|
|
|
|
সম্পাদকীয় ১... |
বণ্টনের নীতি |
জমি বণ্টনের বিষয়ে হিডকোর চেয়ারম্যানের কোনও ‘কোটা’ থাকিবে না, ঘোষণা করিয়াছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি জানাইয়াছেন, কোনও মন্ত্রীরই কোনও ‘কোটা’ থাকিবে না। এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত। ইহা অবশ্যই দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের একটি প্রধান উপায়। যখনই কোনও ব্যক্তির উপর একক ভাবে সিদ্ধান্ত লইবার অধিকার ন্যস্ত হয়, তখনই নিয়মবহির্ভূত এবং অন্যায় সিদ্ধান্তের সম্ভাবনা বাড়ে। উপরন্তু, যে সকল ব্যক্তি সরকারি ক্ষমতার অন্যায় সুযোগ লইতে আগ্রহী, তাঁহাদের অনেকেই ওই সকল পদের জন্য তদ্বির করিতে থাকেন। মন্ত্রী, সাংসদ, কিংবা সরকারি পদাধিকারীদের ‘কোটা’ বিষয়ক সিদ্ধান্ত লইয়া যে বারবার দুর্নীতি এবং স্বজনপোষণের অভিযোগ উঠিয়াছে, তাহা আশ্চর্য নহে। কিন্তু দুর্নীতি প্রতিরোধই একমাত্র যুক্তি নহে, প্রধান যুক্তিও নহে। গণতান্ত্রিক প্রশাসনে ব্যক্তি অপেক্ষা প্রতিষ্ঠান বড়। কোন নাগরিকের কী প্রাপ্য, তাহা নির্দিষ্ট বিধিনিয়ম মানিয়া স্থির হইবে। কোনও ব্যক্তির বিবেচনা প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম অপেক্ষা বড় হইতে পারে না। বিধিনিয়ম যদি দুর্বল শ্রেণির মানুষের প্রতি যথেষ্ট সংবেদনশীল না হয়, তাহা হইলে সেগুলির রদবদল করিতে হইবে। আমলাতান্ত্রিকতা হইতে প্রতিষ্ঠানকে মুক্তি দিতে হইলে প্রতিষ্ঠানের কাজে সমাজের নানা ক্ষেত্রের মানুষকে যুক্ত করিতে হইবে। কিন্তু কোনও ব্যক্তি তাঁহার পদমর্যাদার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক নীতি অপেক্ষা অধিক গুরুত্বপূর্ণ হইতে পারেন না। তাহা গণতন্ত্রের মূল নীতির সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ। পূর্বে এ রাজ্যে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ‘কোটা’ ছিল। তাহা অপসারিত হইয়াছে, এবং তাহাতে ক্ষতি হয় নাই। ‘লাইসেন্স-পারমিট রাজ’ যে দুর্নীতি এবং অকর্মন্যতাকে বাড়াইয়াছে, সামাজিক ন্যায়ের বিস্তার করে নাই, তাহা স্বাধীনতার পর প্রথম চার দশকের অভিজ্ঞতাতেই স্পষ্ট হইয়াছে।
গণতন্ত্রে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মের বাহিরে ব্যক্তির উপর নির্ভর করা অনুচিত এবং বিপজ্জনক। সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায় তাহার প্রভূত সাক্ষ্য মিলিয়াছে। সাংসদ তহবিলের অব্যবহার এবং অপব্যবহারই সেই উদাহরণ। ১৯৯০ সালে প্রতি সাংসদের জন্য দুই কোটি টাকা বরাদ্দ করা হইয়াছিল। এই অর্থ নিজ নির্বাচনী ক্ষেত্রের উন্নয়নে তাঁহারা ব্যবহার করিতে পারেন। কার্যত দেখা গিয়েছে, বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যবহার হয় নাই, যাহা ব্যয় হইয়াছে তাহারও একটি বড় অংশ যথাযথ কাজে ব্যবহার হয় নাই। দরিদ্রের জন্য বাসস্থান বা রাস্তা নির্মাণ অপেক্ষা ধনীদের মন্দির কিংবা চার্চের বাহুল্য বাড়াইতে সাংসদদের উৎসাহ অধিক। সাংসদদের সই জাল করিয়া টাকা আদায় করা হইয়াছে, প্রদত্ত টাকার হিসাব পাওয়া যায় নাই, এমনও বহু ক্ষেত্রে ঘটিয়াছে। ইহা সত্ত্বেও যে মন্ত্রীরা আরও অধিক টাকা দাবি করিয়াছেন, এবং তাহা আদায়ও করিয়াছেন। এই বৎসর যোজনা কমিশনের আপত্তি সত্ত্বেও সাংসদ তহবিলের টাকা বাড়িয়া পাঁচ কোটি হইয়াছে। একই ভাবে কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়গুলিতে সাংসদদের কোটা তুলিয়া দিতে উদ্যোগ লইয়াছিলেন কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ মন্ত্রী কপিল সিব্বল। সর্বদলের সাংসদদের প্রবল বিরোধিতায় তাঁকে পিছাইয়া আসিতে হইয়াছে, যদিও তিনি নিজের কোটার দুটি আসন বিষয়ে সিদ্ধান্ত লইবার ক্ষমতা ত্যাগ করিয়াছেন। সাংসদরা গণতন্ত্রের সুযোগে ক্ষমতায় আসিয়া গণতন্ত্রকেই দুর্বল করিতেছেন, ইহা ভারতের দুর্ভাগ্য। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে স্রোতের বিপরীতে দাঁড়াইবার সাহস দেখাইয়াছেন, তাহা দেশবাসীকে আশ্বস্ত করিবে, সন্দেহ নাই। |
|
|
|
|
|