প্রবন্ধ ১...
কথোপকথন চাই রাজনীতি ও কর্মনীতির প্রতিটি স্তরে
মাজ বদলাচ্ছিল, পরিবর্তন ধরা পড়ছিল নানা দিক দিয়ে গত কয়েক বছর। তার পর ১৩ মে সরকারি ভাবে যে পরিবর্তন ঘোষিত হল, তাকে উপেক্ষা করা অসম্ভব। ডান, বাম, মাঝামাঝি যে দিকেই দাঁড়িয়ে থাকুন, পরিবর্তনের বাস্তবতাকে অবহেলা করা শক্ত। যত তাচ্ছিল্যই করা হোক, বাঙালিকে অনেক দিন ভাবাবে এটা কী হল?
এই ধরনের তীব্র, সংঘর্ষঘন, দ্রুত ধাবমান বর্তমানের ইতিহাস লেখাও শক্ত। ইতিহাস লিখতে গেলে যে প্রয়োজনীয় এবং নিরাপদ দূরত্ব লাগে, তার সুযোগ এখানে নেই। পরে ইতিহাসবিদরা তাঁদের কাজ করবেন, কিন্তু রাস্তাঘাটে, সমাবেশে, বৈঠকে সাধারণ বাঙালি ইতিমধ্যে ইতিহাসচর্চা শুরু করে দিয়েছে। দীর্ঘ তেত্রিশ বছরের বামফ্রন্ট শাসনের স্বরূপ নিয়ে যে যার মতো পরিবর্তনের ইতিহাস সাজাচ্ছেন। এই ইতিহাস নিজেকে জড়িয়ে আমরা যে কাল পেরিয়ে এসেছি, পেরোচ্ছি, আমরা কী করে চালিত, শাসিত হতাম, আর আজ কী করে হব, তার কথাকাহিনি। বর্তমানকে ঘিরে এই ইতিহাসচর্চায় আত্মপ্রতিফলন ঘটতে বাধ্য।
কথোপকথন নানা মঞ্চে। বণিকসভায় মুখ্যমন্ত্রী। কলকাতা ২০১১
১৯৭৭-এর পরিবর্তনের সঙ্গে ২০১১-র পরিবর্তন কতটা তুলনীয়? সেই তুলনা কোন কোন দিক থেকে? সমাহিত লোকেরা এবং এ পরিবর্তনে যাঁরা আঘাত পেয়েছেন তাঁরা বলবেন, কেন ১৯৭৭ থেকে সাম্প্রতিক ইতিহাস শুরু করব? কেন ১৯৬৭ থেকে নয়? কারও মনে হবে, এটা কূটতর্ক, কেউ ভাববেন এটা সাম্প্রতিক কালকে ধরার দুটো আলাদা ধরন। কারও মনে হবে, ২০১১’কে বোঝার জন্য ১৯৭৭-এর থেকেও পিছনে যেতে হবে। কিন্তু বর্তমানকে বোঝার জন্য অতীতে যাওয়ার কৌশল জানা চাই। না হলে কেবল অতীতের পাকদণ্ডীতে ঘুরে মরতে হবে, পশ্চিমবঙ্গব্যাপী পটপরিবর্তনকে বোঝা যাবে না।

এই পটপরিবর্তনের একটা অথবা একগুচ্ছ আর্থ-সামাজিক কারণ আছে ঠিকই, কিন্তু সমান গুরুত্বপূর্ণ হল শাসনপ্রণালীগত কারণ। বামফ্রন্টের সাফল্যের উপাদান যেমন শাসনপ্রণালীর মধ্যে নিহিত ছিল, তেমনই তার ব্যর্থতার পিছনেও শাসনপ্রণালীগত কারণ আছে। এটাই বাস্তব।
সেই বাস্তবতা বোঝার উপায় কী? তা বোঝার আগে আরও একটা দুটো কথা বোঝা দরকার। এক সময় চিনে মনে করা হত, সম্রাটের শাসন স্বর্গাগত আদেশ এবং বিধানের জোরে চলে। তাই তার ক্ষয় নেই। অনুরূপ অতিকথা বামফ্রন্ট শাসনকালে বহু বুদ্ধিজীবী, সমালোচক ও চিন্তাবিদকে আচ্ছন্ন করেছিল। ফলে, যাকে বলা যায় সমাজের প্রবহমান ইতিকথার সংঘর্ষপূর্ণ চরিত্র, তার থেকে এই বুদ্ধিজীবীরা চোখ সরিয়ে নিয়েছিলেন। অনেক সময় ভুলে থাকতে চেয়েছিলেন সমাজের সংঘর্ষ ও দ্বন্দ্ব। এঁদের ইতিহাসবোধ ছিল অতিকথায় আচ্ছন্ন। এঁরা বিস্মিত হয়েছেন, তবে তারও বেশি আহত হয়েছেন এই পরিবর্তনের চপেটাঘাতে।
গ্রামাঞ্চলে আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে সংঘর্ষ বাড়তে লাগল কেন? পঞ্চায়েতকে ঘিরে বিকেন্দ্রীকরণের শাসনপ্রণালী থেকে গ্রামের কোন সামাজিক স্তর ক্ষমতা পেল? কলকারখানা বন্ধ হয়ে শ্রমিকরা গেল কোথায়? কেন হাজার হাজার ছেলেমেয়ে লেখাপড়ার খোঁজে পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে চলে গেল, ঠিক যেমন ডুবন্ত জাহাজ ফেলে মানুষ পালায়? গ্রাম-গ্রামান্তরে শহর-শহরতলিতে জনজীবনের দুর্বত্তায়ন হল কী করে? ভূমি সংস্কারের সীমা অত দ্রুত টানা হল কেন? এ রকম এক গুচ্ছ প্রশ্নের যেমন আর্থ-সামাজিক অন্বেষণ আছে, তেমনই শাসনরীতিতে এ সবের কারণ ও প্রতিফলন, দুইই আছে।
এ সবের ইতিহাস কেমন ভাবে ২০০৬ থেকে ২০১১ এই পাঁচ বছরের ঘনীভূত সংঘর্ষকালে পরিণত হল, তার জন্য পুরনো বছরগুলোর নানা ঘটনাকে দিকচিহ্ন হিসাবে বুঝতে হবে। ভিখারি পাসওয়ানের অন্তর্ধান হোক আর পটু মুড়ার অনাহার মৃত্যু হোক তার নানা স্বাক্ষর এখনও সমাজে রয়েছে। এই সব ঘটনা নানা দিক থেকে তার পরিণতিসূচক স্বাক্ষর রেখে গিয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা, এই সব স্বাক্ষর জনচৈতন্যে আছে। সেই দিকচিহ্নগুলিকে খোঁজার দক্ষতা থাকলে গত তেত্রিশ বছরের শাসনের অকথিত ও অর্ধকথিত ইতিহাস বোঝা যাবে। এটা শুধু বুদ্ধিবৃত্তির বিষয় নয়। গণতন্ত্রের একটা বড় দিক তার আত্মচৈতন্য। গণরাজনীতির একটা বড় বিশেষত্ব, অনুষ্ঠান না করেই প্রায় নিঃশব্দে অতীতের এই সব নানা দিকচিহ্নকে সামনে নিয়ে আসা। গণরাজনীতি প্রবল হয়ে ওঠে এই পদ্ধতিতে।

১৯৭৭-এ পশ্চিমবাংলায় যে প্রশাসনব্যবস্থা শুরু হয়, তার কিছু কিছু অভিনব দিক ছিল। সর্বাপেক্ষা অভিনব দিক ছিল সমাজে হিংসা কমানো। এক নতুন বৃহত্তর রাজনৈতিক সমাজ নির্মিত হল নানা দিককে অন্তর্ভুক্ত করে। স্বল্প কিছু অধিকার সীমিত ভাবে স্বীকৃত হল। ভাগচাষির অধিকার, শ্রমিকের সংগঠনের অধিকার, এই সীমাবদ্ধ অধিকারের অন্যতম।
ফ্রন্ট ছিল এই রকমই এক শাসনকৌশল। ভোটের অঙ্ক ছাড়াও মিলেমিশে শাসন করার এটা ছিল এক নতুন রীতি। তেমনই দল দিয়ে প্রশাসনকে শক্ত করা ছিল অন্য এক রীতি বা কৌশল। এই সব কৌশল দিয়ে হিংসা প্রশমিত হল। কিন্তু হিংসা নিয়ন্ত্রণের নামে বন্ধ করা হল অন্যায়ের প্রতিকার। বিগত যুগের কোনও অন্যায়ের প্রতিকার হল না। অন্যায়কর্মে যুক্ত আমলা, পুলিশ অফিসার, রাজনীতিবিদ সবারই নতুন সৌরমণ্ডলে স্থান হল। এই নতুন দেওয়া-নেওয়া, শাসনের সম্পদ ভাগাভাগি করে খাওয়া, পান্ডে শেঠ মাস্টার ইত্যাদিদের দিয়ে শাসন বলবৎ রাখা, দাতাগ্রহীতা সম্পর্কে গ্রামবাংলাকে বেঁধে রাখা এ রকম বহু উপায়ে এই নতুন শাসনরীতি আমাদের ওপর চালু হল। শাসন মেনে নাও, চেষ্টা করব যাতে তুমিও কিছু পাও, কিন্তু প্রতিবাদ কোরো না, অধিকারবোধে জেগে উঠো না, তা হলে শাস্তি অনিবার্য এই ভাবে বাংলা চালিত হল। এই বিষবৃক্ষের ফল রাজারহাট, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, জঙ্গলমহলে বহু হত্যা আর নির্বিচার নিপীড়ন। রাজনৈতিক সমাজ নির্মিত হয়েছে, গণতন্ত্র প্রসারিত হয়েছে এই কায়দায়। এই সর্বব্যাপী হিংসাকে ফিরিয়ে আনার জন্য তো ১৯৭৭-এ পরিবর্তন আসেনি।
ছকে বাঁধা বামপন্থা এবং তার নানা রঙের অনুরাগীদের চেয়ে গণরাজনীতি অনেক সমৃদ্ধ, তা আর এক বার প্রমাণিত হয়েছে। চিন্তাবিদরা যদি দ্রুত এটা উপলব্ধি করেন, মঙ্গল।

এই হিংসাত্মক গণতন্ত্র এবং শাসনপ্রথা থেকে পরিত্রাণ পেতে বাঙালি এক দিকে ফিরে গিয়েছে গত শতাব্দীর তিরিশের দশকের কিছু রাজনৈতিক স্টাইলের দিকে, অন্য দিকে নতুন করে জনজীবনের সংঘর্ষ কমিয়ে সমাজের নানা উপাদানকে অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম এক সমাজ তৈরির কৃৎকৗশলের অন্বেষণে বাঙালি আজ রত হয়েছে। এতে অভিনবত্ব আছে, সম্ভাবনা আছে, সমস্যাও ওত পেতে রয়েছে।
তিরিশের দশকে মৌলানা ভাসানী বা ফজলুল হকের রাজনৈতিক নেতৃত্বের স্টাইলের বৈশিষ্ট্য ছিল সংগঠিত দলের পরিবর্তে ভ্রাম্যমাণ নেতৃত্ব নিয়ে জনরাজনীতিকে পরিচালনা করা, ফ্রন্ট গড়া, আগুন নেভানোর কায়দায় যেখানেই অসন্তোষ বা সমস্যা, সেখানে ছুটে যাওয়া, লিগ, হিন্দু মহাসভা যৌথ মন্ত্রিসভা (যা অবশ্য পরে এল) ধরনের যৌথ আন্দোলনের মাধ্যমে সংগঠিত দলের অভাব মেটানো, এবং আইন, প্রশাসন বিধি ও আমলাতান্ত্রিকতার প্রতি একটা ‘স্বাস্থ্যকর ঘৃণা’ দিয়ে সহজ বুদ্ধিতে শাসন চালানো বা রাজনীতির লাগাম ধরে রাখা।
এই ধরনের ভ্রাম্যমাণ রাজনীতি বা রাজনৈতিক নেতৃত্ব স্বাভাবিক ভাবেই দীর্ঘমেয়াদি রণনীতির ওপর নির্ভরশীল নয়। এই রাজনীতি তাৎক্ষণিক, কৌশল-নির্ভরশীল। এখানেই এর গুণ বা জোর। এখানে এর সমস্যা এবং বিপদ।
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী যেখানে নিজের নিবার্চনী এলাকার হাসপাতালের ব্যবস্থা কখনও দেখার সময় পাননি, উপরোক্ত গুণেই বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী স্বল্প দিনে সেই হাসপাতাল পরিদর্শনে সক্ষম। ভ্রাম্যমাণ রাজনীতির গুণেই কোচবিহার থেকে জঙ্গলমহল পর্যন্ত একই ভাবনায় বাঙালিকে ভাবিত করা গিয়েছে। এক নতুন সমাজের আভাস দেখা গিয়েছে, যার চরিত্র হল বহু বর্ণচ্ছটার সমাহার, ‘রেনবো’ সমাজ। এবং এই গুণের দৌলতে বাঙালি তার রাজনীতিতে কথাবার্তা চালানোর আকর্ষণ খুঁজে পেয়েছে।
কথাবার্তায় কি সব সমস্যার সমাধান হয়? তা হয় না, আমরা সবাই জানি। কিন্তু একমত হওয়ার জায়গা বাড়ে। সংঘর্ষের উপাদান কমে। বা বলা যায়, অস্ত্রমাধ্যমে বিরোধ নিরসনের পরিবর্তে রাজনীতির মাধ্যমে বিরোধ নিরসনের মনোবৃত্তি বাড়ে। এটা দুরূহ রাস্তা। কথাবার্তার রাজনীতিতে সত্য উদ্ঘাটন করা, পুরনো বিরোধের সমাধান করা শক্ত কাজ। কারণ, ন্যায়ের ডাক থেকে যায়। ধনী ও সম্পন্নদের আলোচনাকক্ষ থেকে কথোপকথনকে রাস্তায় টেনে বের করে আনা, ন্যায়ের নিরিখে কথোপকথন চালানো অত্যন্ত ধৈর্যসাপেক্ষ, দক্ষতাসাপেক্ষ এবং কঠিন। অথচ অন্য পথ নেই। যত দূর সম্ভব কথোপকথনের বহুত্বকে, জনমুখী প্রবণতাকে সুযোগ দিতেই হবে।

অন্যায়ের প্রতিকার এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার দাবিতে যেমন কথাবার্তা চলে, সেই রকম এই অন্যায়ের প্রতিকার অন্বেষণ এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার নিরন্তর প্রয়াস কথোপকথনের প্রক্রিয়াকে দ্বন্দ্বদীর্ণ করে তোলে। পশ্চিবঙ্গের বর্তমান শাসকরা সদ্য ক্ষমতায় এসেছেন। রাতারাতি চমকপ্রদ কিছু করার ক্ষমতা তাঁদের নেই। জনসাধারণ সে আশাও করে না। কিন্তু নতুন শাসকরা কথোপকথনের এই রাজনীতির সমস্যা এবং প্রতিকূলতার কথা ভেবে রেখেছেন কি?
আশার কথা, পশ্চিমবঙ্গ এক ছোট আকারে হলেও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে চলেছে। সমাজের নিচু স্তর থেকে তথাকথিত অল্পশিক্ষিতরা রাজনৈতিক নেতৃত্বে উঠে আসছে। মেয়েদের উৎসাহ জেগেছে ব্যাপক ভাবে। বাঙালি ভদ্রলোকেরা আশাহত। আর এ-ও লক্ষ করার মতো: সাম্প্রতিক কালে বাঙালির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এ রকম ভাবে এক জনের ওপর এত নির্ভর করেনি। তাই বর্তমানের রোম্যান্স এবং অনিশ্চয়তাকে নতুন করে স্বাগত জানানোর সময় এসেছে। প্রয়োজন, সমাজের গতিশীলতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেদের গতিশীল করা।

লেখক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ-এর অধিকর্তা

Previous Story Editorial Next Item


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.