|
|
|
|
কী যে হবে, থম মেরে গিয়েছেন উদ্বিগ্ন গীতারা |
রঞ্জন সেনগুপ্ত ও গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় • সিঙ্গুর |
রাত পোহাতেই আনন্দ আর উত্তেজনা উধাও! কলকাতা হাইকোর্টে টাটাদের তরফে মামলা শুরু হতেই বুধবারের সিঙ্গুর যেন খানিকটা থম মেরে গিয়েছে।
ন্যানো প্রকল্পের হাজার একর জমি টাটাগোষ্ঠীর কাছ থেকে নিয়ে ‘অনিচ্ছুক’দের ৪০০ একর ফেরত দেওয়ার জন্য যে দিন রাজ্যের তৈরি বিলে অনুমোদন দেন রাজ্যপাল, সে দিন ছিল উৎসবের সূচনা। মঙ্গলবার জেলা প্রশাসন সেই জমির দখল নেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করতেই সন্ধে থেকে প্রকল্প এলাকার আশপাশের গ্রাম আবেগ আর আনন্দে ভেসে যায়। কিন্তু সেটা বেশি ক্ষণ স্থায়ী হল না। মামলার গতি-প্রকৃতি বুঝতে সারাদিনই সিঙ্গুরের চোখ ছিল টেলিভিশনের পর্দায়। |
|
নজর এড়িয়ে। সিঙ্গুরের ন্যানো প্রকল্প থেকে চলছে ইট পাচার। বুধবারের নিজস্ব চিত্র। |
বুধবার আদালতে আনুষ্ঠানিক ভাবে মামলা শুরু হতেই সিঙ্গুরের পারদ ওঠানামা করেছে। জমি ফেরত দিতে রাজ্য সরকারের নতুন আইনকে স্বাগত জানিয়ে কৃষিজমি রক্ষা কমিটির একটি মিছিল সকালে বিভিন্ন পথ পরিক্রমা করে কারখানার মূল গেট পর্যন্ত আসে। ব্যস, ওইটুকুই। তার পর থেকে সারাদিন সিঙ্গুর কাটিয়েছে খানিকটা সংশয়, খানিকটা বিভ্রান্তি আর একটা চাপা আশঙ্কা নিয়ে। সংশয় থেকেই সিঙ্গুরের দোবাধি গ্রামের বাসিন্দা গীতা মৈত্রী বলেন, “সরকারের থেকে কিছু পাইনি। টাটাদের থেকেও কিছু নিইনি। জানি না, এর পর কী হবে।” রুইদাস পাড়ার বাসিন্দা কার্তিক দাস, কিশোর হাম্বিদের কথাতেও হতাশার সুর, “আমরা আগে ভাগ চাষের কাজ করতাম। আগের সরকারের ঘোষিত ‘প্যাকেজ’-এ আমাদের কথা কিছু ছিল কি না, বুঝে ওঠার আগেই মামলার গেরোতে জড়িয়ে গেল জমি। কী হবে কে জানে?” মনসাতলার বাসিন্দা বিশ্বজিৎ ঘোষের দশ বিঘে জমি প্রকল্প এলাকায় চলে গিয়েছে। বাইরে পাঁচ বিঘে জমি ছিল। তা দিয়ে কোনও ক্রমে সংসার চলছে। তাঁর কথায়, “জমি ফেরত নিয়ে সংশয় ছিলই। আবার মামলা হল। সিঙ্গুরে শনির দশা চলছে।”
প্রকল্প এলাকায় টাটার নিরাপত্তারক্ষীদের খাবার সরবরাহ করতেন গোবিন্দ বর্মন। সিঙ্গুরের বাসিন্দা ওই যুবক খানিকটা ক্ষুব্ধ হয়েই বলেন, “নিরাপত্তারক্ষীদের এখান থেকে চলে যেতে বলা হয়েছে। এর পর কী করব, আমরা জানি না। আমার কর্মচারীরাও কাজ হারাল। আমাদের যা হওয়ার হল। কিন্তু টাটাদের আর সিঙ্গুরে ফেরা উচিত নয়। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রা যা করলেন, তাতে ওঁদের এই রাজ্যে ফেরা উচিত নয়। ওঁরা থাকলে রাজ্যের ভাল হত। কিন্তু সিঙ্গুরবাসী বা রাজনীতির লোকেরা কেউই সেটা বুঝলেন না।”
সিঙ্গুরের জমিহারা মানুষ নানা সংশয়ে দিন কাটালেও জমিরক্ষা কমিটির নেতারা অবশ্য সিঁদুরে মেঘ দেখছেন না। কমিটির আহ্বায়ক ও হরিপালের বিধায়ক বেচারাম মান্না বলেন, “সাময়িক হয়তো কিছুটা অসুবিধা হল। কিন্তু এটাই সব নয়। চাষিদের জমি ফেরত দিয়ে রাজ্য সরকার তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে।” কমিটির আর এক নেতা মহাদেব দাসও যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী, “একদিন টাটাদের জমি দিতে আমাদের জমি কেড়ে নিয়েছিল সরকার। এখন সরকারই টাটাদের কাছ থেকে জমি নিয়ে আমাদের ফেরত দিতে আইন করেছে। তাই মামলা করে ওরা কিছু করতে পারবে না।” |
|
থমকে সময়। টাটার কারখানার ভিতরে এখনও পড়ে ন্যানো গাড়ির খোল। বুধবার সিঙ্গুরে রাজীব বসুর তোলা ছবি। |
কমিটির নেতারা প্রকাশ্যে মামলাকে গুরুত্ব না দিলেও হুগলি জেলা প্রশাসন অবশ্য এ দিন সকাল থেকেই ‘ধীরে চলো’ নীতি নিয়ে চলেছে। গত কাল সন্ধ্যায় কারখানার মূল গেটে জমি ছাড়ার নোটিস লটকে দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মাঝরাতে প্রকল্প এলাকার দখল নেয় পুলিশ। এই নিয়ে রাতেই প্রবল উত্তেজনা তৈরি হয়। কারণ সেখানে তখন টাটাগোষ্ঠীর প্রতিনিধি এবং নিরাপত্তাকর্মীরা ছিলেন। এই পদক্ষেপ ‘হঠকারী’ হল কিনা, তাই নিয়ে এ দিন পুলিশেরই বিভিন্ন অফিসার-কর্মীরা নিজেদের মধ্যে আলোচনায় মশগুল ছিলেন। ফলে মামলা চলাকালীন নতুন করে বিতর্ক এড়াতে এ দিন জেলা প্রশাসন ছিল সতর্ক। সকাল থেকে দফায় দফায় পুলিশ ও প্রশাসনের কর্তারা প্রকল্প এলাকার ভিতরে ঢুকেছেন, বেরিয়েছেন। বিকালে আইজি (পশ্চিমাঞ্চল), এসপি-সহ পদস্থ পুলিশ কর্তারা এলাকা পরিদর্শন করে জরুরি বৈঠকও করেন। কিন্তু কোথাও কোনও তাড়াহুড়ো নেই! মামলায় জড়িয়ে পড়ার পর জমি ফেরত পাওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে ঠিকই। কিন্তু পুলিশের দখলে থাকা প্রকল্প এলাকায় ভিতর থেকে নানা জিনিসপত্র বার করে নিচ্ছেন গ্রামবাসীদের একাংশ।
সিঙ্গুর প্রকল্পের প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার এলাকা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। অথচ নিজেদের যাতায়াত ও গরু চলাচলের সুবিধার জন্য পাঁচিলের বহু জায়গা ভেঙে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। নিরাপত্তাকর্মীদের চোখ এড়িয়ে এই পথ দিয়ে আগে মাঝেমধ্যে নানা সামগ্রী পাচার হত। কিন্তু গত কাল পুলিশ এলাকার দখল নেওয়ার পরে এ দিন সকাল থেকে ভাঙা পাঁচিলের পথ ধরে ইট-লোহা-কাঠের সামগ্রী পুলিশের চোখের সামনে দিয়েই বাইরে বেরিয়ে গিয়েছে। এক হতাশ পুলিশ কর্মী তাঁর কর্তাকে বলেই ফেললেন, “স্যার এ দিকে আটকাচ্ছি তো, ও দিক থেকে নিয়ে চলে যাচ্ছে!” পুলিশের এক কর্তা জানান, প্রকল্প এলাকায় মোট সাড়ে পাঁচশো পুলিশ কর্মী মোতায়েন করা হয়েছে। রাতের মধ্যেই সব পুলিশ কর্মী পৌঁছে যাবেন। এলাকায় সার্চ লাইট এবং ওয়াচ টাওয়ার বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে। হুগলির পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরীর দাবি, “আঁটোসাটো নিরাপত্তার জন্য সব ব্যবস্থাই আছে।”
সিঙ্গুর ছেড়ে টাটারা চলে গিয়েছে ২০০৮ সালে। তার পর থেকে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে গেলে চোখে পড়ে কয়েকটি নীল-সাদা স্টিলের কাঠামো। কিন্তু ফাঁকা সেই কাঠামোর মধ্যেই রয়ে গিয়েছে লাল-সবুজ-হলুদ রংয়ের কয়েকটি ন্যানোর খোল। জ্বলজ্বল করছে কর্মচারীদের জন্য কার্ডবোর্ডে লেখা ‘আচরণবিধি’। ছড়িয়ে রয়েছে গাড়ির ইঞ্জিন, চাকা-সহ ইঞ্জিন, সিট এবং আরও অনেক কিছুই। এখনও যেন শুধু জোড়া লাগারই অপেক্ষা! |
|
|
|
|
|