প্রবন্ধ ২...
জঙ্গলমহলের উন্নয়ন দাবিটা কিন্তু স্বশাসনের
ক্ষমতায় আসার পর রাজ্যের নতুন সরকার জঙ্গলমহলে ২ টাকা কেজি দরে খাদ্য সরবরাহের কথা ঘোষণা করেছে। আগেকার সরকার যেখানে শুধুমাত্র আদিবাসীদেরই সস্তা দরে খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করেছিল, সেখানে নতুন সরকার অন্যান্যদেরও এর আওতায় এনে মাসে পরিবারপিছু ৩৫ কেজি খাদ্যশস্য দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। গত দু’বছরে জঙ্গলমহলে খরা গেছে। তার ওপর গেছে উর্দিধারী ও উর্দিবিহীন বন্দুকবাজদের উৎপাত। এ অবস্থায় সস্তায় খাদ্য পৌঁছে দেওয়ার প্রকল্পকে মানুষ স্বাগত জানাবেন। প্রকল্পটি উত্তরবঙ্গেও প্রসারিত হওয়া উচিত। পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে উত্তরবঙ্গকে বিচ্ছিন্ন রেখে দেওয়ার যে ধারা, তাকে ছিন্ন না করে পশ্চিমবঙ্গ বিকশিত হতে পারে না।
অবশ্যই বিচ্ছিন্নতার নানা স্বরূপ আছে। উন্নয়নগত বঞ্চনাই বিচ্ছিন্নতার একমাত্র উৎস নয়, বরং এর জোরালো শিকড়টি নিহিত আছে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাকাঠামোয়। পশ্চিম মেদিনীপুর ও বাঁকুড়ার যথাক্রমে ১৩ ও ৫টি ব্লক এবং গোটা পুরুলিয়া নিয়ে যে একটি এলাকা, তা শুধু ভৌগোলিক গঠনের দিক দিয়েই বাকি পশ্চিমবঙ্গ থেকে আলাদা নয়, জনগোষ্ঠীগত ও ভাষা-সাংস্কৃতিক দিক দিয়েও স্বতন্ত্র। সরকারি হিসাবেই এই এলাকার ৩৫ শতাংশ আদিবাসী। এ ছাড়া আছেন ৩০ শতাংশ কুড়মি মাহাত, যাঁরা ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত আদিবাসী বলে স্বীকৃত ছিলেন এবং এখনও সব দিক বিবেচনা করে দেখলে তাঁদের সেই স্বীকৃতি প্রাপ্য। বাকি যে জনগোষ্ঠী, তাঁরাও অধিকাংশই বিভিন্ন পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর মানুষ। কিন্তু এখানে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতা যাঁদের হাতে, সেই অংশটির সঙ্গে এই অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কোনও যোগ নেই। এখানে ক্ষমতার ভাষা বাংলা, আর মানুষের ভাষা সাঁওতালি, মুন্ডারি, কুর্মালি, হাটুয়া প্রভৃতি। রাজনৈতিক নেতারা উচ্চবর্গীয়, সরকারি আমলারা উচ্চবর্গীয় শাসিতদের কোনও প্রতিনিধিত্ব সেখানে নেই।
১৯৫৬ সালে রাজ্য পুনর্গঠনের সময় অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের সাংস্কৃতিক ঐক্য ও আশা-আকাঙ্ক্ষার দিকে যথেষ্ট নজর না দিয়ে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সুবিধাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। যেমন মানভূম ছিল এক সুষম সাংস্কৃতিক এলাকা, তাকে তিন টুকরো করে এক টুকরো ধানবাদকে ঢোকানো হল বিহারে, আর এক টুকরো হল পুরুলিয়া। আর তৃতীয় চান্ডিলকে শিল্পগোষ্ঠীর তাড়নায় যোগ করা হল পূর্ব সিংভূম (বিহার)-এর সঙ্গে। সারা দেশে এ রকম নানা নজির আছে।
যাকে জঙ্গলমহল বলা হচ্ছে, সেই এলাকার ভাষা সংস্কৃতি খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে বর্তমান ঝাড়খণ্ডের সিংভূম বা ধানবাদের মিল প্রচুর। এই অঞ্চলটি ঝাড়খণ্ডের অন্তর্ভুক্ত হলে ভাল হত। নানা কারণে তা হয়নি। কিন্তু হয়নি বলে জঙ্গলমহলের মানুষের আত্মপরিচয়ের আকাঙ্ক্ষা মরে গেছে, এমন নয়। বরং তা আরও তীব্র হয়েছে। লালগড়ের আন্দোলন যতটা না উন্নয়নের দাবিতে, তার চেয়ে অনেক বেশি আত্মপরিচয়ের দাবিতে। এবং ঝাড়খণ্ডের অন্তর্ভুক্ত হয়নি বলেই এই আত্মপরিচিতির স্বীকৃতি দেওয়া সম্ভব নয় এমন কথা বলাও ঠিক হবে না। একটি রাজ্যের মধ্যে কিছু প্রান্তিক পরিচিতির মানুষ থাকতেই পারেন। তাঁদের পরিচিতিগত স্বাতন্ত্র্য যদি বৈষম্যের কারণ না হয়, তা হলে বিচ্ছিন্নতার বোধ এবং দাবি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
পশ্চিমাঞ্চলে উন্নয়নের অধিকর্তারা আসেন বাইরে থেকে, তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিকে আচ্ছন্ন রাখে ঔপনিবেশিক শাসকীয়তা। কী ভাবে এবং কেমন উন্নয়ন হবে, সে বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সাধারণ মানুষের নেই, তা ঠিক হবে শাসক পশ্চিমবঙ্গের ‘মূল ধারা’র দ্বারা। একটা উদাহরণ দিই। জঙ্গলমহলে অনেক চিকিৎসক দরকার। বাইরের ডাক্তাররা এই এলাকায় যেতে চান না। অথচ এলাকার যে অল্পবয়সিরা ডাক্তারি পড়তে চান তাঁরা সে সুযোগ পাচ্ছেন না। ২০০১ সাল পর্যন্ত মেডিক্যাল কোটার সুবাদে কিছু আদিবাসী ওই সুযোগ পেয়েছিলেন, কিন্তু মেডিক্যাল কাউন্সিলের এক সার্কুলার মেনে তাঁদের সংরক্ষণের সুযোগটাকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে মেডিক্যালে আদিবাসী ছাত্রছাত্রীর ভর্তি ভয়ানক কমে যায়।
অন্য একটি উদাহরণ হল জঙ্গল। বনবিভাগের সঙ্গে গ্রামবাসীদের যৌথ ব্যবস্থাপনায় জঙ্গল রাখার যে নীতি, তা নামেই যৌথ। জঙ্গলের আয়ের একটা বড় অংশ ক্ষমতাবানরা লুঠ করার পর যা থাকে, তার ৭৫ শতাংশ সরকার নিয়ে নেয়, লোকেরা পায় ২৫ শতাংশ। এই ব্যবস্থা পালটে, সরকার ও স্থানীয় মানুষের মধ্যে ভাগ হওয়া উচিত ২৫:৭৫। এই পরিবর্তন করতে পারে রাজ্য সরকার, বা ষষ্ঠ তফসিলের অধীনে গঠিত স্বশাসিত সংস্থা। ষষ্ঠ তফসিলের প্রয়োগ শুধু অসম, মেঘালয় ও ত্রিপুরায় আছে, সংসদে আইন পাশ করে জঙ্গলমহলকে এর আওতায় আনা যায়, আনা উচিত।
বামফ্রন্ট সরকার পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন দফতর গড়েছিল, এই সরকারও যা চালু রেখেছে। কিন্তু মানুষকে উন্নয়ন এবং স্ব-বিকাশের প্রক্রিয়ায় যোগদানের সুযোগ কোনও দফতর গড়ে দেওয়া যায় না। দফতর চলে শাসকীয় ভঙ্গিতে, যা সম্পূর্ণ সদিচ্ছা নিয়ে কাজ করলেও ‘তোমার ভাল আমরা করব, তোমাদের সব দায়িত্ব আমাদের’ গোছের চিন্তা থেকে সংশ্লিষ্ট জনসাধারণের আনুগত্য আদায়ের বাইরে বেরোতে পারে না। কিন্তু যেখানে মানুষের বঞ্চনার ইতিহাস তার পরিচিতিগত অবদমনের ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত, সেখানে শুধু উন্নয়ন নয়, প্রয়োজন মানুষকে তার স্ব-বিকাশের অধিকার দেওয়া, যার জন্য দরকার স্ব-শাসনের নিশ্চিতি। দার্জিলিঙের পাহাড়ে এমন আলোচনা শুরু হয়েছে, এই সংলাপ পশ্চিমাঞ্চলেও অবিলম্বে শুরু হওয়া দরকার।
১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর গণতন্ত্রের প্রসারে বেশ কিছু পদক্ষেপ করেছিল, কিন্তু সেই গণতন্ত্র প্রসারের চাহিদা যখন বাড়তে থাকে, তখন বামফ্রন্ট সরকারই তাকে দমন করে একাধিপত্যবাদী শাসন প্রতিষ্ঠার দিকে এগোল। নতুন সরকার যদি মানুষের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা স্বীকার করে এগোয়, তা হলেই মানুষের কাছে তার প্রাসঙ্গিকতা থাকবে। সদ্য পট পরিবর্তনের শিক্ষাটা শুধু বামফ্রন্টের জন্য নয়, বর্তমান সরকারের জন্যও বটে।
এখনই জঙ্গলমহলের কিছু জায়গায় ফতোয়া জারি শুরু হয়েছে ঘাসফুল ছাড়া অন্য কোনও ঝান্ডা চলবে না। এটা খুবই খারাপ লক্ষণ।
Previous Iten Editorial Next Item


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.