|
|
|
|
আমার শিলিগুড়ি |
রোগ-দূষণ ছড়াচ্ছে ‘ডাম্পিং গ্রাউন্ড’
সৌমিত্র কুণ্ডু ও নমিতেশ ঘোষ • শিলিগুড়ি |
|
|
কী ভাবে দূষিত হচ্ছে ‘আমার শিলিগুড়ি’। শহর ও লাগোয়া এলাকার আকাশ-বাতাস, নদী-নালা-পুকুর যেন রোগের উৎস হয়ে উঠছে। নিঃশব্দে মারণ রোগ-ব্যাধির জীবাণু বাসা বাঁধছে শরীরে। কী ভাবে এই শহরকে দূষণের হাত থেকে রেহাই দেওয়া যেতে পারে, পরিবেশপ্রেমী, বিশেষজ্ঞ সহ আমজনতা কী ভাবছেন তা নিয়ে আনন্দবাজারের ধারাবাহিক প্রতিবেদন। আজ চতুর্থ কিস্তি। |
এই মুহূর্তে শহরের জঞ্জাল ফেলা হয় সেবক রোড ও ইস্টার্ন বাই পাস লাগোয়া একটি বিস্তীর্ণ এলাকায়। একাধিক ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, কলেজ ও জনবসতি রয়েছে সেখানে। পুরসভা সূত্রের খবর, রোজ গড়ে ৩০০ টন জঞ্জাল সংগ্রহ করে ফেলা হয় ওই এলাকায়। জল-জঞ্জাল জমে এলাকা হয়ে উঠেছে দূষণের অন্যতম উৎস। বাতাসে এমন দুর্গন্ধ যে বাসিন্দারা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। ওই এলাকার স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অবস্থা বড়ই করুণ। নানা মহলে দরবার করেও কাজের কাজ হয়নি। ‘ডাম্পিং গ্রাউন্ড’ সরানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা যায়নি। ভাবা হয়েছিল, বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণের প্রকল্প চালু করা হবে। সেটাও ‘হচ্ছে-হবে’ পর্যায়ে এখনও রয়ে গিয়েছে।
পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, ইর্স্টান বাইপাস লাগোয়া এলাকায় শিলিগুড়ি পুরসভার বর্তমান ডাম্পিং গ্রাউন্ডের জায়গাটি কেনা হয় ১৯৪৯ সালে। শহরের জঞ্জাল ফেলা ছাড়াও খাটা পায়খানার বর্জ্য ফেলা ছিল মূল লক্ষ্য। তখন ৯টি ওয়ার্ড নিয়ে পুরসভা চলত। ক্রমে ওয়ার্ডের সংখ্যা বেড়েছে। ৯৫ সালে সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট প্রকল্প চালুর ব্যাপারে প্রথম চেষ্টা করা হয়। সে সময় শহর থেকে দৈনিক ১৫০ টন বর্জ্য সংগ্রহ হত। যা এখন দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০০ টনে। তবু শহরে অনেক এলাকাতেই রাস্তায় স্তূপাকারে আবর্জনা জমে থাকতে দেখা যাচ্ছে। তা নিয়মিত সাফাইয়ের পরিকাঠামো পুরসভা তৈরি করতে পারেনি। |
জঞ্জাল বৃত্তান্ত |
প্রতিদিন গড়ে ৩০০ টন জঞ্জাল জমা হয় ডাম্পিং গ্রাউন্ডে। এর মধ্যে রয়েছে একাধিক হাসপাতাল, ৩৪টি নার্সিংহোম, অসংখ্য পলিক্লিনিক আর ওষুধের দোকান ও চেম্বারের বর্জ্য। এ সব সাফাই করার কাজে রয়েছেন ১২০০ কর্মী।
প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ জমায় আগে ডাঙ্গিপাড়া, ফকিরটোলা, বিবেকানন্দ রোড, দুর্গানগর, শরৎচন্দ্রপল্লি, শাস্ত্রীনগর, রায় কলোনি এলাকা বর্ষায় প্লাবিত হত। ক্যারিব্যাগ বন্ধ হওয়ায় ওই সব এলাকায় এখন আর জল জমে না।
তথ্য: শিলিগুড়ি পুরসভা |
|
এ ছাড়াও রয়েছে চিকিৎসা-বর্জ্য। শহরে যথেচ্ছ নার্সিংহোম হচ্ছে। সেই সব নার্সিংহোম ও হাসপাতালগুলি বিজ্ঞানসম্মত ভাবে বর্জ্য নষ্ট করছে না বলে অভিযোগ। ওই বর্জ্য চলে যাচ্ছে ডাম্পিং গ্রাউন্ডেই। এমনকী পুরসভার মাতৃসদনের চিকিৎসা-বর্জ্যও ডাম্পিং গ্রাউন্ডে ফেলা হয়। এ ছাড়া ওষুধের দোকান, চিকিৎসকের চেম্বার থেকেও গজ-ব্যান্ডেজ, সিরিঞ্জ-সহ নানা বর্জ্য রাস্তায় ফেলার ঘটনা হাসপাতালের সামনে গেলেই চোখে পড়বে। বেশির ভাগ ওষুধের দোকানে ‘ডাস্টবিন’ পর্যন্ত নেই বলে পুরসভায় অভিযোগ পৌঁছেছে। পুরসভা জানে, চিকিৎসা বর্জ্য থেকে মারাত্মক সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে। বর্ষায় সব বর্জ্য জলে মিশে দূষিত হচ্ছে মাটি, ভূগর্ভস্থ জল।
পুরসভার দাবি, চিকিৎসা বর্জ্য বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে নষ্ট করতে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের পক্ষ থেকে একটি বেসরকারি সংস্থাকে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ফুলবাড়ির কাছে তারা ওই ব্যবস্থা গড়ে তুলছেন। বছর দেড়েক ধরে শহরের অধিকাংশ নার্সিংহোম, পলিক্লিনিকগুলি থেকে তারা চিকিৎসা বর্জ্য সংগ্রহ করেন। তবে ওষুধের দোকান, চিকিৎসকদের চেম্বার এবং কয়েকটি নার্সিংহোম, পলিক্লিনিক থেকে চিকিৎসা-বর্জ্য এখনও পুরসভার সাফাই বিভাগই সংগ্রহ করে। এবং তা ফেলা হয় সেই ডাম্পিং গ্রাউন্ডে। কুড়ানিরা অনেক সময় সেখান থেকে স্যালাইন, ওষুধের বোতল, সিরিঞ্জ সংগ্রহ করে। এ থেকে হেপাটাইটিসের মতো রোগ সংক্রমণ হওয়ার সম্ভবনা থাকে বলে জানান উঃবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের প্রধান পার্থ সরকার।
শহরের বর্জ্য থেকে সার তৈরির পরিকল্পনা বিগত পুরবোর্ডের আমলে নেওয়া হলেও বছর দেড়েক তা বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। পুরসভার সূত্রেই জানা গিয়েছে, শহর থেকে দৈনিক ৩০০ টন বর্জ্য প্রতিদিন সংগ্রহ করা হয়। সার তৈরি প্রকল্পে ব্যবহার করা হত গড়ে দৈনিক প্রায় ৫০ টন। বাকি বর্জ্য খোলা আকাশের নীচে পড়ে থেকেছে। জৈব-অজৈব বর্জ্য আলাদা সংগ্রহ করা হলেও একসঙ্গেই তা ফেলা হচ্ছে ডাম্পিং গ্রাউন্ডে। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের প্রধান মানসী চক্রবর্তী বলেন, “সমীক্ষা করে জানা গিয়েছে বছরে শিশুরা ৩-৫ বার ডায়েরিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। আবর্জনা থেকে মাছি, মশা বাহিত হয়ে রোগ সংক্রমিত হচ্ছে। বস্তিগুলিতে কুয়ো, নলকূপের মাধ্যমে জলবাহিত হয়ে সংক্রমণ ছড়ায় মারাত্মকভাবে।”
পুরসভা জঞ্জাল প্রক্রিয়াকরণের ব্যবস্থা করতে পারছে না কেন? এই প্রশ্ন তুলেছেন পরিবেশপ্রেমীরা। একাধিক পরিবেশপ্রেমী সংগঠনের সদস্যরা মনে করেন, যে পুরসভা প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ বর্জন করানোর কাজে বাসিন্দাদের সামিল করতে পেরেছে, তারা চেষ্টা করলে এটাও পারবে। শিলিগুড়ির পরিবেশের স্বার্থে শহরবাসী যে কোনও উদ্যোগে সামিল হবেন বলে তাঁদের ধারণা।
কথাটা ভুল নয়। বছর খানেক আগেও শহরে ক্যারিব্যাগের রমরমা ছিল। কংগ্রেস-তৃণমূলের জোট বোর্ড দখলের পরে পুর কর্তৃপক্ষ শহরে প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ বন্ধে কড়াকড়ি করে। বাসিন্দারা তাতে সামিল হন। কয়েক মাসে প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ শহরে ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়। গত বছরের জুন মাসে পরিবেশ দিবসে শিলিগুড়ি প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ মুক্ত শহর হিসেবে ঘোষিত হয়। বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ বন্ধের সুফল মিলেছে। যেমন, ক্যারিব্যাগ নিষিদ্ধ হওয়ার পরে শহরের অনেক এলাকা বর্ষায় জলমগ্ন হয়নি। কারণ, ক্যারিব্যাগ নর্দমার মুখ বন্ধ করে দিত। বাসিন্দারা আশাবাদী, জঞ্জাল সমস্যার সমাধানও করতে পারবে পুরসভা।
যদিও আশঙ্কার ভ্রূকুটি দেখছেন ‘আমার শিলিগুড়ি’র বহু বাসিন্দাই। চোরাগোপ্তা প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ চালু করতে একটি চক্র সক্রিয়। আড়াল থেকে যা লক্ষ রাখছে একটি ‘প্লাস্টিক লবি’। পুরসভার একটি সূত্র বলছে, তৃণমূল বোর্ডে যোগ দিলে অনেক মেয়র পারিষদ বদল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী গোষ্ঠী পছন্দসই কাউকে বসিয়ে ফের প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগে শিলিগুড়িকে ঢেকে দিতে চাইছে বলে অনেকেরই সন্দেহ।
পুরসভার এক কর্তা জানিয়েছেন, এমন আশঙ্কা থাকলেও শহরবাসী প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ ফেরানোর চেষ্টা রুখে দেবেন। যা পরিস্থিতি তাতে এখন কোথাও প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ ব্যবহার হলেই ফোন মেলে। কাজেই ক্যারিব্যাগ ফেরানোর কাজে যে বা যাঁরা সহযোগিতা করবেন, তাঁরা শহর বিপন্ন করার দায়ে অভিযুক্ত হতে পারেন। শহরের স্বার্থ বিরোধী মানুষ হিসেবে প্রতিপন্ন হওয়ার ঝুঁকি কেউ নেবেন বলে মনে হয় না।
বস্তুত, প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ শুধু নয়, অনেক ব্যাপারেই এককাট্টা হতে চাইছে শিলিগুড়ি।
|
(চলবে) |
|
|
|
|
|