|
|
|
|
‘ইনসেনটিভের’ প্রতিশ্রুতি এ বার পূরণ হবে কি, অপেক্ষায় শিল্পমহল |
পিনাকী বন্দ্যোপাধ্যায় ও দেবপ্রিয় সেনগুপ্ত • কলকাতা |
অন্য রাজ্যের মতো লগ্নি টানতে শিল্প সংস্থাকে ‘ইনসেনটিভ’ বা আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার ব্যাপারে পিছিয়ে নেই পশ্চিমবঙ্গও। কিন্তু শিল্প মহলের অভিজ্ঞতা বলছে, লাল ফিতের বাঁধন ছিঁড়ে তা কার্যকর করার দৌড়ে অনেকটাই পিছিয়ে এ রাজ্য।
আজ, শনিবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে রাজ্যের বিভিন্ন বণিকসভা ও শিল্পকর্তাদের সঙ্গে যে মত বিনিময়ের আসর বসছে, সেখানে বিনিয়োগের উপর আর্থিক ছাড় বা ভর্তুকি নিয়ে রাজ্যের নতুন মুখ্যমন্ত্রী কী দিশা দেন, তা জানতে উন্মুখ হয়ে রয়েছে শিল্পমহল।
কী ধরনের ‘ইনসেনটিভ’ বা আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধার আশ্বাস এত দিন দিয়ে এসেছে পশ্চিমবঙ্গ?
প্রথমত, ‘এক জানলা’ বা ‘সিঙ্গল উইন্ডো’ ব্যবস্থা। লাল ফিতের ফাঁস খুলতে বিভিন্ন সরকারি দফতরে না ঘুরে এক জানলাতেই যাবতীয় কাজ সেরে ফেলা। দ্বিতীয়ত, আর্থিক সুবিধা বা ছাড়। স্ট্যাম্প ডিউটি থেকে শুরু করে, বিদ্যুৎ মাসুল এবং বিভিন্ন কর ছাড় এবং করে ভর্তুকি এর আওতায় পড়ে। পিছিয়ে পড়া জেলায় শিল্প স্থাপন করলে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে মূলত এই ছাড়ের দিকেই তাকিয়ে থাকে শিল্প সংস্থাগুলি। তৃতীয়ত, ভ্যাট ফেরত দেওয়া। বিশ্বায়নের এই প্রতিযোগিতার বাজারে শুধু পরিকাঠামো বা বিনিয়োগের পরিবেশই নয়, ভর্তুকিও শিল্পায়নের অন্যতম চাহিদা। শিল্পমহলের বক্তব্য, স্ট্যাম্প ডিউটি থেকে বিদ্যুৎ মাসুলে ছাড়, কর ছাড় প্রভৃতি ক্ষেত্রে আর্থিক সুবিধা মিললে সংস্থাটিও উৎসাহ পায়। আবার লগ্নির কিছুটা পুঁজিও ফিরে আসে সংস্থার ঘরে। তাই কোনও রাজ্যে বিনিয়োগের কথা ভাবলে সব সংস্থাই আগে কষে নিতে চায় আর্থিক সুবিধার হিসেব। উন্নত পরিকাঠামো, স্বচ্ছ প্রশাসন, কারখানা গড়ার জন্য বিভিন্ন সরকারি অনুমোদনে এক জানালা ব্যবস্থার (সিঙ্গল উইনডো সিস্টেম) পাশাপাশি আর্থিক সুবিধা তাই আজ সমান ভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আর তাকে সামনে রেখেই প্রতিটি রাজ্যের মধ্যে চলছে বিনিয়োগ টানার প্রতিযোগিতা। দেখা যাচ্ছে, প্রতিটি রাজ্যই বাজেটে এই ভর্তুকির জন্য বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ বাড়াচ্ছে।
শিল্প সংস্থাগুলিকে এই সব ছাড় দিয়ে রাজ্য কী পায়? নতুন শিল্প স্থাপন হলে, বিনিয়োগ এলে সেই রাজ্যে কর্মসংস্থান বাড়ে। তাই রাজ্যগুলি নানা ছাড় দিয়ে শিল্প সংস্থাগুলিকে নিজেদের দিকে টানার চেষ্টা করে। বিশেষ করে বিজেপি আমলে হিমাচলপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড-সহ উত্তর ভারতের বিভিন্ন পাহাড়ি রাজ্যে এ ধরনের ছাড়ের কথা ঘোষণা হওয়ার পর সে দিকেই দৌড়েছে লগ্নি। পরবর্তীতে দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতের রাজ্যগুলিও একই পথে হেঁটেছে।
পশ্চিমবঙ্গও বড় ও ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য বিভিন্ন ধরনের আর্থিক সুবিধা নীতি প্রণয়ন করেছে। বাঁকুড়া, বীরভূম, পুরুলিয়ার মতো পিছিয়ে পড়া জেলায় কারখানা গড়লে বাড়তি আর্থিক সুবিধা দেওয়ার কথাও ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এই সব সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে এত দিন সরকারি প্রতিশ্রুতি কতটা রক্ষা করা হয়েছে?
বহু শিল্প সংস্থার অভিযোগ, লগ্নি করার পর সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরে ঘুরে ঘুরে জুতোর শুকতলা ক্ষইয়ে ফেললেও সময় মতো আর্থিক সুবিধা মেলেনি। বড় সংস্থাগুলিকে হয়তো সে ভাবে হেনস্থা হতে হয় না, কিন্তু মাঝারি সংস্থাগুলির পাঁচ-সাত বছর লেগে যায়। আর ছোট সংস্থা? তাদের কেউ দেখার নেই!
শিল্পমহলের বক্তব্য, লগ্নিকারীরা ব্যবসা করতে আসেন। স্বেচ্ছাসেবা করতে নয়। ফলে প্রতিশ্রুতি দ্রুততার সঙ্গে সময়মতো পূরণ করতে না পারলে লগ্নিকারীদের আস্থা হারায় রাজ্য। বণিকসভা ইন্ডিয়ান চেম্বার অফ কমার্স সূত্রের খবর, বছর কয়েক আগে তাদের এক সমীক্ষায় এ রাজ্যের শ্লথগতির ছবিটাই ফুটে উঠেছিল। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, এ ধরনের সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে গুজরাত, কর্নাটক, দিল্লি, হরিয়ানার মতো রাজ্য যত সময় নেয়, পশ্চিমবঙ্গ নেয় তার থেকে অনেক বেশি সময়। শিল্পমহল আরও বলছে, কর ছাড়ের ক্ষেত্রে যে ভর্তুকির প্রতিশ্রুতি রাজ্য দিয়ে থাকে, সেই বাবদ টাকা বাজেটে বরাদ্দ হলেও কার্যক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দফতরের হাতে পৌঁছতে অনেক সময় নেয়। তখন সরকার অবস্থা সামাল দিতে উল্টে ঋণ নিতে বলে, যার সুদ বেশ চড়া। শিল্প সংস্থাগুলির অনেকেরই বক্তব্য, যেখানে ভর্তুকি পাওয়ার কথা সেখানে চড়া সুদে ঋণ নেব কেন?
তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প সূত্রের খবর, সল্টলেকের সেক্টর ফাইভের একটি মাঝরি মাপের তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা কলকাতা থেকে ব্যবসা শুরু করে দেশের অন্য প্রান্তেও এখন পা রেখেছে। কিন্তু তাদের অভিযোগ, রাজ্যের সংশ্লিষ্ট দফতরে সমস্ত নথিপত্র দেওয়ার পর বারবার তাগাদা দিয়েও এখন পর্যন্ত তারা কোনও আর্থিক সুবিধা পায়নি। এই অবস্থায় তারা হাল ছেড়ে দিয়েছে। অথচ এই রাজ্যেই তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে আরও বেশি লগ্নি টানতে সফটওয়্যারের পাশাপাশি ২০১০ সালে হার্ডওয়্যারেও সেই সুবিধা দেওয়া কথা ঘোষণা করেছে রাজ্য।
রাজ্যের এক বণিকসভার কর্তা জানান, বাঁকুড়ার মতো অনুন্নত এলাকায় ‘ফেরো অ্যালয়’ শিল্প গড়ার জন্য সস্তায় বিদ্যুৎ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিল রাজ্য। কারণ এই শিল্পের উৎপাদন খরচের প্রায় অর্ধেকই চলে যায় বিদ্যুতের বিল ভরতে। কিন্তু প্রতিশ্রুতি মতো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা মেলেনি বলে শিল্পের অভিযোগ।
ভ্যাট ফেরত দেওয়া নিয়েও সরকার প্রতিশ্রুতি রাখেনি বলে গত কয়েক বছর ধরেই সরব শিল্পমহল। তাদের অভিযোগ, তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত এ নিয়ে আশ্বাস দিলেও সরকারি স্তরে কাজের কিছুই কাজ হয়নি। চর্ম শিল্প মহলের দাবি, এই বাবদ কয়েকশো কোটি টাকা তাদের প্রাপ্য। তাদের আরও অভিযোগ, দূষণ এড়াতে বানতলায় সরে গিয়েছিল ট্যানারিগুলি। কিন্তু সেখানে যেমন পরিকাঠামো তৈরি হয়নি, সে রকমই আজও বহু ট্যানারি সরকারি আর্থিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এই অবস্থার বদল না হলে অন্য রাজ্যে লগ্নির পাড়ি দেওয়ার ছবিটা কিন্তু একই থাকবে বলে তাঁদের আশঙ্কা।
আজ আলোচনার আসরে উপস্থিত থাকবেন এমন এক শিল্পকর্তার কথায়, “নতুন সরকার যদি তাঁদের ইস্তাহারের প্রতিশ্রুতির ৫০ শতাংশও পূরণ করতে পারেন, তা হলেও রাজ্যের শিল্প মানচিত্রটি বদলে যাবে।” আর এক বণিকসভার কর্তার কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি রাখেন। আজ উনি এই বিষয়ে কী বলেন, তা শোনার অপেক্ষায় থাকলাম।” |
|
|
|
|
|