রবীন্দ্রনাথের জন্মের সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষে আকৃতি আর্ট গ্যালারি একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল। শিরোনাম ‘টেলস ফ্রম টেগোর’। রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্প অবলম্বনে ছবি এঁকেছেন ৯ জন শিল্পী। প্রত্যেকে এঁকেছেন দু’টি করে ছবি-একটি বা দু’টি গল্প অবলম্বনে। শিল্পীরা অভিজিৎ গুপ্ত, আদিত্য বসাক, চন্দ্র ভট্টাচার্য, ছত্রপতি দত্ত, প্রভাত বসু, প্রবীর গুপ্ত, রাজেশ দেব, শেখর রায় ও সৌরভ জানা।
সাহিত্য ও চিত্রকলা দু’টি আলাদা মাধ্যম। সাহিত্যের মধ্যে সময়ের প্রবহমানতা থাকে। ছবিতে একটি মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে থাকে। সেই স্তব্ধতাকে জঙ্গম করে তোলার মধ্যেই নিহিত থাকে চিত্রের শিল্প সৌকর্য। এ কারণে সাহিত্যের চিত্রায়নে একটি বিশেষ মুহূর্তকে বা বিশেষ দৃশ্যকেই চিত্রায়িত করেন শিল্পী। তাতে সেই গল্প বা কবিতার সম্পূর্ণ পরিমণ্ডলকে ধরা যায় না। এ জন্য সফল চিত্রায়ণে অনেক শিল্পীই ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করেন। রবীন্দ্র-সাহিত্যের চিত্রায়ণের ইতিহাস দীর্ঘ। ১৮৯১ সালে রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে অবনীন্দ্রনাথ এঁকেছিলেন ‘চিত্রাঙ্গদা’র জন্য ছবি। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত বহু শিল্পী এঁকেছেন বা আঁকছেন। ছবি যখন শুধু কাহিনির একটি মুহূর্তের চিত্র-রূপান্তর না হয়ে সেই কাহিনির মূল ভাবটিকে দৃশ্যভাষায় নির্মাণ করে, তখনই তা হয়ে ওঠে সার্থক চিত্রায়ণের দৃষ্টান্ত। গগনেন্দ্রনাথ যখন আঁকেন ‘রক্তকরবী’র ছবি (১৯২৬) বা নন্দলাল বসু যখন আঁকেন ‘সহজপাঠ’ -এর ছবি তখন তার মধ্যে পাওয়া যায় সেই সার্থকতার ইঙ্গিত।
আকৃতি গ্যালারি আয়োজিত আলোচ্য প্রদর্শনীতে শিল্পীরা এই দিকটি নিয়ে ভেবেছেন। তাঁরা গল্পের চিত্র-অনুবাদ করতে চাননি। গল্পের মূল ভাবটিকে মনে রেখে তাঁরা আঁকতে চেষ্টা করেছেন নিজের ছবি। ফলে রাবীন্দ্রিক অনুষঙ্গ আজকের সময়কে আত্মস্থ করে নতুন মাত্রায় অভিষিক্ত হয়েছে। অধিকাংশ ছবির সার্থকতা এখানে। |
অভিজিৎ গুপ্ত ডিজিটাল প্রিন্টে এঁকেছেন ‘তোতাকাহিনি’ ও ‘লিপিকা’-র গল্প অবলম্বনে দু’টি ছবি। ‘তোতাকাহিনি’-তে পাখির খাঁচায় বইয়ের গাদায় বন্দি একটি বালিকাকে দেখি। ইলাস্ট্রেশনের গতানুগতিক পদ্ধতি থেকে তিনি অবশ্য খুব দূরে যেতে পারেননি।
আদিত্য বসাক এঁকেছেন ‘ক্ষুদিত পাষাণ’ অবলম্বনে। টেম্পারা ও অ্যাক্রিলিক-ভিত্তিক মিশ্রমাধ্যমের দু’টি ক্যানভাসে। নিজস্ব আঙ্গিকে তিনি অতীতের বন্দিনী নারীদের আর্ত হাহাকারের বিমূর্ত আলোড়নকে রূপায়িত করতে চেষ্টা করেছেন। তা শুধু সেই গল্পের সীমায় আবদ্ধ না থেকে চিরন্তন মানবিক যন্ত্রণার আবহকে তুলে ধরতে পেরেছে। নারী মুখাবয়ব নিয়ে করা তাঁর ভাস্কর্যটিও হয়ে উঠেছে এই যন্ত্রণার প্রতীক।
চন্দ্র ভট্টাচার্য এঁকেছেন ‘ত্যাগ’ ও ‘সম্পত্তি সমর্পণ’ নিয়ে। শেষোক্ত রচনায় তীব্র অন্ধকারের এক বিস্তীর্ণ শূন্য পরিসর রচনা করেছেন তিনি। তার উপর স্থাপিত হয়েছে অনুপুঙ্খ-স্বাভাবিকতায় আঁকা একটি বালকের মুখ। এই অন্ধকার শূন্যতা গভীর ব্যঞ্জনাময় হয়ে উঠতে পেরেছে।
ছত্রপতি দত্তের ডিজিটাল প্রিন্টে করা ছবি দু’টির শিরোনাম ‘সুপারইমপোজড রিয়েলিটিজ’। ‘ঘরে বাইরে’র বিমলা তাঁর ছবির প্রেরণা, যে নারী দুই পুরুষের দ্বন্ধে শেষ পর্যন্ত ঘর হারাল। নারীর এই ট্র্যাজিক পরাজয় শিল্পীর রচনার মূল ভাব। যদিও ছবিতে আমরা দেখতে পাই শুধু জালের আড়ালে কোনও নারীর কামনাদীর্ণ দু’টি পা শুধু। এটাকেই শিল্পী করতে চেয়েছেন নারীর যন্ত্রণাক্ত পরাজয়ের প্রতীক। গতানুগতিক ইলাস্ট্রেশনকে ছাড়িয়ে শিল্পী আজকের বিশ্ববীক্ষায় রাবীন্দ্রিক উপলব্ধিকে রূপ দিতে চেয়েছেন।
প্রভাত বসুর অবলম্বন ‘গুপ্তধন’ গল্পটি। রেখার প্রাধান্যে গড়া তাঁর ছবি দু’টিতে তিনি আজকের মানবিক বিপর্যয়কেই ধরতে চেষ্টা করেছেন। প্রবীর গুপ্তেরও অবলম্বন ‘ক্ষুধিত পাষাণ’। কিন্তু তিনি এঁকেছেন চিনের ব্যঘ্রতৃষ্ণা, যাতে ভারতীয় বাঘ প্রায় অবলুপ্ত হয়ে গেছে। শিরোনাম ‘চায়না আর্থ্রারাইটিস অ্যাট ডিয়ানানমেন’। গল্প ও ছবির মধ্যে ব্যবধান দুষ্কর। |
শেখর রায় এঁকেছেন ‘বলাই’ ও ‘এক রাত্রি’ অবলম্বনে দু’টি ক্যানভাস। নিজস্ব আঙ্গিকে তিনি সচিত্রকরণের প্রচলিত পদ্ধতিই অবলম্বন করেছেন। তাঁর ছবি দু’টি সহজ, সুবোধ্য ও সাহিত্য-ভিত্তিক। রাজেশ দেব ‘মণিহারা’র চিত্রায়ণে রাবীন্দ্রিক চিত্র-আঙ্গিক অবলম্বন করেছেন। ‘গেছোবাবা নমস্তে’-তেও আদিমতা-ভিত্তিক রাবীন্দ্রিক অনুষঙ্গ এসেছে।
সৌরভ জানা’র ‘স্ত্রীর পত্র’ চিত্রায়ণে মানবীর চুলের ঢল স্রোতস্বিনীর মতো বয়ে গিয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমস্ত স্থাপত্যকে আবৃত করে ফেলেছে। ‘মণিহারা’-তে তিনি এঁকেছেন চিরন্তন স্বর্ণতৃষ্ণা-প্লাবিত বিমূর্ত অন্ধকার।
|