|
|
|
|
সম্পাদকীয় ২... |
সম-শ্রমিক |
শিক্ষার প্রসারের একটি গুণ আছে তাহা মধ্যবিত্তকে প্রাকৃত আচরণের উপর শিষ্টাচারের মোড়ক পরাইতে শিখাইয়াছে। ভাষার ক্ষেত্রেই যেমন। যাঁহারা পূর্বে ‘ঝি’ অথবা ‘চাকর’ নামে পরিচিত ছিলেন, মধ্যবিত্ত তাহাদের নাম দিয়াছে ‘কাজের লোক’। যাঁহাদের ভাষার শিষ্টতা আরও উচ্চমার্গের, তাঁহারা বলেন ‘গার্হস্থ্য সাহায্যকারী’। কেবল বাংলাতেই নহে, ইংরাজি ভাষাতেও এই বিবর্তন ঘটিয়াছে। সত্য, এই নূতন অভিধাগুলি শুনিতে ভাল। কিন্তু সমস্যা হইল, নাম পাল্টাইলেই তো মানসিকতা পাল্টায় না! বাড়ির কাজের লোকের সঙ্গে গৃহস্থের আচরণের সুরটি এখনও সামন্ততান্ত্রিক, যেখানে সামন্তপ্রভুর ইচ্ছাই সব। কাজের লোকের ছুটি প্রয়োজন হইলে তাহা মালিকের মর্জির উপর নির্ভর করে, বেতনবৃদ্ধির সিদ্ধান্তটিও। শ্রমিকের যে অধিকার বর্তমান দুনিয়ায় স্বীকৃত, এবং বাড়িতে কাজের লোক রাখিবার ক্ষমতাসম্পন্ন মধ্যবিত্ত তাঁহাদের কর্মক্ষেত্রে যে অধিকার ষোলো আনা ভোগ করেন, কাজের লোকদের ক্ষেত্রে সেই অধিকারের কোনও স্বীকৃতি নাই। যে মধ্যবিত্ত নিজের কর্মক্ষেত্রে আট ঘণ্টার অধিক কাজ না করিবার দাবিতে সদা-সরব, বাড়িতে সেই মধ্যবিত্তই কাজের লোককে দিনে চৌদ্দো ঘণ্টা খাটাইতে দ্বিধা করেন না। বাস্তবটি লজ্জার, কিন্তু সত্য। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন এই বাস্তবটি বদলাইতে সচেষ্ট হইল। একটি আন্তর্জাতিক কনভেনশন রচনার উদ্যোগ চলিতেছে। যে দেশগুলি সেই কনভেনশনে স্বাক্ষর করিবে, সেই দেশগুলিতে কাজের লোকের শ্রমিকের অধিকার আইনি ভাবে স্বীকৃত হইবে। এই আইনে কাজের সময় নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হইবে, মাতৃত্বের ছুটির ব্যবস্থা হইবে ইত্যাদি। ভারত এই প্রস্তাবে স্বাক্ষর করিয়াছে।
প্রস্তাবটির অভিমুখ স্পষ্ট ইহা সামন্ততন্ত্র হইতে ধনতন্ত্রের দিকে যাত্রা। আধুনিক অর্থনীতির ইতিহাস সাক্ষী, প্রকৃত ধনতন্ত্র শ্রমিকের অধিকারকে যতখানি নিষ্ঠাভরে রক্ষা করিয়াছে, অন্য কোনও ব্যবস্থা তাহা করিতে পারে নাই। ফলে, এই যাত্রাটি গুরুত্বপূর্ণ। আরও একটি কারণে এই যাত্রা গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বের সর্বত্রই গার্হস্থ্য সাহায্যকারীর পেশায় নারীর প্রাধান্য। এবং, তাঁহারা প্রধানত অর্থনৈতিক ভাবে পিছাইয়া পড়া শ্রেণির মানুষ। অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনের এই কনভেনশনটি সমাজের সর্বাপেক্ষা ‘দুর্বল’ শ্রেণির মানুষের অধিকারের অস্ত্র হইয়া উঠিতে পারে। সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ায় একটি আইন হইয়াছে সেই দেশের কোনও নাগরিক সৌদি আরবে গার্হস্থ্য সাহায্যকারীর কাজে যাইতে পারিবেন না। ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স ইত্যাদি দেশ হইতে বহু মহিলা আরব দুনিয়ায়, সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়ায় ‘কাজ করিতে’ যান। সৌদি আরবের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার কারণ, সেই দেশে গার্হস্থ্য সাহায্যকারীদের অবস্থা প্রায় অবর্ণনীয়। প্রস্তাবিত কনভেনশনটি কেন জরুরি, তাহা এই উদাহরণটিতেই স্পষ্ট।
সমস্যা একটিই। কনভেনশনটি আইনে পরিণত হইলে কাগজে-কলমে কাজের লোকদের শ্রমিকের অধিকার স্বীকৃত হইবে বটে, কিন্তু বাস্তবেও তাহা ঘটিবে কি? কনভেনশনটির গুরুত্ব এক বর্ণ অস্বীকার না করিয়াও প্রশ্নটি তোলা প্রয়োজন। ভারতের মানুষ অভিজ্ঞতায় জানেন, সামাজিক সদিচ্ছা ভিন্ন কোনও আইনই কার্যকর হইতে পারে না। বিশেষত ভারতের ন্যায় দেশে, যেখানে আইন না মানাই সাধারণ প্রবণতা। এই আইনটি তখনই কার্যকর হইতে পারে, যখন মধ্যবিত্ত বুঝিতে শিখিবে, যে মানুষটি তাহার বাড়িতে কাজ করে, সে-ও সম-শ্রমিক, সম-মানুষ। সামাজিক উচ্চাবচতা তাহার অধিকার হরণ করিতে পারে না। এই বোধটির জন্ম সমাজের উপর নির্ভরশীল। অন্তরের অন্তঃস্থল হইতে সামন্ততন্ত্রকে নির্মূল করিতে পারাই শিক্ষার, আধুনিকতার পরিচয়। এই একবিংশ শতকেও এই সামান্য কথাটি না বুঝিলে কীসের শিক্ষা, কীসের বিশ্ব-নাগরিকত্বের গৌরব? |
|
|
|
|
|