|
|
|
|
৪৮ ঘণ্টায় মৃত ১৮ শিশু, উত্তপ্ত বি সি রায় |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
ন’বছর আগে ২৪ ঘণ্টায় ১০টি শিশুর মৃত্যু হওয়ার পরে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছিলেন, “অস্বাভাবিক কিছু হয়নি। সব ঠিক আছে।” ন’বছর পরে সেই বিধানচন্দ্র রায় (বি সি রায়) শিশু হাসপাতালে ৪৮ ঘণ্টায় ১৮টি শিশুর মৃত্যুর পরে মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “ওঁরা আমাকে বলছেন, এ রাজ্যে নাকি এ রকম হয়ে থাকে। আগেও হয়েছে। কিন্তু আমি এর বিস্তারিত জানতে চেয়েছি। তদন্ত কমিটি গড়া হয়েছে। সমস্ত বিষয়ে নজর রাখছি।”
শিশু-মৃত্যু নিয়ে বৃহস্পতিবার দিনভর উত্তপ্ত ছিল বি সি রায় শিশু হাসপাতাল। হাসপাতাল সূত্রেরই খবর, মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার রাত পর্যন্ত ১২টি এবং বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত আরও ৬টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এদের অধিকাংশই সদ্যোজাত। এর পরেই চিকিৎসক ও নার্সদের বিরুদ্ধে চিকিৎসায় গাফিলতি ও দুর্ব্যবহারের অভিযোগ এনে ক্ষোভে ফেটে পড়েন মৃত শিশুদের পরিজনেরা। তাঁদের অভিযোগ, ওষুধ এনে দেওয়া সত্ত্বেও ঠিক সময়ে তা খাওয়ানো হয়নি। চিকিৎসকেরা শিশুদের ভাল করে দেখেননি। সময়মতো দেওয়া হয়নি অক্সিজেন। ‘সুবিচারের’ দাবিতে হাসপাতালের সামনে ঘণ্টাখানেক পথ অবরোধও করেন তাঁরা।
দুর্ব্যবহারের অভিযোগ পুরোপুরি উড়িয়ে দিতে না-পারলেও চিকিৎসায় গাফিলতির কথা অস্বীকার করেছেন হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ। তাঁদের দাবি, শিশুরা অন্য হাসপাতাল থেকে ‘রেফারড্’ হয়ে আসার সময়েই তাদের শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিল। ফলে তাদের মৃত্যুর জন্য বি সি রায় হাসপাতালকে দায়ী করা যায় না।
কর্তৃপক্ষ দাবি করেছেন, এর সঙ্গে গাফিলতির সম্পর্ক নেই। কাকতালীয় ভাবে গত ৪৮ ঘণ্টায় যে সব শিশু ‘রেফারড্’ হয়ে এসেছে, অধিকাংশই মরণাপন্ন ছিল। ওই শিশুদের বয়স ১ দিন থেকে ১০ মাসের মধ্যে। কারও ওজন ছিল অত্যন্ত কম, কারও সেপ্টিসেমিয়া, হৃদ্যন্ত্রের সমস্যা বা মেনিনজাইটিস ছিল। সর্বোত্তম চিকিৎসা দেওয়া সত্ত্বেও তাদের বাঁচানো যায়নি। |
|
সন্দেশখালির বাসিন্দা, ন’মাসের আরিয়ান গাজির মৃত্যুতে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন তার বাবা-মা।
বৃহস্পতিবার, বি সি রায় শিশু হাসপাতালে। —দেশকল্যাণ চৌধুরী |
মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সন্ধ্যায় পাঠানো রিপোর্টে স্বাস্থ্য দফতর জানিয়েছে, ১৮টি শিশুর মধ্যে চারটি শিশুর বিশদ তথ্য মেলেনি, বাকি ১৪ জনকেই বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে সঙ্কটজনক শারীরিক অবস্থায় পাঠানো হয়েছিল। কয়েক জন এসেছিল দূর দূরান্ত থেকে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, “শিশু-মৃত্যু যতই দুঃখজনক হোক, যে ভাবে ওই শিশুদের পাঠানো হয়েছিল, তাতে তাদের মৃত্যুর দায় সরাসরি ওই হাসপাতালের উপরে বর্তায় না।” পাশাপাশি, সরকারি হাসপাতালের হাল নিয়ে পূর্ববর্তী সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “৩৪ বছরের শাসনে হাসপাতালের কী হাল হয়েছিল, আজকের ঘটনা তা দেখিয়ে দিল। আজ যাঁরা এ সব নিয়ে আঙুল তুলছেন, এটা তাঁদের ভাবা উচিত।”
অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ নিয়ে এই টানাপোড়েন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল মুখ্যমন্ত্রী এ দিন মহাকরণে আরও বলেছেন, “শিশু-স্বাস্থ্য নিয়ে কোনও রকম অবহেলা মানব না। আমি স্বাস্থ্যসচিবকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম। শোনা যাচ্ছে, শিশুদের খুব খারাপ অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল। তবে সরকারের তরফে কোনও অবহেলা হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে। যদি গাফিলতি পাওয়া যায়, কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” মমতা আরও বলেন, “ওঁরা আমাকে জানান, আটটি শিশুর ওজন খুব কম ছিল। আর দু’টি শিশুর হৃদ্যন্ত্রে গুরুতর সমস্যা ছিল। তাদের এক জনকে কলকাতারই একটি বেসরকারি হাসপাতাল ওটি-তে নিয়ে গিয়েও অস্ত্রোপচার করেনি। পরে তাকে বি সি রায়ে আনা হয়। আমি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছি। অন্য হাসপাতালের দু’জন বিশেষজ্ঞ তদন্ত করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমাকে রিপোর্ট দেবেন।”
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, ওই দুই বিশেষজ্ঞ হলেন, আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মলয় দাশগুপ্ত ও নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বীরেন রায়। তিন সদস্যের কমিটি গড়ে ঘটনার আলাদা তদন্ত করছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও।
বি সি রায়ে এ বারের শিশু-মৃত্যুর ঘটনার তদন্ত দাবি করেছেন প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং অধুনা বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রও। আগের বারের ঘটনার পরে বি সি রায়ে পরিকাঠামোগত কিছু উন্নতি হয়েছিল বলে জানিয়ে সূর্যকান্তবাবু বলেন, “আগের চেয়ে পরিকাঠামো এখন ভাল হওয়া সত্ত্বেও কী ভাবে এমন ঘটল, তদন্ত করে দেখতে হবে। কমিটি গঠিত হয়েছে। তারা কী বলে, দেখা যাক।”
তবে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ভেঙে পড়ার অভিযোগ মানতে নারাজ সূর্যকান্তবাবু। বরং তিনি বলছেন, “পরিকাঠামো উন্নতির কোনও শেষ নেই। এখন যেটা উন্নত, কয়েক দিন পরেই তার আরও উন্নতির দরকার হয়ে পড়বে।” এর পাশাপাশিই অবশ্য শিশু-মৃত্যু নিয়ে তাঁরা রাজনীতি করতে চান না বলেও জানিয়ে দিয়েছেন বিরোধী দলনেতা। |
|
এক শিশুর দেহ নিয়ে হাসপাতাল ছাড়ছেন তার আত্মীয়। নিজস্ব চিত্র |
এ দিকে, শিশুমৃত্যুর ঘটনার পরেই স্বাস্থ্যকর্তাদের কাছে ইস্তফা দিতে চেয়েছেন বি সি রায় হাসপাতালের সুপার দিলীপ পাল। যদিও তাঁর ইস্তফা এখনও গ্রহণ করা হয়নি। দিলীপবাবুর কথায়, “গত কয়েক বছরে এ রকম একটা পরিস্থিতি এড়াতে আমি আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। তার পরেও যখন সেটা হল, এর জন্য আমি দায়ী। তাই এই পদ থেকে সরে গিয়ে সাধারণ চিকিৎসক হিসেবে কাজ করতে চাই। শুধু এটুকু বলব যে, চিকিৎসকদের তরফে কোনও গাফিলতি ছিল না।”
মৃত শিশুর আত্মীয়েরা অবশ্য কোনও কথাতেই কান দিতে চাননি। বুধবার রাতে প্রবল জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে এম আর বাঙুর হাসপাতাল থেকে ‘রেফারড্’ হয়ে আসে সন্দেশখালির বাসিন্দা ন’মাসের আরিয়ান গাজি। বৃহস্পতিবার সকালে তার মৃত্যু হয়। তার বাবা হান্নান মোল্লার অভিযোগ, “রাতে যা ওষুধ, ইঞ্জেকশন আনতে বলেছে মরতে-মরতে এনেছি। কিন্তু সব দেরি করে দিল। বাচ্চাটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল। ডাক্তারবাবুর পায়ে ধরলাম, কিন্তু তিনি বললেন, ‘ন্যাকামি করবেন না।’ আমরা গরিবেরা কোথায় যাব?” একই অভিযোগ চুঁচুড়া হাসপাতালে ভর্তি শ্রাবণী ঘোষের দিদি সোনালি দাসের। শ্রাবণীর দু’দিন বয়সী শিশুকে এ দিন ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ চুঁচুড়া হাসপাতাল থেকে বি সি রায়ে আনা হয়। শিশুটির শ্বাসকষ্ট ছিল। পরে সে মারা যায়। সোনালিদেবী কাঁদতে-কাঁদতে বলছিলেন, “এ ভাবে বাচ্চাগুলো মারা গেলে কে আর এখানে আসবে!” |
• ২০০৯-এ রাজ্যে সদ্যোজাতের মৃত্যুর হার
প্রতি হাজারে ৩৩, এই মুহূর্তে ৩০-এর নীচে। |
• ২০০৯-এর হিসেবে সদ্যোজাতের মৃত্যুর হারে
পশ্চিমবঙ্গ চতুর্থ (কেরল, তামিলনাড়ু ও মহারাষ্ট্রের পরে)। |
• রাজ্যে প্রতি বছর জন্মানো প্রায় ১৫ লাখ শিশুর মধ্যে মারা যায় প্রায়
৪০ হাজারের বেশি, যার দুই-তৃতীয়াংশের মৃত্যু হয় জন্মের প্রথম এক মাসে। |
• নিওনেটাল কেয়ারে ভর্তি শিশুদের মৃত্যুর হার ১৫-২০
শতাংশ। বি সি রায় হাসপাতালেও সেই একই হার প্রযোজ্য। |
বস্তুত, পরিকাঠামো ভাল বা চিকিৎসায় কোনও গাফিলতি নেই বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দাবি করলেও রাজ্যে শিশুদের এই একমাত্র রেফারাল হাসপাতালে কোনও সিটি স্ক্যান হয় না। নেই ব্লাড ব্যাঙ্কও। রাতবিরেতে গুরুতর অসুস্থ শিশুর স্ক্যান দরকার হলে বা রক্ত লাগলে কী হবে, কেউ জানে না। শুধু তা-ই নয়, গত প্রায় দেড় বছর ধরে হাসপাতালের হাই রিস্ক ওয়ার্ড, রেসপিরেটরি কেয়ার ওয়ার্ড ও পেয়িং ওয়ার্ড সম্পূর্ণ বন্ধ। ওই তিন ওয়ার্ড মিলিয়ে মোট ৯০টি শয্যা (প্রত্যেকটিতে ৩০টি করে)। যাদের চিকিৎসা সবচেয়ে জরুরি ভিত্তিতে হওয়ার কথা, বিভাগগুলি বন্ধ থাকায় দিনের পর দিন সেই সঙ্কটজনক শিশুদেরই ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। |
|
|
|
|
|