‘পরিবর্তনের’ অন্য যুদ্ধে আদিবাসী ঘরের চম্পারা
গ্যালারির নীচে এক ফালি ঘরে সূর্যালোক ঢোকে না। বাইরে ঝোপঝাড় পরিষ্কার করে আর কার্বলিক অ্যাসিড দিয়ে ঠেকানো সর্পকূলের অবাঞ্ছিত প্রবেশ! কিন্তু ভিতরে চন্দ্রনাথ কর্মকারের বাঁশি টুসুর সুর ধরলে লহমায় উড়ে যায় মলিন পরিপার্শ্ব। পড়শির কাছ থেকে চেয়ে-আনা বাঁশিতে গরিব ঘরের আদিবাসী ছেলে জীবনযুদ্ধে জেতার রসদ খোঁজে। গর্বিত দৃষ্টিতে তারিফ করেন শিক্ষকেরা।
চন্দ্রনাথের সঙ্গেই চম্পা সর্দার, সুদীপ্ত মাহাতো, শিশুরঞ্জন সর্দার, সুচিত্রা সর্দার, অমিতচন্দ্র ভকতদের জীবন এখন ‘পরিবর্তনে’ সমৃদ্ধ। বঙ্গ রাজনীতির অধুনা পরিচিততম শব্দ ‘পরিবর্তনে’র সঙ্গে এক পাল আদিবাসী ছেলেমেয়ের জীবন বদলানোর কাহিনির আপাতদৃষ্টিতে অবশ্য কোনও সম্পর্ক নেই। সল্টলেক স্টেডিয়ামে ‘অনীক নাট্যশিক্ষা কেন্দ্রে’র তত্ত্বাবধানে বছর বছর রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের আদিবাসী ঘরের তরুণ প্রজন্ম নাটকের তালিম নিচ্ছে। আদিবাসী জীবনের স্বাভাবিক উপাদান থেকে তুলে-আনা নাটক, সঙ্গে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির নানা ধারার নিরন্তর প্রশিক্ষণ। নাট্যশিক্ষা কেন্দ্রের ছোট্ট মঞ্চে তাদের শিক্ষা উপস্থাপিত হচ্ছে। তারা অংশ নিচ্ছে প্রতিযোগিতায়। নিজেদের এলাকায় ফিরে গিয়ে আরও নতুন মানুষকে তারা উদ্বুদ্ধ করছে এই বার্তা নিয়ে যে, শিকড়-বিচ্ছিন্ন হয়ে বেঁচে থাকা কঠিন। নাটক-সংস্কৃতির মোড়কেই তারা ছড়িয়ে দিচ্ছে পরিবেশ এবং জনস্বার্থের সচেতনতা।
জীবন পরিবর্তনের এই লড়াইয়ে চম্পা-সুদীপ্তদের উদ্বেগ একটাই। রাজ্যে ‘পরিবর্তনে’র জমানায় সল্টলেকের ঠিকানাটা থাকবে তো? সল্টলেক-সহ সব স্টেডিয়ামেই খেলার বাইরে কী কী ‘অবৈধ’ কার্যকলাপ চলছে, তার খতিয়ান নিচ্ছেন নতুন ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্র। স্টেডিয়াম কতৃর্পক্ষের কাছ থেকে ‘অনীক’ দু’টো ঘর ভাড়া দিয়ে লিজ নিয়ে রেখেছে ২০১৭ পর্যন্ত। সংস্থার আশা, বৈধ লিজ নিশ্চয়ই বাতিল হবে না। ক্রীড়ামন্ত্রীও তাদের বিষয়টি মাথায় রাখার আশ্বাস দিয়েছেন।
বামফ্রন্ট জমানাতেই আদিবাসী কল্যাণ দফতরের তত্ত্বাবধানে আদিবাসী ছেলেমেয়েদের প্রশিক্ষণের এই কর্মসূচি চালু হয়েছিল। এক একটি ব্যাচের সময় দু’বছর। বছরভর দফায় দফায় শিক্ষার্থীরা স্টেডিয়াম প্রাঙ্গণে ওই দু’টি ঘরে থেকেই প্রশিক্ষণ নেয়। শিক্ষান্তে শংসাপত্র। এখন যেমন ন্যাজাট, দেড়মজুর, মেটেখালি-সহ বসিরহাট এলাকা থেকে আগত ওরাওঁ সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। বিডিও থেকে শুরু করে প্রশাসনিক আধিকারিকেরা বরাবরই এই প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে এসেছেন। শিক্ষার্থী সন্ন্যাসী সর্দারের কথায়, “বিডিওদের বলে এলাকায় মহলার ব্যবস্থা করি। মাঝেমধ্যে অনুষ্ঠান করি। কালীপুজোর পরে যে সোহরাই উৎসব হয়, সেটা কাজে লাগে। টুসু, ঝুমুরের মতো আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি যাতে হারিয়ে না-যায়, তার জন্য স্যারদের কাছে শিখছি।” শুধু নাটকের শিক্ষণই নয়। সকালে শরীরচর্চা। বিকালে ফুটবল। সংস্থার অধ্যক্ষ এবং শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষক মলয় বিশ্বাস বলছেন, “ওদের জীবন থেকে নেওয়া ছন্দ কাজে লাগিয়েই আদিবাসী সংস্কৃতির প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সঙ্গে শরীরচর্চা এবং খেলাধুলো। যাতে ওদের মধ্যে সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনের অভ্যাস গড়ে ওঠে। প্রথম আসার সময় একেবারেই কুঁকড়ে থাকে। যত প্রশিক্ষণ এগোয়, ছন্দ স্বাভাবিক হয়।”
সুচিত্রার অভিজ্ঞতায়, “নিজেরাই বুঝতে পারছি, নিজেদের মধ্যে অনেকটা পরিবর্তন এসেছে। আগে কত কিছু জানতাম না! এখান থেকে শিখে বাড়িতে ফিরে আশেপাশের ছেলেমেয়েদের পরিবেশ-পরিচ্ছন্নতার কথা বোঝাই। সুস্থ ভাবে বাঁচতে গেলে কী করণীয়, নিজেরা শিখে অন্যকে শেখাই।” সুচিত্রার মতোই জড়তা ভেঙেছে চন্দ্রনাথের। তার কথায়, “আগে সব গ্রাম্য ব্যাপার ছিল। কুসংস্কার, ঝাড়ফুঁকে বিশ্বাস ছিল আমাদের এলাকায়। এখন লোকে বুঝছে। ওরাওঁ সম্প্রদায়ের কৃষ্টি রক্ষা করার পাশাপাশি সুস্থ ভাবে বাঁচার রাস্তা এলাকার মানুষকে দেখানোর জন্যেই এখানে আসা।”
সংস্থার সম্পাদক অমল চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “সুভাষ চক্রবর্তীর আমলে এই আস্তানা জুটেছিল। একটা ঘর ছিল পরিত্যক্ত শৌচাগার। আর একটা গুদামঘর। সেগুলোই পরিষ্কার করে এখনকার চেহারা দেওয়া হয়েছে। ওই আবর্জনা ব্যবহার করেই সামনের রাস্তাটা হয়েছে। ঝোপঝাড়ও নিজেরাই পরিষ্কার করেছি।” সংস্থার অন্যতম সংগঠক অভিজিৎ সেনগুপ্ত জানাচ্ছেন, তাঁদের এই প্রয়াস জারি রাখার জন্য নতুন সরকারের আদিবাসী-কল্যাণ মন্ত্রী উপেন বিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলতে চান।
উপেনবাবুর সঙ্গে অবশ্য বারংবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি। তবে ক্রীড়ামন্ত্রী মদন বলছেন, “স্টেডিয়াম খেলার চেয়ে অন্যান্য কাজে বেশি ব্যবহার হচ্ছিল। তাই পুরোটাই খতিয়ে দেখছি। ওঁদের (‘অনীক’) প্রতিনিধিরা শুভেচ্ছা জানাতে এসেছিলেন। ওঁদের বিষয়টা মাথায় রাখব।”
আশায় আছে চন্দ্রনাথের বাঁশি!
Previous Story Calcutta Next Story


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.