আইনি প্যাঁচেই পড়ল সিঙ্গুর
বিল অসাংবিধানিক, কোর্টে বলল টাটারা
নিজেদের ‘সম্পত্তি বাঁচাতে’ সিঙ্গুরের জমি দখল নিয়ে রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্তের উপর কলকাতা হাইকোর্টে স্থগিতাদেশ চাইল টাটা মোটরস। ২০ জুন ওই অধিগৃহীত জমির যে অবস্থা ছিল, তা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যও হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে ওই সংস্থা। একই সঙ্গে, সিঙ্গুরের জমি ফিরিয়ে নিতে গত ১৫ জুন রাজ্য বিধানসভায় যে বিল পাশ হয় এবং ওই বিষয়ে রাজ্য মন্ত্রিসভার যে সিদ্ধান্ত, দুই-ই খারিজের আবেদন জানিয়েছে টাটা গোষ্ঠী। তাদের মতে ওই বিল ‘অসাংবিধানিক’।
সিঙ্গুরে যাঁরা ‘ইচ্ছুক’ জমি মালিক, অর্থাৎ যাঁরা জমি বিক্রির টাকা নিয়েছেন, তাঁরাও এই মামলায় অংশগ্রহণ করতে চেয়েছেন। তাঁদের হয়ে সওয়াল করবেন সিপিএম নেতা তথা কলকাতার প্রাক্তন মেয়র বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য।
বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সিঙ্গুর-বিল পাশ হয়ে গিয়েছে। বিলে ‘নীতিগত’ সমর্থন জানিয়েছেন বিরোধীরাও। রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন সই করায় বিলটি এখন আইন হয়ে গিয়েছে। সেই বিল তথা আইনটিই খারিজ করার আর্জি বুধবার আদালতে জানিয়েছেন টাটা মোটরসের আইনজীবী সমরাদিত্য পাল।
হাইকোর্টে টাটা মোটরসের কৌঁসুলি সমরাদিত্য পাল। নিজস্ব চিত্র।
তাঁর সওয়ালের শেষে বিচারপতি সৌমিত্র পাল জানিয়ে দেন, এ দিন তিনি কোনও রায় দিচ্ছেন না। আজ, বৃহস্পতিবার দুপুর দু’টোয় ফের শুনানি হবে। অধিগৃহীত জমির ভিতরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথাযথ রয়েছে কি না, তা রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল অনিন্দ্য মিত্রের কাছে জানতে চান বিচারপতি। অ্যাডভোকেট জেনারেল জানান, নিরাপত্তার যথেষ্ট ব্যবস্থা রয়েছে। শান্তিও অক্ষুণ্ণ রয়েছে।
এ দিন সরকার পক্ষের হয়ে অ্যাডভোকেট জেনারেল ছাড়াও ছিলেন সরকারি কৌঁসুলি (জিপি) অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়, তৃণমূলের আইনজীবী সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও আইনজীবী শক্তিনাথ মুখোপাধ্যায়। এজলাসে জড়ো হয়েছিলেন কৌতূহলী সাধারণ মানুষও। অন্য আইনজীবীরাও ভিড় জমান। সকাল সাড়ে দশটায় মামলাটি প্রথম ওঠে। শুনানি চলে এ দিনের মতো আদালত বন্ধ হওয়া পর্যন্ত। একটা সময় এজলাসে এমন ভিড় হয়ে যায়, যে জিপি অশোকবাবু আদালত কক্ষের সমস্ত দরজা-জানালা খুলে দেওয়ার জন্য বিচারপতির অনুমতি চান।
টাটাদের তরফে করা মামলাকে এ দিন খুব একটা গুরুত্ব দিতে চাননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মামলা করা যে কারওরই গণতান্ত্রিক অধিকার বলেও তিনি স্পষ্ট করে দেন, ওই জমি এখন সরকারের। এবং সরকারের অগ্রাধিকার ‘অনিচ্ছুকদের’ জমি ফেরত দেওয়া। কিন্তু মামলার জটে কি জমি ফেরাতে যথেষ্ট ‘বিলম্ব’ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হল না? মুখ্যমন্ত্রীর জবাব, “তার কোনও সম্ভাবনা নেই!”
টাটার সওয়াল
সরকারের জমি দখলে স্থগিতাদেশ চাই
অনিচ্ছা সত্ত্বেও চলে যেতে হয়েছিল
অশান্ত পরিবেশে কারখানা চালানো সম্ভব ছিল না
প্রকল্প পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে নেই
এ দিন সওয়ালের শুরুতে টাটাদের আইনজীবী সমরাদিত্যবাবু বলেন, মঙ্গলবার সূর্যাস্তের পর সিঙ্গুরে কারখানার গেটে সরকারি নোটিস টাঙিয়ে দেওয়া হয়। তার পর হুগলির জেলাশাসক, পুলিশ সুপার আসেন পুলিশবাহিনী নিয়ে। কারখানার নিরাপত্তা বাহিনীকে সরিয়ে পুলিশ দখল নেয়। সমরাদিত্যবাবু আদালতে জানান, ওখানে অনেক টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। টাটাদের সম্পত্তি রয়েছে। সেই সম্পত্তি রক্ষার জন্য স্থিতাবস্থার প্রয়োজন।
ঘটনার ‘গুরুত্ব’ অনুধাবন করেই সমরাদিত্যবাবু মঙ্গলবার বেশি রাতে প্রধান বিচারপতি জে এন পটেলের বাড়িতে আবেদন জানাতে যান, যাতে তালিকায় না থাকলেও বুধবারই মামলাটির শুনানি শুরু করা যায়। প্রধান বিচারপতি অনুমতি দেন। এবং মামলাটি শুনানির জন্য পাঠান বিচারপতি সৌমিত্র পালের এজলাসে। আদালতে সমরাদিত্যবাবু বলেন, টাটাদের তরফে রাজ্য সরকারকে বলা হয়েছিল, অধিগ্রহণের নোটিস পেলে পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে তারা জবাব দেবে। টাটাদের কোনও নোটিস দেওয়া হয়নি। টাটাদের আইনজীবীর বক্তব্য, টাটারা উত্তরাখণ্ড ও হিমাচলপ্রদেশে এই কারখানা গড়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আগ্রহ এবং বিভিন্ন দিক খতিয়ে দেখে তারা সিঙ্গুরেই ন্যানো কারখানাটি গড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তার পর তারা প্রকল্পের কাজও প্রায় শেষ করে ফেলেছিল।
সমরাদিত্যবাবু আরও বলেন, টাটা মোটরস স্বেচ্ছায় সিঙ্গুর ছেড়ে যায়নি। যখন ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তখন সিঙ্গুরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রশাসনের হাতের বাইরে চলে গিয়েছিল। কারখানার গেটের সামনে লাগাতার ধর্না, বিক্ষোভ, জাতীয় সড়ক অবরোধ চলছিল। টাটার কর্মীরাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। তাঁদের ভয় দেখানো হচ্ছিল। এমন ‘অশান্ত পরিবেশে’ কখনওই কারখানা চালানো সম্ভব ছিল না। তাই ‘অনিচ্ছা সত্ত্বেও’ টাটা মোটরস অন্য রাজ্যে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব রাজ্যের উপরই বর্তায়। সেই ব্যর্থতার ‘দায়’ তাদের ভোগ করতে হবে কেন?
টাটাদের আইনজীবী বলেন, যে সংস্থাটি এক দিন রাজ্য সরকারের আমন্ত্রণেই পশ্চিমবঙ্গে ন্যানো কারখানা গড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, লগ্নি করেছিল ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা, বলপ্রয়োগ করে তাদের বার করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তাঁর দাবি, সিঙ্গুরে ন্যানো প্রকল্প ‘পরিত্যক্ত’ অবস্থায় পড়ে নেই। কারখানার কিছু যন্ত্রপাতি সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলেও বাড়ি, ছাউনি এবং অন্যান্য পরিকাঠামো-সহ এখনও যা কিছু রয়েছে, রীতিমতো অর্থ ব্যয় করে তা টাটা মোটরসকে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়।
সিঙ্গুর ঘিরে সরকার-টাটা সংঘাত নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে চায়নি প্রধান বিরোধী দল সিপিএম। তবে দলের একাংশের মতে, ক্ষতিপূরণ পেলে সিঙ্গুরের জমি ছেড়ে দেওয়ার কথা জানিয়ে টাটারা বিগত সরকারকে যে চিঠি দিয়েছিল, তার ‘নিষ্পত্তি’ এখনও হয়নি। সিপিএম রাজ্য নেতৃত্ব নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ঠিক করেছিলেন, ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না। কারণ, সরকারের ‘ক্ষতিও’ হয়েছিল যথেষ্ট। সে বিষয়ের ফয়সালা হওয়ার আগে নতুন সরকার আইন করে জমি ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলায় টাটারা যে আদালতে যাবে, তা অনেকটা ‘প্রত্যাশিত’ই ছিল। তা ছাড়া, পদ্ধতিগত দিক থেকে নতুন সরকার কিছু ‘দুর্বলতা’ দেখিয়েছে বলেও তাঁদের বক্তব্য। তাঁরা আরও বলছেন, বিলটিতেও বেশ কিছু ফাঁক ছিল। যার ফলে আদালত পর্যন্ত জল গড়ানো ‘অপ্রত্যাশিত’ নয়। ঘটনার মোড় কোন দিকে যায়, তা নিয়ে দলে বিশদে আলোচনা চালাচ্ছেন সিপিএম নেতৃত্ব।
তবে জমি ফেরানোর আইনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে টাটার আদালতে যাওয়া নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন তুলে দিলেন অন্যতম ফব নেতা অশোক ঘোষ। টাটাদের মামলা করার সিদ্ধান্তকে সরাসরি ‘ভুল’ আখ্যা দিয়ে তাঁর বক্তব্য, “বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকারের আশ্বাস সত্ত্বেও টাটা সিঙ্গুরে থাকতে চায়নি। এখন পরিত্যক্ত জমি ফিরিয়ে নিতে আইন করেছে নতুন সরকার। এই অবস্থায় সরকার এবং ওই কৃষকদের বিপাকে ফেলতে চেয়েছে টাটারা। তারা ভুল করেছে!” টাটাদের ‘এই পরিণতি প্রাপ্য ছিল’ বলেই মনে করেন তিনি! অশোকবাবু বলেন, “সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের সময়ই আমরা বামফ্রন্টে প্রতিবাদ করেছিলাম।”
আর এক বাম শরিক আরএসপি-র ভারপ্রাপ্ত রাজ্য সম্পাদক ক্ষিতি গোস্বামীর বক্তব্য, “কী শর্তে টাটা জমি পেয়েছিল, তা আগের সরকার জানায়নি। আইনি বাধায় এই সরকারও জানাতে পারেনি। ওই শর্ত না-জানলে টাটাদের পদক্ষেপ সম্পর্কে মন্তব্য করা কঠিন।” তবে তাঁর মতে, সিঙ্গুরের জমি আর চাষযোগ্য নেই। তাকে শিল্পের জন্য পুনর্ব্যবহার করলেই ভাল হত। ক্ষিতিবাবুর কথায়, “জমিটা পড়ে ছিল বলে তাকে খাস করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। আমরা সেই সিদ্ধান্তকে নীতিগত ভাবে সমর্থন করেছি। এ বার পদ্ধতিগত ভাবে ওই জমি কী ভাবে কৃষকের হাতে পৌঁছবে, তা সরকারকে দেখতে হবে।” সিপিআইয়ের রাজ্য সম্পাদক মঞ্জুকুমার মজুমদারও বলেন, “সরকারের জমি ফিরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তে আমরা বাধা দিইনি। এখন টাটা কী করবে, তা নিয়ে আমরা কী বলব!”
রাজ্য বিজেপি-র সভাপতি রাহুল সিংহ অবশ্য সরকারের জমি ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়াকে ‘সমাজবিরোধী সুলভ’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর বক্তব্য, সরকারের টাটার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে পদক্ষেপ করা উচিত ছিল। তা না করে সরকার ‘অতিরিক্ত তাড়াহুড়ো’ করে রাতের অন্ধকারে ওই জমি দখল করেছে।
Previous Story South Next Story



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.