|
|
|
|
আমার শিলিগুড়ি |
লাগামহীন দূষণ, দুঃসহ স্মৃতিও
তাড়া করে বেড়ায় শিলিগুড়িকে
কিশোর সাহা • শিলিগুড়ি |
|
|
কী ভাবে দূষিত হচ্ছে ‘আমার শিলিগুড়ি’। শহর ও লাগোয়া এলাকার আকাশ-বাতাস, নদী-নালা-পুকুর যেন
রোগের
উৎস হয়ে উঠছে। নিঃশব্দে মারণ রোগ-ব্যাধির জীবাণু বাসা বাঁধছে শরীরে। কী ভাবে এই শহরকে দূষণের
হাত থেকে রেহাই দেওয়া যেতে পারে, পরিবেশপ্রেমী, বিশেষজ্ঞ সহ আমজনতা কী ভাবছেন তা নিয়ে
আনন্দবাজারের ধারাবাহিক প্রতিবেদন। আজ প্রথম কিস্তি। |
অফিসের ব্যস্ততম সময়ে সুনসান হিলকার্ট রোড। দু’চারজন চলাফেরা করলেও সকলেরই নাক-মুখ ঢাকা। এর মধ্যে দেহ নিয়ে কিরণচন্দ্র শ্মশানে ছুটছে গাড়ি। বিমানবন্দর, বাস স্ট্যান্ড, স্টেশনে শিলিগুড়িতে আসার লোকের সংখ্যা হাতে গোনা। শহর ছেড়ে যাওয়ার জন্য সর্বত্রইলাইন। সন্ধ্যার পরে শহরের অলিগলি, পথঘাট জনবিরল। ইতিউতি পুলিশের গাড়ি ঘুরলেও নাক-মুখ মুখোশে ঢেকেছেন অফিসার-কর্মীদের অনেকেই।
আতঙ্কের এই ছবি এতটুকুও কাল্পনিক নয়। অক্ষরে-অক্ষরে সত্যি।
মারণ-জ্বরের কথা মনে পড়ে! ২০০১ সালে ঘুম কেড়ে নিয়েছিল সকলের। রাতারাতি ‘আতঙ্কনগরী’ হয়ে উঠেছিল শিলিগুড়ি। দু’সপ্তাহের মাথায় শহর যখন স্বাভাবিক হয়, ৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে মারণ জ্বরে। তার কারণ নিয়ে গবেষণা হয়েছে। অনেক রিপোর্টও জমা পড়েছে সরকারের কাছে। গবেষকরা নানা মত প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মধ্যে মতানৈক্যও রয়েছে। একটা ব্যাপারে প্রায় সকলেই সে সময়ে একমত, শহরের পরিবেশ মাত্রাতিরিক্ত দূষিত হওয়ায় শিলিগুড়ি জুড়ে বাড়ছে নানা রোগের প্রকোপ। পরিবেশ বাঁচাতে কী কী করণীয় তা নিয়ে সেমিনার, কর্মশালা, সমীক্ষাও হয়। বেশির ভাগ প্রস্তাব-পরামর্শ কাগজে-কলমেই আটকে যায়।
পরিণতিতে যা হওয়ার তাই-ই হচ্ছে। ধোঁয়া-দূষণে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে শ্বাসকষ্টের রোগীর সংখ্যা। জল দূষণে শহরে সারা বছরই ডায়েরিয়ার প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। ছড়াচ্ছে ভাইরাল হেপাটাইটিস। বিশেষত, শিলিগুড়ি শহরে ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিসের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। শিশু পড়ুয়াদের মধ্যে ‘হুপিং’ কাশিও ক্রমশ বাড়ছে। এর পাশাপাশি শব্দ দূষণের কারণেও কান ও মাথার রোগ বেড়ে চলেছে।
এমন সব তথ্য মিলছে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও স্থানীয় একাধিক নার্সিংহোম থেকেই। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে নথি অনুযায়ী, রোজ গড়ে নতুন-পরানো মিলিয়ে বহির্বিভাগে রোগীর সংখ্যা ১৪০০ জন। বিশেষজ্ঞদের অনেকেরই নজরে পড়েছে দূষণ সংক্রান্ত রোগের প্রকোপ বাড়ার বিষয়টি। মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান শৈবাল গুপ্ত। যিনি বর্তমানে কলেজ ও হাসপাতালের সুপার। শৈবালবাবু হিসেব করে দেখেছেন, “এক দশক আগে বহির্বিভাগে শিলিগুড়ি, সংলগ্ন এলাকা থেকে আসা রোগীদের মধ্যে মোটামুটি ১০ শতাংশে দূষণ সংক্রান্ত রোগ মিলত। এখন তা ৩০ শতাংশের কাছাকাছি। দূষণ রোধে সচেষ্ট না-হলে আগামী দিনে বড় মাপের বিপর্যয়ের আশঙ্কা উড়িয়ে দিতে পারছি না।”
কী ধরনের রোগ বাড়ছে সেই তথ্যও দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। যেমন শব্দ দূষণের জেরে শিলিগুড়ি ও লাগোয়া এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে ‘ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমা’, ‘ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস’ ক্রমশ বাড়ছে। ফুসফুসে টিবির সংক্রমণও বেড়ে যাচ্ছে। আর জল দূষণের জন্য শহরের মহানন্দা, ফুলেশ্বরী, জোড়াপানি, বালাসন লাগোয়া এলাকায় চর্মরোগের প্রকোপও অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছে।
|
পরিবেশ দূষণ |
তথ্য কী বলছে |
• জলদূষণে শিশুদের ভাইরাস জনিত পেটের অসুখ বাড়ছে।
• প্রতিদিন গড়ে ১০-১২টি শিশু শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছে।
• ধুলো, গাড়ির ধোঁয়ায় বাড়ছে চোখের রোগ। বাড়ছে কিডনির অসুখ ও ক্যান্সার।
(সূত্র: উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ) |
|
কত বিষ বাতাসে |
• হিলকার্ট রোডের বাতাসে প্রতি ঘন মিটারে ধুলিকণা ৩৮২ মাইক্রো গ্রাম (স্বাভাবিক ১৪০)।
• নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড প্রতি ঘন মিটারে ৩৩.৮২-৯২.৯ মাইক্রো গ্রাম (স্বাভাবিক ৬০)।
(সূত্র: দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ) |
|
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন |
নাইট্রোজেনের ওই যৌগ ফুসফুসের রোগের অন্যতম কারণ। যা মারাত্মক হারে শিলিগুড়িতে বাড়ছে। |
|
|
মেডিক্যাল কলেজের বিশেষজ্ঞ শেখর চক্রবর্তীও দূষণ-পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। তাঁর কথায়, “অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, দূষণ সংক্রান্ত কারণে রোগের সংখ্যা বাড়ছে। চর্মরোগ তো বটেই, জল-দূষণের কারণে পেটের রোগ মারাত্মক ভাবে বেড়ে গিয়েছে শিলিগুড়ি ও আশেপাশের এলাকায়। বায়ু দূষণের কারণেও নানা রোগ হচ্ছে। যা উদ্বেগজনক।” বস্তুত, দূষণে শরীরে কোন মারণ রোগের জীবাণু বাসা বাঁধছে তা চটজলদি বোঝাও মুশকিল। অনেক সময়েই রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। সে সব ক্ষেত্রে ময়নাতদন্ত করতে গিয়ে চমকে উঠেছেন বিশেষজ্ঞরা। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, মৃতের শরীরে দূষণ জনিত কারণে বৃহদন্ত্রে মারাত্মক ক্ষত হয়ে রয়েছে। কারও লিভারে ‘সিস্ট’ মিলেছে। এমনকী, মৃতের কারও শরীরে ‘আর্সেনিক’ দূষণের প্রমাণ মিলেছে। আবার কারও শরীরে ‘লেড’ জনিত দূষণের চিহ্ন মিলেছে। ‘সোরেসিস’-এর মতো চর্মরোগের প্রমাণও মেলার ঘটনাও ঘটেছে।
উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের সুপার শৈবাল গুপ্ত দীর্ঘদিন শিলিগুড়ি শহরে আছেন। তিনি আদতে এক ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ। শৈবালবাবুর কথায়, “শিলিগুড়ির জল-স্থল সর্বত্রই দূষণের মাত্রা যে বাড়ছে তা রোগের উৎস খুঁজতে গেলেই স্পষ্ট হয়ে যায়। ফুসফুসের রোগ বাড়ছে। শিশুদের অনেকেই বছরে গড়ে ৩ থেকে ৬ বার ডায়েরিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। শিশুদের মধ্যে শ্বাসকষ্টের রোগও বাড়ছে। এখন হাসপাতালে আসা শিশুদের ৫ থেকে ১০ শতাংশ শ্বাসকষ্টে ভুগছে।” তিনি বলেন, “অনেক সময় ময়নাতদন্তের সময়ে দেখেছি রোগীর শরীরের দূষণ জনিত নানা রোগ বাসা বেঁধেছিল। যা বাইরে থেকে বোঝাই যায়নি। যা কি না দুরারোগ্য ক্যানসারের মতো প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা দূষণ সংক্রান্ত রোগের সব তথ্য-পরিসংখ্যান তৈরি করছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে তা জমা দেব। তা নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধও করব।” ঠিকঠাক তথ্য-পরিসংখ্যান কবে তৈরি হবে তা ভবিষ্যৎ বলবে। কিন্তু, তত দিন শিলিগুড়ির বাতাস যে আরও দূষিত হয়ে উঠবে তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তথ্যে, শিলিগুড়ির বাতাসে ভাসমান এবং শ্বাসযোগ্য ক্ষতিকারক ধূলি কণার পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত। বাড়ছে ক্ষতিকারক গ্যাসের মাত্রা। যা স্বাস্থ্যের পক্ষে যথেষ্ট উদ্বেগের। পরিসংখ্যান বলছে, মহানন্দা সেতু লাগোয়া এলাকায় ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাতাসে নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ছিল প্রতি ঘন মিটারে ৩৩.৮২ মাইক্রো গ্রাম। মার্চে ছিল ৫৩.৮২ মাইক্রো গ্রাম। ২০০৮ সালে তা দাঁড়িয়েছিল ৬১.৫ মাইক্রো গ্রাম। স্বাভাবিক পরিমাণ ৬০ মাইক্রোগ্রামের চেয়ে যা বেশি। সর্বোচ্চ ৯২.৯ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড মিলেছে।
২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শহরের ব্যস্ততম এলাকা হিলকার্ট রোডে মহানন্দা সেতু লাগোয়া মোড় এলাকায় সমীক্ষা চালিয়ে জানা গিয়েছে, বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার গড় পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে আড়াই গুণ বেশি। তার পরে আর সমীক্ষা হয়নি। পরিবেশপ্রেমী সংস্থা ‘ন্যাফ’-এর মুখপাত্র অনিমেষ বসুর কথায়, “শিলিগুড়িতে বড় কারখানা নেই। কিন্তু, যে হারে যানবাহন হু হু করে বাড়ছে তাতে ধূলিকণার (যার মধ্যে বিষাক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইডই বেশি) গড় পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ গুণ বেশি। আগামী দিনে শিলিগুড়িতে শ্বাস নেওয়া মুশকিল হতে পারে।” বিশেষত, বাতিল সরকারি যান জবরদস্তি চালানো ও সিটি অটো রমরমায় শঙ্কিত পরিবেশপ্রেমীরা।
|
(চলবে)
|
ধরা পড়ল হনুমান
নিজস্ব সংবাদদাতা • রঘুনাথপুর |
টানা ১২ ঘন্টার চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত বাগতবাড়ি গ্রামের হনুমানটিকে ধরতে পারল বন দফতর। বাঁকুড়ার সোনামুখী রেঞ্জ থেকে ঘুমপাড়ানি গুলি চালাতে অভ্যস্ত এক কর্মীকে নিয়ে আসে পুরুলিয়া বন দফতর। শনিবার সন্ধ্যায় ওই কর্মীকে নিয়ে গ্রামে যান রঘুনাথপুরের বিট অফিসার তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়। শনিবার থেকে বন দফতরের কর্মীরা তার উপরে নজর রেখেছিলেন। রঘুনাথপুর ১ ব্লকের ওই গ্রামে গত তিন-চার দিন ধরে উপদ্রব চালাচ্ছিল হনুমানটি। তার আক্রমণে জখম হন পাঁচ জন গ্রামবাসী। তরুণবাবু বলেন, “গুলি লাগার পরে হনুমানটিকে ধরা সম্ভব হয়।” রঘুনাথপুরের রেঞ্জার সোমনাথ চৌধুরী বলেন, “হনুমানটিকে জেলারই বন্যপ্রাণী পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে।” |
|
|
|
|
|