|
|
|
|
ভুয়ো কার্ড চিহ্নিত করতে উদ্যোগী প্রশাসন |
আরামবাগে জনসংখ্যা-রেশন কার্ডের সংখ্যায় ফারাক প্রচুর |
পীযূষ নন্দী • আরামবাগ |
ভুয়ো রেশন কার্ড উদ্ধারে আরামবাগ মহকুমা প্রশাসন ও মহকুমা খাদ্য সরবরাহ দফতর নড়েচড়ে বসলেও এখনও পর্যন্ত নির্দিষ্ট সমাধান সূত্র অনুযায়ী কার্যকরী পদক্ষেপ করা সম্ভব হয়নি।
খাদ্য দফতর সূত্রের খবর, আরামবাগের ৬টি ব্লকের মোট রেশন কার্ডের সংখ্যা ১৩,৩২,২২৬টি। অন্য দিকে, ২০১১ সালের জনগণনায় দেখা যাচ্ছে, এই মহকুমায় জনসংখ্যা ১১ লক্ষ ৮৫ হাজারের মতো। অর্থাৎ, জনসংখ্যার তুলনায় রেশন কার্ড বিলি হয়েছে দেড় লক্ষের কিছু কম। গত মার্চ মাস থেকে ভুয়ো রেশন কার্ড সম্পর্কে এই নির্দিষ্ট তথ্য হাতে থাকা সত্ত্বেও মহকুমা প্রশাসন ও খাদ্য দফতর কার্যকরী পদক্ষেপ করেনি বলে অভিযোগ। যদিও সংশ্লিষ্ট বিডিওদের দাবি, মাস খানেক আগে ভুয়ো রেশন কার্ড নিয়ে তদন্ত করতে গেলে রাজনৈতিক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। সিপিএম-তৃণমূল দু’পক্ষই অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের অভিযোগ, নানা দুর্নীতির মূলে খাদ্য সরবরাহ দফতর নিজেই। যেমন, রেশন ডিলারদের সঙ্গে খাদ্য দফতরের এক শ্রেণির অফিসারদের অশুভ আঁতাত আছে। পঞ্চায়েত সদস্যদের সঙ্গে দফতরের অফিসারদের একাংশের যোগসাজশে নানা দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে ওই দফতরে। রেশনের অব্যবস্থা নিয়ে যে সব তৃণমূল নেতা সরব হয়েছিলেন, তাঁদেরও কারও কারও মদত আছে এই দুর্নীতিতে।
আরামবাগের গৌরহাটি গ্রামের শ্যামল চক্রবর্তী, পুড়শুড়ার ডিহিবাতপুরের বৃন্দাবন মালিক, খানাকুলের মাড়োখানা এবং পোল গ্রামের রমজান আলি, ভগবতী রায়, গোঘাটের বদনগঞ্জের সুকুমার কুণ্ডুদের মতো রেশন গ্রাহকদের বক্তব্য, বিলি-বণ্টন সঠিক হচ্ছে কিনা, কেউ দেখে না। কেরোসিন কখনও আসেনি বলে দাবি করে দেয় না ডিলারেরা। কখনও নির্ধারিত পরিমাণের থেকে কম পাওয়া যায়। রেশনের চিনি-চাল-গম সবই উধাও হয়ে যায়। ডিলারদের কাছে কিংবা সংশ্লিষ্ট পঞ্চায়েতের ক্ষোভ-বিক্ষোভ দেখিয়েও সুরাহা হয় না। মহকুমা খাদ্য দফতর থেকে বলা হয়, লোকবল নেই। তাই কাজের গতি নেই। নিয়মিত নজরদারি চালিয়ে দুর্নীতির প্রতিকারও করা যাচ্ছে না সে কারণেই। কর্মচারী বাড়লেই নজরদারি বাড়বে।
খাদ্য সরবরাহ দফতরের স্বচ্ছতা যাঁদের উপরে নির্ভর করে, সেই পরিদর্শকদের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম, সে কথা সত্যি। আরামবাগ মহকুমার কথাই ধরা যাক। মুখ্য পরিদর্শক ৩ জনের জায়গায় আছেন মাত্র ১ জন। পরিদর্শকের সংখ্যা ৬ জনের জায়গায় আছেন ৪ জন। আর যাঁদের রেশন দোকানগুলিতে সরেজমিনে যাওয়ার কথা, সেই অবর পরিদর্শকের পদ ১৪ জন। সেখানে আছেন মাত্র ৫ জন। প্রধান করণিক নেই। অন্য কর্মীর সংখ্যা ১০ জনের জায়গায় মাত্র ২ জন। সর্বোপরি, যিনি মহকুমা খাদ্য নিয়ামক, সেই কাশীনাথ দলুই হুগলি জেলার তিনটি মহকুমার দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। এই মহকুমায় রেশন ডিলারের সংখ্যা ৩১৯ জন।
কাশীনাথবাবু জানালেন, প্রয়োজন মতো পরিদর্শক না থাকায় রেশন কার্ড বিলি, ভুয়ো রেশন কার্ড বাতিল, ফর্ম যাচাই করা প্রভৃতি রেশন-সংক্রান্ত কোনও কাজই সুষ্ঠু ভাবে হচ্ছে না। তাঁর বক্তব্য, “দুর্নীতি ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট গ্রাম পঞ্চায়েতগুলির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি পঞ্চায়েত স্তরে তদারক কমিটি আছে। তাঁরা যথাযথ উদ্যোগী হননি। গ্রাম সংসদের সাহায্যে বিপিএল তালিকায় ভুল ভাবে ঢুকে পড়া পরিবারগুলিকে চিহ্নিত করতে পারলে সমস্যা অনেকটা কমবে। আমাদের দফতরে ১৯৯৭ সালের সার্ভে অনুযায়ী বিপিএল তালিকাভুক্তদের মাল বরাদ্দ হচ্ছে। ব্লক প্রশাসনের তরফে ২০০৫ এবং ২০০৭ সালের সার্ভে অনুযায়ী নতুন তালিকা হয়েছে। আবার রেশন কার্ডগুলি ১৯৮২ সালে দেওয়া। সেগুলির অধিকাংশের অস্তিত্ব নেই। কার্ড ছাড়াই অনেকে মাল তুলছেন। দফতরের সঙ্গে পঞ্চায়েতের সংযোগ ও সমন্বয়ের অভাব কাটিয়ে উঠতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
কিন্তু কী ভাবে এক ভুয়ো রেশন কার্ডের অস্তিত্ব সম্ভব?
বিভিন্ন ডিলার ও খাদ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, গ্রাহকদের মৃত্যুর পরেও সে খবর জানানো হয় না। পরিবারের মেয়েদের কারও বিয়ে হলে কিংবা কেউ বসবাসের জন্য অন্যত্র চলে গেলে সে খবর পৌঁছয় না খাদ্য দফতরের কাছে। এ ছাড়াও কিছু অসাধু ডিলার দফতরের অসাধু কর্মীদের সঙ্গে যোগাসাজশে বেনামে কার্ড বের করে।
মহকুমা রেশন ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক শ্যামাপ্রসাদ মণ্ডল বলেন, “দুর্নীতির দায় আমাদের ঘাড়ে না চাপিয়ে প্রশাসন সকলকে নতুন রেশন কার্ড দিক। নতুন কার্ড দেওয়ার কথা অনেক দিন ধরেই তো চলছে। কিন্তু মহকুমায় তা দু’চারটি করে মাত্র বিলি হচ্ছে।” শ্যামাপ্রসাদবাবুর মতে, বিপিএল, এপিএল, অন্ত্যোদয়, অন্নপূর্ণা যোজনার আওতায় আসা ব্যক্তিদের তালিকা চিহ্নিত করে নতুন করে কার্ড দিলে দুর্নীতি হবে না। তিনি বলেন, “অবণ্টিত মাল বিক্রি করে দেওয়া কিংবা বরাদ্দ অনুযায়ী মাল না দেওয়ার অভিযোগ উড়িয়ে দিচ্ছি না। কিন্তু তদারকি ব্যবস্থা নেই কেন?”ভুয়ো রেশন কার্ড উদ্ধারের দিশা নির্ণয়ের লক্ষে দিন কয়েক আগে মহকুমাশাসকের দফতরে একটি বৈঠক ডাকা হলেও সেখানে সমাধান সূত্র বেরোয়নি। ওই বৈঠকে বিডিওদের কিছু নির্দেশ দেন মহকুমাশাসক। বিডিও, পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি, গ্রাম পঞ্চায়েত এবং খাদ্য দফতরের আধিকারিকদের নিয়ে একটি কমিটি গড়ার নির্দেশ দিয়েছেন মহকুমাশাসক অরিন্দম নিয়োগী। সেই কমিটি কী ভাবে ভুয়ো রেশন কার্ড চিহ্নিত করবে তা পঞ্চায়েত সমিতিগুলিকে খাদ্য সরবরাহ স্থায়ী সমিতির বৈঠক ডেকে স্থির করতে হবে। কিন্তু পঞ্চায়েত কিংবা পঞ্চায়েত সমিতির সদস্যেরা অধিকাংশই গরহাজির থাকায় কোথাও ওই বৈঠক এখনও ডাকাই যায়নি। এ ক্ষেত্রেও সমস্যাটা যে রাজনৈতিক, তা মানছেন প্রশাসনের কর্তারা। আরামবাগের সমস্ত পঞ্চায়েত এবং পঞ্চায়েত সমিতিগুলি বাম পরিচালিত। বিধানসভা ভোটের ফল প্রকাশের পর থেকে তৃণমূলের হুমকিতে অনেকেই কাজে যোগ দিতে পারছেন না বলে অভিযোগ উঠৈছে বামেদের তরফে। পঞ্চায়েত-স্তরে অচলাবস্থা কাটাতে তৃণমূল নেতৃত্ব এবং প্রশাসন সক্রিয় হলেও সমস্যা এখনও পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা যায়নি। |
|
|
|
|
|