম ওয়াংদির উদ্দেশে। আমাদের গাড়িচালক দোরজি অবশ্য গাড়ি নিয়ে থামাল মূল ওয়াংদির কিমি তিনেক আগেই ‘কিংগালিং-গেস্টহাউস’ নামে একটি হোটেলের দরজায়।
প্রথম দর্শনেই মন কেড়ে নিল ওয়াংদি। হোটেলের পিছন দিয়ে বয়ে চলেছে পুনাচু নদী (এখানে ‘পুনাচু’কে অনেকেই ‘ওয়াংদি-চু’ও বলেন)। তার এক পাড়ে বিস্তীর্ণ উপত্যকা জুড়ে চোখ জুড়ানো চাষের ক্ষেত ও আর এক পাড়ের ঢাল বেয়ে অনুচ্চ পাহাড়ের কোলে সাজানো-গোছানো ওয়াংদি-গ্রামের অনাড়ম্বর বাড়িঘর। চোখ ফেরানো মুশকিল। ব্যালকনিতে বসেই সময় কেটে যায় অনায়াসে।
বিকেলে চললাম ওয়াংদি-শহর ও ওয়াংদি-জং দেখতে। ৪৪৩০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত বেশ পুরনো শহর, ছোট, কিন্তু জমজমাট। শহরের কেন্দ্রে একটি তিন মাথার মোড়ের এক দিকে বাসস্ট্যান্ড। বাকি দু’দিকে পরপর নানা রকম দোকানপাট। জংয়ে ঢোকার মুখেই ডান দিকে পার্কিংজোন। সেখান থেকে অনেকটা নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী, তার পাড়ে অবস্থিত পাশাপাশি সাতটি চোর্তেন, পাশে সর্পিল রাস্তা আর দূরের বিস্তৃত উপত্যকার সমাহার যেন ক্যানভাসে আঁকা ছবি।
সুপ্রাচীন ওয়াংদি জংয়ের ভিতরে অনেকটা খোলা আয়তাকার জায়গা। তার পরিসীমা জুড়ে একের পর এক ঘর। দোতলা। ভুটান সরকারের বেশ কিছু স্থানীয় অফিস রয়েছে সেখানে। আর বাঁ দিকের প্রান্তিক ঘরটিতে রয়েছে ধর্মীয় পাঠশালা। সেখানে বহু লামা-ছাত্রকে এক জন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে পাঠরত অবস্থায় দেখলাম।
পরের দিন প্রাতরাশ সেরে রওনা হলাম পুনাখার উদ্দেশে। থিম্পু ও পারোর পরে ভুটানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর পুনাখাভুটানের পূর্বতন রাজধানী। পুনাখা-ভ্রমণের মূল আকর্ষণ হল পুনাখার প্রাকৃতিক দৃশ্য ও সুবিশাল ঐতিহ্যশালী অসাধারণ সুন্দর পুনাখা-জং।
ওয়াংদি থেকে লোবেসা হয়ে ডান দিকে বাঁক নিয়ে খুরথাং পৌঁছতেই ডান দিকে সঙ্গী পেলাম পুনাচুকে। আরও কিলোমিটারখানেক পরে পথের ডান দিকেই দু’টি নদীর সঙ্গমস্থল। পুনাখা-জংয়ের পাশ দিয়ে বয়ে আসা নদী পুনামোচু ও জংয়ের পিছন দিক থেকে বয়ে আসা নদী পুনাফোচু (সংক্ষেপে মোচু ও ফোচু)-র মিলিত ধারাই পুনাচু নামে প্রবাহিত হয়েছে ওয়াংদির দিকে।
পুনামোচুর উপর ৫৫ মিটার লম্বা একটি কাঠের সেতু পেরিয়ে পুনাখা-জংয়ে প্রবেশ করতে হয়। পুরনো সেতুটি নষ্ট হয়ে যাওয়ার পরে জার্মান সরকারের সহায়তায় নির্মিত এই সেতুটির উদ্বোধন হয় ২০০৮ সালের ১০ মে। সেতুটির গঠনশৈলীও আকর্ষণীয়।
প্রায় দোতলা সমান উঁচু কাঠের সিঁড়ি চড়েই কড়া সিকিউরিটি চেকিং ও পারমিট পরীক্ষার পরে জংয়ে প্রবেশের অনুমতি পেলাম। শুরুতেই অনেকখানি উন্মুক্ত ও সুপরিচ্ছন্ন আঙিনা, সেখানে বড় একটি চোর্তেন ও ধর্মীয় তাৎপর্যবাহী একটি অশ্বত্থগাছ। আরও ভিতরে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য বিরাট হলঘর। সব শেষে সুসজ্জিত এক বুদ্ধমন্দির। মন্দিরের প্রবেশদ্বারের ডান পাশের দেওয়ালে রয়েছে ভুটানি লোকগাথায় ‘জীবনচক্র’-র ছবি। আর ভিতরে বুদ্ধদেবের বিশাল স্বর্ণমূর্তি ও অসীম নীরবতা।
আয়তন, নির্মাণশৈলী ও কাঠের নকশার নিরিখে পুনাখা-জং যেমন এক কথায় অনন্য ও যথেষ্ট সুপরিকল্পিত, তেমনই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণও বটে। ঐতিহাসিক ভাবেই ভুটানরাজের রাজ্যাভিষেকও হয় এই জংয়েই অবস্থিত প্রধান লামার দফতরে।
জং দেখে বেরিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজের বিরতি খুরথাংয়ের ‘তাসি ইয়ারফেল’ হোটেলে। পরবর্তী গন্তব্য ‘রয়্যাল বোটানিক্যাল পার্ক’। ফিরতি পথে দোচু-লার ১১ কিলোমিটার আগে। এখানে পাহাড়ের গায়ে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হেঁটে এই ইকোপার্কে ঘুরে দেখলাম বিভিন্ন প্রজাতির রডোডেনড্রনের চারা ও নানাবিধ ভেষজ উদ্ভিদ। গাছপালা-জঙ্গলে ঘেরা নাতিবৃহৎ একটি প্রাকৃতিক হ্রদও এই পার্কের অন্যতম আকর্ষণ। এ ছাড়া আছে একটি ছোটখাটো মিউজিয়াম। আর আছে একটি চিলড্রেন পার্ক। প্রকৃতির কোলে ঘুরে বেড়িয়ে তার নৈসর্গিক শোভা উপভোগ করতে গিয়ে অনেকটাই সময় কাটিয়ে ফেললাম এখানে।
দোরজির তাড়ায় আবার গিয়ে বসতে হল গাড়িতে। এ বার ফেরার পালা। বিদায় ওয়াংদি। বিদায় পুনাখা।
কী ভাবে যাবেন
কলকাতা থেকে ট্রেনে আলিপুরদুয়ার অথবা হাসিমারা। সেখান থেকে বাসে বা গাড়িতে জয়গাঁ
অথবা ফুন্টশোলিং হয়ে থিম্পু। থিম্পু-ওয়াংদি ও থিম্পু-পুনাখা রুটে বাস সার্ভিস চালু থাকলেও
প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে যাওয়াই ভাল। দরাদরি চলে। ১০ জনের বেশি বড় দল হলে
প্রয়োজনমতো আসনসংখ্যা অনুযায়ী ছোট বাসও ভাড়া নিতে পারেন।
কোথায় থাকবেন
পুনাখা এবং ওয়াংদিতে হোটেলভাড়া বেশ বেশি। তবে ভারতীয়দের জন্য বিশেষ ছাড় আছে। তার
পরেও দরাদরি চলে। মনে রাখবেনভুটানের প্রায় সব শহরেই একটি করে জং আছে। ‘জং’-এর অর্থ
ফোর্ট বা কেল্লা। প্রতিটি জং-ই খোলা থাকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। বিনা পারমিটে জংয়ে প্রবেশ করা যাবে না।
থিম্পুর ইমিগ্রেশন অফিস থেকে আলাদা পারমিট বানাতে হবে ওয়াংদি ও পুনাখার জন্য। তার জন্য
ফুন্টশোলিংয়ে বানানো পারমিট, সচিত্র পরিচয়পত্র ও ২-৩ কপি ফটো প্রয়োজন। ঠান্ডার পোশাক নেবেন।
পথে কোথাও চায়ের দোকান নেই। তাই চা-প্রেমীরা চা-ব্যবস্থা সঙ্গে রাখুন। প্রকাশ্যে ধূমপান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
Previous Item

Kolkata

Next Item




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.