একটা লাফ মারলেই দুবাই। লাফটা অবশ্য মারতে হবে পারস্য উপসাগরের উপর দিয়ে, বিমানে।
কলকাতা থেকে দুবাই প্রায় ২০৯৬ মাইল। এমিরেটসের উড়ানে যেতে সময় লাগল সাড়ে চার ঘণ্টা। বিমানবন্দরে নামার আগেই উপর থেকে দেখা গেল আরব সাগরের অনন্ত জলরাশি। এর পর পাখির চোখে দেখা ধূ ধূ মরুভূমি। পরে নীচে নেমে অবাক হলাম, এই মরুর বুকেও কী অসম্ভব সবুজায়ন।
ছোট্ট দেশ। সুন্দর রাস্তাঘাট। বাড়িগুলিও চেয়ে দেখার মতো। আশপাশ অসম্ভব পরিচ্ছন্ন। হবে না-ই বা কেন? ভিক্ষে করতে গিয়ে ধরা পড়লে পাঁচ বছরের জেল। সরকারি ফাঁকা জমিতে কেউ ছাউনি করতে গেলে প্রশাসন ভেঙে দেবে। |
রাস্তার পাশেই টালিতে বাঁধানো ফুটপাথ। গাছের গোড়া গুল্ম দিয়ে সাজানো। আমরা দেখলাম ‘বুর্জ-আল আরব’। ‘বুর্জ’ মানে হোটেল। আর ‘আল’ মানে ইংরেজির ‘দি’। এটি নাকি বিশ্বের একমাত্র সাততারা হোটেল। ১৯৯১-তে শুরু হয় এর নির্মাণকাজ। উদ্বোধন হয় ’৯৫-তে। এর আদল অনেকটা নৌকোর পালের মতো। ডাঙা থেকে প্রায় আড়াইশো কিলোমিটার দূরে সাগরে একটা দ্বীপ নির্মাণের পর তৈরি করা হয় হোটেলটি। এর উচ্চতা ২৬১ মিটার। ঘরের ভাড়া রাত পিছু কম করে ২২০০ ডিরহাম (এখন ১ ডিরহামের দাম ১২ টাকার কিছু বেশি)। উপরের তিনটি তলের এক-একটি রয়্যাল স্যুটের ভাড়া এর প্রায় পাঁচ গুণ। এ সব স্যুট নিলে বিমানবন্দর থেকে হেলিকপ্টারে চড়িয়ে সোজা উড়িয়ে আনা হবে হোটেলে। হোটেলটি সাজাতে ব্যবহার করা হয়েছে প্রায় ৮০০ কিলোগ্রাম সোনা।
সমুদ্রের নীচে তৈরি হয়েছে দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ সুড়ঙ্গ। গাড়িতে সেই সুড়ঙ্গ ধরে যাওয়া। দু’পাশের দেওয়াল রংবেরঙের টাইলস দিয়ে সাজানো। ২৪ ঘণ্টা আলো ঝলমল করছে। এটা দিয়ে যাওয়া যাবে ‘পাম জুমেরিয়া’য়। |
এটি অদ্ভুত এক উপনিবেশ। সমুদ্রে ছোট ছোট দ্বীপ তৈরি করে পৃথিবীর ভিন্ন দেশের আদল। আর সেখানে তৈরি হচ্ছে বিলাসবহুল বাংলো। পৃথিবীর নানা দেশের বিত্তবানদের অনেকের সাত ঘরের একটা বাংলো কিনতে খরচ পড়ছে প্রায় ৫০ লক্ষ মার্কিন ডলার। হেলিকপ্টার থেকে দেখতে লাগে খেজুরগাছের মতো। নাম তাই ‘পাম জুমেরিয়া’। সাগরতীরে ‘জুমেরিয়া বিচ হোটেল’ যেন বিশাল একটা ঢেউ। পেল্লাই আর একটা হোটেল ‘অ্যাট ল্যান্ডাস’। এ সব দেখে, হরেক ছবি তুলে আমরা গেলাম ‘সউক মদিনাত জুমেরিয়া’-তে। ‘সউক’ মানে বাজার। ‘মদিনাত’ মানে পুরনো আর জুমেরিয়া কথাটির অর্থ মৎস্যজীবী। তিন দশক আগে ওই তল্লাট নাকি ছিল মৎস্যজীবীদের বাজার। |
সাগরতীরে সারিবদ্ধ বেশ কিছু আবাসন। সে সবে আধুনিক স্থাপত্যের ছাপ। এ রকমই একটি ‘দুবাই মারিনা’। পাঁচ বছরে তৈরি হয়েছে একগাদা বহুতল। ফ্ল্যাটের ভাড়া খুব চড়া। সাজানো ফ্ল্যাট নিতে গেলে মাসে ভাড়া গুনতে হবে অন্তত সাড়ে তিন হাজার ডিরহাম। একবারে এক বছরের ভাড়া। উপমহাদেশের লোক প্রচুর। এদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ বাংলাদেশ থেকে আসা। ছোটখাটো নানা রকম কাজ করেন এঁরা। দুবাইতে ছোটখাটো কাজ করে কোনওক্রমে দিন গুজরান করতে আসা শ্রমিকদের কাছে অবশ্য এ সব ভাবাই বিলাসিতা। তাঁরা ‘বেড স্পেস’ ভাড়া নিতে বাধ্য হন। রাস্তার পাশে বা যেখানে-সেখানে মাথা গোঁজার চেষ্টা করলে সোজা শ্রীঘরে।
দুবাইয়ের ডেজার্ট সাফারি-র একটা আলাদা আকর্ষণ রয়েছে। মরুভূমি সংরক্ষণের জন্য এখানে নানা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। প্রকল্পের শীর্ষে স্বয়ং রাজা শেখ আহমেদ বিন সইদ আল মাকতুম। দুবাই কনজারভেশন বোর্ড ২২৫ বর্গকিলোমিটার অংশে মরুভূমির প্রাণীকূল এবং জীবজগৎ রক্ষা করছে।
এই ন্যাশনাল পার্কের মাঝে আছে ‘আল মহা ডেজার্ট রেসর্ট অ্যান্ড স্পা’। বড় বড় হোটেল, হরেক প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য লাগে চাষের কাজে। দুবাইতে জলের টানাটানি ব্যাপক। পাশের প্রদেশ ফুজারা থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে মাসাফি এগুলি উপকূলবর্তী অঞ্চল। এ সব অঞ্চলের পাহাড় থেকে পাওয়া যায় পানীয় জল। রাস্তার ধারে রয়েছে প্রচুর খেজুর গাছ। দুবাই মানেই কেনাকাটা। আমাদের বলার আগেই গাইড নিয়ে গেলেন এখানকার সবচেয়ে বড় শপিং মল— দুবাই মলে। এ রকম বিভাগীয় বিপণি নাকি বিশ্বে আর একটাও নেই। প্রায় ২২০০ শোরুম। এর মধ্যে চালু হয়েছে বড়জোর ১৪০০। কয়েক হাজার এসকালেটর, লিফট, চোখ-ধাঁধানো স্থাপত্য। পরিচ্ছন্নতায় যেন একশোয় একশো। একটা পেল্লাই মাছঘরের সামনে ছবি তুললাম। এটি লম্বায় দেড়শো ফুট, চওড়ায় প্রায় ২৫ ফুট, নীল জল টলটল করছে। তাতে রয়েছে বিশালাকার হাঙরের মতো মাছ।
দুবাই মলের সামনে একটা বাঁধানো জলাশয়। আশপাশের সাজানো চত্বরটাকে বলে ‘ওয়াটারফ্রন্ট প্রমোনাডে’। এই জলে ডান্সিং ফাউন্টেন সত্যিই দেখার মতো। সঙ্গীতের মূর্ছনার তালে তালে ফোয়ারার নাচ। সন্ধ্যার পর এতে লাগে রঙের ছোঁয়া। মালিকানা আর তত্ত্বাবধানে দুবাই সরকার। |
প্রমোনাডের এক পাশে ‘বুর্জ খালিফা’। ’২০১০-এ এর উদ্বোধন হয়েছে বিশ্বের উচ্চতম এই ভবনের। এর উচ্চতা ৮২০ মিটার। ১৬০ তলা। স্থপতি নিউ জার্সির আড্রিয়ান স্মিথ। ১২ হাজার শ্রমিক চার বছর ধরে কাজ করেছেন। ইস্পাত আর কাচের অনন্য সৃষ্টি। নীচ থেকে মাঝে না থেমে উপর পর্যন্ত লিফটে যেতে সময় লাগে মাত্র ৫৫ সেকেন্ড। আর এক পাশে বহুতল হোটেল অ্যাড্রেস।
স্যান্ডবোর্ডিং, ক্যামেল ট্রেকস, ডেজার্ট ওয়াকস, হর্স রাইডিং, সান্ধ্যবাসরে বেলিডান্সিং অন্য অভিজ্ঞতা বা আমোদের হরেক সুযোগ রয়েছে দুবাইয়ে। ‘শপিং ক্যাপিটাল অফ মিডল ইস্ট’ দুবাইতে মল রয়েছে গোটা পঁচাত্তর। কেউ কেউ একে বলেন ‘সিটি অফ গোল্ড’।
|