বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের পর কী ভাবে গড়ে উঠল ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে পদার্থের বিপুল সমারোহ? কী ভাবে ঠিকঠাক রয়েছে পাহাড়-পর্বত, গাছপালা, এমনকী আমাদের দেহের ক্ষুদ্রতম কণাগুলি?
প্রকাণ্ড ওই প্রশ্নগুলির উত্তর পেতে বড় এক ধাপ এগোলেন এক দল বিজ্ঞানী। যাঁদের নেতৃত্বে রয়েছেন দুই ভারতীয় গবেষক। কলকাতায় ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টার-এর বেদাঙ্গদাস মোহান্তি ও মুম্বইয়ে টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ-এর সৌরেন্দু গুপ্ত। ওঁদের, এবং তিন সহযোগী বিজ্ঞানী হান্স জর্জ রিটার, জিওফেং লু এবং নু জু-র লেখা এক প্রবন্ধ শুক্রবার ছাপা হচ্ছে ‘সায়েন্স’ জার্নালে।
বিজ্ঞানীদের কাছে পাঁচ গবেষকের এই সাফল্য আরও বেশি আনন্দের খবর এ কারণে যে, কৃতিত্বটা অর্জিত হল বিজ্ঞানে আর এক মহান সাফল্যের শতবর্ষে। ১৯১১ খ্রীস্টাব্দে পরমাণুর কেন্দ্রে নিউক্লিয়াস-এর সন্ধান দিয়ে পদার্থের গঠন সম্পর্কে বড়সড় ছবি আমাদের উপহার দিয়েছিলেন বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড। |
সব কিছু পরমাণু দিয়ে গড়া। কিন্তু পরমাণু কিসে গড়া? প্রোটন, নিউট্রন এবং ইলেক্ট্রন। পদার্থের মোটা অংশই হল রাদারফোর্ড-আবিষ্কৃত নিউক্লিয়াসের মধ্যে বসে থাকা প্রোটন এবং নিউট্রন। ওরা আবার কী দিয়ে তৈরি? কোয়ার্ক এবং গ্লুওন নামে দু’জাতের কণা। বিগ ব্যাং-এ ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির পর প্রথমেই পরমাণু আসেনি। আসেনি নিউট্রন বা প্রোটনও। প্রথমে তৈরি হয়েছিল ওই কোয়ার্ক ও গ্লুওনই। তখন তাপমাত্রা ছিল লক্ষ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস। তার পর ধীরে ধীরে উষ্ণতা নেমে এলে, গ্লুওন-এর বন্ধনে তিনটি করে কোয়ার্ক জুড়ে তৈরি হয়েছিল নিউট্রন এবং প্রোটন। তার পর পরমাণু। ধীরে ধীরে নক্ষত্র, গ্রহ। অনেক পরে পৃথিবী নামে একটা গ্রহে পাহাড়-পর্বত, গাছপালা, জীবজন্তু। এবং মানুষ।
কোয়ার্ক জুড়ে কী ভাবে তৈরি হল নিউট্রন বা প্রোটন? বিজ্ঞানীরা বলেন, ওরা খুব দৃঢ় বলে বাঁধা। বলটার তেমন জুতসই অন্য নাম না পেয়ে প্রথমে ওটিকে বলা হয়েছিল ‘কালার ফোর্স’। ওই বলের চরিত্র ব্যাখ্যাকারী তত্ত্বের নাম কোয়ান্টাম ক্রোমোডায়নামিকস (কিউসিডি)। কিউসিডি বিষয়ে গবেষণা করে আজ পর্যন্ত নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন বহু বিজ্ঞানী।
তা হোক, তবু এখনও পর্যন্ত যা ভাল করে বোঝা যায়নি তা হল, কোয়ার্ক এবং গ্লুওন কখন আলাদা আলাদা ভাবে থাকবে, আর কখন গ্লুওন তিনটি করে কোয়ার্ককে বেঁধে ফেলে তৈরি করবে নিউট্রন বা প্রোটন। নিউট্রন বা প্রোটনের মধ্যে কোয়ার্কেরা এমন আঁটোসাঁটো বাঁধা থাকে যে, ওদের আলাদা করে বোঝার উপায় নেই। বাঁধন আলগা করতে প্রয়োজন বিগ ব্যাং-এর মুহূর্তকাল পরের পরিস্থিতি। অর্থাৎ, ২,০০০,০০০,০০০,০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা (সূর্যের তাপমাত্রা মাত্র ৫৬০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস)। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় একসিলারেটর গবেষণাগারে ওই রকম তাপমাত্রা তৈরি করা হয় কণায়-কণায় সংঘর্ষ ঘটিয়ে। এ রকমই একটি একসিলারেটর হল আমেরিকায় ব্রুকহাভেন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি-র রিলেটিভিস্টিক হেভি আয়ন কোলাইডার (ইংরেজি আদ্যক্ষরে আরএইচআইসি, উচ্চারণে ‘রিক’)। ২০০০ সাল থেকে ওখানে কণায়-কণায় সংঘর্ষে তৈরি করা হচ্ছে বিগ ব্যাং-এর পরের অবস্থা। পাওয়া যাচ্ছে বাঁধন-খোলা কোয়ার্ক এবং গ্লুওনের মিশ্রণ বা ‘স্যুপ’। কলকাতার বিজ্ঞানী বেদাঙ্গদাস বারবার গিয়ে কাজ করছেন ‘রিক’-এ। আর মুম্বইয়ের সৌরেন্দু তাত্ত্বিক গবেষণা করেছেন সুপার কম্পিউটারের সাহায্যে।
ঠিক কী সাফল্য ওঁদের? সায়েন্স জার্নালে তিন সহকারীর সঙ্গে ওঁরা যে প্রবন্ধটি লিখেছেন, তার শিরোনাম ‘স্কেল ফর দ্য ফেজ ডায়াগ্রাম অফ কোয়ান্টাম ক্রোমোডায়নামিকস’। ওই পেপারে ওঁরা দেখিয়েছেন, ‘রিক’ থেকে পাওয়া তথ্যাবলী থেকে বলে দেওয়া যায় কোন তাপমাত্রায় পৌঁছলে বিচ্ছিন্ন কোয়ার্ক এবং গ্লুওনের রূপান্তর ঘটে নিউট্রন বা প্রোটনে। ওঁদের পেপারের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে সায়েন্স জার্নালে আস্ত একটি প্রবন্ধ লিখেছেন আমেরিকার নর্থ ক্যারোলাইনার ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানী ব্রেন্ট মুলার। তাঁর ব্যাখ্যা: আমরা পদার্থকে যে অবস্থায় দেখি তাতে কোনও কিছুর সঙ্গে আলাদা আলাদা কোয়ার্ক যুক্ত করা বা বিযুক্ত করা যায় না। যুক্ত বা বিযুক্ত হতে পারে কেবল নিউট্রন বা প্রোটন। কিন্তু কোয়ার্ক-গ্লুওন স্যুপ এমন অবস্থা যে, তার সঙ্গে একটা একটা কোয়ার্ক যুক্ত বা বিযুক্ত হতে পারে। পাঁচ বিজ্ঞানী দেখিয়েছেন, পরিস্থিতির এই যে প্রভেদ তার সাহায্যে কণায় কণায় সংঘর্ষ থেকে পাওয়া তথ্য থেকে বলা সম্ভব, কোন তাপমাত্রায় কোয়ার্ক-গ্লুওন বনে যাবে নিউট্রন বা প্রোটনে।
গবেষণার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে কলকাতায় বেদাঙ্গদাস বললেন, “আমরা এবং আমাদের চারপাশের তাবৎ বস্তু কী দিয়ে, এবং কী ভাবে, তৈরি এ সব জানতে কার না ইচ্ছে করে? বলতে পারেন, আমাদের গবেষণার পিছনে দার্শনিক প্রেরণা সেটাই।” আর একটু বিশদে গিয়ে বেদাঙ্গদাসের ব্যাখ্যা: “জল তো হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন দিয়ে তৈরি। ওই দুটি মৌলের ধর্ম জানার পর কী করে
বুঝব জলের ধর্ম? কোয়ার্ক চিনি, গ্লুওনও চিনি। কিন্তু
কোয়ার্ক বেঁধে ফেলে গ্লুওন কী ভাবে তৈরি করছে নিউট্রন বা প্রোটন তা যে ভাল করে জানা হয়নি এখনও। আমাদের কাজ সেটা জানা। দেখবেন, আমাদের সাফল্য দ্রুত
জায়গা পাবে পাঠ্যবইয়ে।”
মুম্বই থেকে সৌরেন্দু জানালেন, “তাপমাত্রা বাড়ার তালে তালে কোয়ার্ক-গ্লুওন মিশ্রণের দশা যে ভাবে পাল্টায়, তাকে যদি একটা মানচিত্রের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে বলতে হয় সেই মানচিত্রটা এখনও স্পষ্ট হয়নি। হয়নি বলেই, পৃথিবী জুড়ে বহু বিজ্ঞানী চেষ্টা করছেন তা
বানানোর। যে কোনও মানচিত্রের বেলাতেই নির্দিষ্ট চিহ্নস্থানগুলি খুঁজে পাওয়া এবং শহরে-শহরে দূরত্ব মাপা যেমন কঠিন কাজ, এ ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তেমনই। বলতে পারেন, আমরা কোয়ার্ক-গ্লুওন দশা-মানচিত্রের প্রথম চিহ্নস্থানটি নির্ধারণ করতে পেরেছি। এই চিহ্নস্থানটি যে ঠিক তার প্রমাণ দিচ্ছে ‘রিক’-এ পরীক্ষালব্ধ ফলাফল। এ রকম আরও একটি চিহ্নস্থানের অবস্থান আমরা অনুমান করতে পেরেছি। অনুমান ঠিক কি না তার প্রমাণ দেবে
ভবিষ্যৎ পরীক্ষা।”
কোয়ার্ক-গ্লুওন মিশ্রণের দশা পরিবর্তনের গণিতটি দুরূহ, জটিল। সুপার কম্পিউটারের সাহায্যে সে জটিল গণনা সেরে ফেলার জন্য টাটা ইনস্টিটিউট-এর তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীরা তৈরি করেছেন আলাদা একটি পদ্ধতি। এর পিছনে রয়েছে যে উদ্যোগ তার নাম ‘ইন্ডিয়ান ল্যাটিস গেজ থিওরি ইনিসিয়েটিভ (আইএলজিটিআই)। |