|
|
|
|
প্রথম বর্ষণেই ডুবল কলকাতা |
জল জমার দায় কার, চলছে চাপানউতোর |
নিজস্ব সংবাদদাতা |
মরসুমের প্রথম ভারী বৃষ্টি। ফের ভাসল শহর। ফের ভুগলেন শহরবাসী। আর শহরে জল জমার দায় কার, তা নিয়ে দিনভর চাপানউতোর চলল পুরসভা ও সিইএসসি-র। পুরসভার বক্তব্য, সিইএসসি বিদ্যুৎ দিতে না পারায় শহরের বড় দু’টি পাম্পিং স্টেশন পামারবাজার ও বালিগঞ্জে পাম্প বিকল হয়ে যায়। ফলে নামানো যায়নি জমা জল। জমা জল ঢুকে পড়ে টালা পাম্পিং স্টেশনেও। সিইএসসি-এর পাল্টা দাবি, মাত্র ১২ মিনিট বন্ধ ছিল বিদ্যুৎ সরবরাহ। তাতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। |
 |
ভেনিস নয়, কলকাতা। কলেজ স্ট্রিটের রাস্তায়। |
দুর্ভোগ অবশ্য কমেনি। শুক্রবার সকাল থেকে রাত জলে ডুবে থাকা শহরের সর্বত্র নাকাল হয়েছেন মানুষ। যে সব জায়গায় জল নেমেছে, সেখানেই দেখা গিয়েছে গালিপিটে জমে আছে জঞ্জালের স্তূপ। তার মধ্যে প্লাস্টিকই বেশি। গালিপিটগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করার যে
ব্যবস্থা, সেটা ঠিকমতো কাজ করে কি না, প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও। মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় এ প্রশ্নে নিরুত্তর।
আর তাঁর মেয়র পারিষদ (নিকাশি) রাজীব দেবের দাবি, “রোজই পরিষ্কার করা হয়। শুধু আজ সকাল থেকে বৃষ্টিতে কাজ করা যায়নি।”
এই মরসুমে শহর বানভাসি হবে না, এমনই দাবি করেছিল পুরসভা। রাজীববাবু দু’দিন আগেও জানিয়েছিলেন, বর্ষায় শহর এ বার ‘শুকনো’ থাকবে। তুমুল বৃষ্টিতে হাবুডুবু শহরে তাঁর সব দাবিই ধুয়েমুছে সাফ।
মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, “বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, তাতে জল জমা কিছু অস্বাভাবিক নয়। তবে, জমা জল দ্রুত বের করার মতো পরিকাঠামো পুরসভার আছে। কিন্তু সিইএসসি-র বিদ্যুৎ বিভ্রাটের জেরেই শহরের দু’টি মূল পাম্প ঠিক সময়ে কাজ করতে পারেনি। সে জন্যই শহর বহুক্ষণ জলমগ্ন হয়েছিল। পাম্প ঠিক হওয়ার পরে শহরের অনেক জায়গা থেকেই জল সরতে শুরু করেছে।”
কলকাতা পুরসভার নিকাশি দফতরের যে সমীক্ষা রয়েছে, তাতে শহরে ঘণ্টায় ৬ মিলিমিটার জল নিষ্কাশনের কথা। অর্থাৎ সারা দিনে ১৪৪ মিলিমিটার জল নিষ্কাশন করা যেতে পারে। আর পুরসভার এ দিনের হিসেব অনুযায়ী, শহরে দুপুর পর্যন্তই গড়ে বৃষ্টি হয়েছে ১২০ মিলিমিটার। জিঞ্জিরাবাজার এলাকায় দুপুর পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে ১৬০ মিলিমিটার। পামারবাজারে দুপুর পর্যন্ত বৃষ্টির পরিমাণ ছিল ১০৬ মিলিমিটার। পুর-কর্তৃপক্ষের দাবি, সকাল সাড়ে ন’টা থেকে ১১টা পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে গড়ে ৯০ মিলিমিটার। |
 |
 |
জল ঠেলে পার্ক
স্ট্রিটে বিদেশিনি। |
কলেজ স্ট্রিটে খারাপ হয়ে যাওয়া
একটি বাস থেকে অন্য বাসে। |
|
শুধু কি বিকল পাম্পের জন্যই ভুগল কলকাতা?
পুরসভার অন্দরে অবশ্য শোনা যাচ্ছে আরও একটি কারণ। বিভিন্ন বরো এবং ওয়ার্ডে অভিযোগ, সম্প্রতি প্রায় বেশির ভাগ বরোতেই নিকাশির ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পুরনো কর্মীদের বদলি করা হয়েছে। নতুন এলাকা সম্পর্কে তাঁদের ধারণা না থাকায় এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে অসুবিধা হয়েছে। এই যুক্তি অবশ্য উড়িয়ে দিয়েছেন মেয়র। শোভনবাবু জানান, কর্মীদের এক জায়গা থেকে অন্যত্র বদলি করাটাই নিয়ম। বদলির ফলে বর্ষায় কাজ করতে অসুবিধা হবে এমন ধারণা ঠিক নয়। তা ছাড়া, যাঁদের বদলি করা হয়েছে, সকলেই প্রশিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ার। তবে, মেয়র জানান, খাল কাটার কাজ সব হয়নি। কলকাতা পরিবেশ উন্নয়ন প্রকল্পের (কেইআইপি) কাজও এখনও সব শেষ হয়নি। সেই কারণেই শহরে ১৩৭টি পোর্টেবল পাম্প বসানোর ব্যবস্থা আগে থেকেই ছিল। পাম্পে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের জেরে আরও বাড়তি পাম্প বসাতে হয় জানিয়ে মেয়র বলেন, “দু’এক দিনের মধ্যেই আমরা খাল পরিষ্কার নিয়ে ফের আলোচনায় বসব।” এ দিন সকালে ঠনঠনিয়া পাম্পিং স্টেশনে জল ঢুকে যায়। টালার পাম্পিং স্টেশনে ব্রিক স্যুয়ার ভেঙে যাওয়ায় জল ঢুকে যাওয়ার সম্ভাবনা আগেই ছিল। শোভনবাবু বলেন, “ঠনঠনিয়া স্টেশনে জল নিষ্কাশনের ক্ষমতা বাড়ানোর ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। টালার নিকাশির ব্যাপারেও পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যাতে জল ঢুকতে না পারে।” |
 |
ঝড়ের দাপটে ছিঁড়ে গিয়েছে জাতীয় পতাকা। হাইকোর্টে। |
এ দিনের বৃষ্টিতে শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণের বিস্তীর্ণ অংশ এবং শহরতলি জলমগ্ন হয়ে পড়ে। উত্তরে আমহার্স্ট স্ট্রিট, সুকিয়া স্ট্রিট, বিধান সরণি, কলেজ স্ট্রিট, ঠনঠনিয়া, মধ্য কলকাতার চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, এস এন ব্যানার্জি রোড, আনন্দ পালিত রোড, গভর্নমেন্ট প্লেস ইস্ট, দক্ষিণে টালিগঞ্জ সার্কুলার রোড, বালিগঞ্জ, তপসিয়া, তিলজলা, তারাতলা, লেক গার্ডেন্স, ঢাকুরিয়া, চারু মার্কেট-সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় জল দাঁড়িয়ে যায়। শহরতলির বেহালায় জয়রামপুর জলা, হেমন্ত মুখার্জি রোড, রবীন্দ্রনগর, শ্যামসুন্দর পল্লি, রজনী ব্যানার্জি রোড-সহ বহু জায়গাই ছিল জলের তলায়। জল জমে যাদবপুর, গড়িয়া, পাটুলি, নাকতলাতেও।
কেইআইপি-তে বেহালায় যেখানে নিকাশির কাজ চলছে, বৃষ্টির জল বের করতে সমস্যা হয় সেখানেও। এক আধিকারিক জানান, এই প্রকল্পের আওতায় জমা জল তুলে খালে ফেলার জন্য চৌবাগা, কেওড়াপুকুর এবং মনিখালিতে শক্তিশালী পাম্প বসানোর কাজ শেষ হয়নি। খালগুলোর পলি তোলার ক্ষেত্রেও সমস্যা রয়েছে। সমস্যা হয়েছে ১ নম্বর বরোর অন্তর্গত বেলগাছিয়া এবং রাজা মণীন্দ্র রোডের জমা জল বের করা নিয়েও। কেইআইপি প্রকল্পে বীরপাড়াতে পাম্পিং স্টেশন নির্মাণের কাজ চলছে। দত্তবাগানে পাম্পিং স্টেশনের কাজ শেষ হলেও সেখানে এখনও বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ শেষ হয়নি। ফলে পাম্প ব্যবহার করা যাচ্ছে না বলেও প্রকল্পের আধিকারিক জানান। মেয়র বলেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত কেইআইপি-র পুরো কাজ শেষ না হচ্ছে, কিছু সমস্যা থাকবেই।” তবে আগামী বছর সমস্যা অনেক কমবে বলে আশা প্রকাশ করেন শোভনবাবু।
তুমুল বৃষ্টিতে বানভাসি শহরের হাল ফেরাতে কলকাতা পুরসভার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ এবং নিকাশি দফতরের কর্মীদের সমস্ত ছুটি বাতিল করে দিয়েছেন মেয়র। শহরে জমা জলের হালহকিকত জানতে সারা দিনে বহু বার তাঁকে ফোন করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিদ্যুৎ-বিভ্রাটে আর যাতে দুর্যোগে পাম্পিং স্টেশনে সমস্যা না হয়, সে জন্য সিইএসসি-এর সঙ্গে তাঁরা আলোচনায় বসবেন বলে জানিয়েছেন শোভনবাবু। পাশাপাশি জানিয়েছেন, দুর্যোগ মোকাবিলায় যাঁরা ভাল কাজ করেছেন, তাঁদের পুরস্কৃত করা হবে।
|
ছবিগুলি তুলেছেন দেশকল্যাণ চৌধুরী, অশোক মজুমদার, দেবাশিস রায়, সুমন বল্লভ। |
|
|
 |
|
|