বাগদা গ্রামীণ হাসপাতালের
‘নেই’ রাজ্যে দিশাহারা রোগীরা সীমান্ত মৈত্র • বাগদা |
মমতা দেখুন  |
|
মুখ্যমন্ত্রী পদে বসার পরেই রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাল ফেরাতে উদ্যোগী হয়েছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতার বিভিন্ন হাসপাতালে আচমকা পরিদর্শনে গিয়ে সেখানকার বেহাল পরিষেবার উন্নতির জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপও করেছেন। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে তাঁর তৎপরতায় হাসপাতালগুলিতে সুচিকিৎসার ব্যাপারে আশার আলো দেখতে শুরু করেছেন রাজ্যের মানুষ। শুধু শহরের হাসপাতালগুলিই নয়, জেলা হাসপাতাল থেকে শুরু করে মহকুমা হাসপাতাল এমনকী প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতেও চিকিৎসা পরিষেবা দীর্ঘদিন ধরে বেহাল সে ব্যাপারে ওয়াকিবহাল মুখ্যমন্ত্রী ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। সাধারণ মানুষকে চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে যে কোনওরকম গাফিলতি বরদাস্ত করা হবে তাও জানিয়েছেন তিনি। তবে মুখ্যমন্ত্রী তথা তথা স্বাস্থ্য দফতেরর ভারপ্রাপ্ত হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিদের্শ যে এখনও অনেক জায়গাতেই পৌঁছয়নি তার প্রমাণ পাওয়া গেল উত্তর ২৪ পরগনার বাগদা গ্রামীণ হাসপাতালে। |
 |
পুরুষ ও মহিলা রোগী একই শয্যায়। |
সোমবার, ১৩ জুন সকালে শরীরে প্রবল জ্বর আর শ্বাসকষ্ট নিয়ে বহির্বিভাগে দেখাতে এসেছিলেন বৃদ্ধা বিভা বিশ্বাস। চিকিৎসক তাঁকে রক্ত পরীক্ষা করাতে বলেছেন। রক্ত পরীক্ষার জন্য হাসপাতালের নির্দিষ্ট ঘরে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, সেদিন আর রক্ত পরীক্ষা হবে না। সেখান থেকে তাঁকে বলা হয় রক্ত পরীক্ষার জন্য পরের সোমবার আসতে। দেরি হলেও বৃদ্ধার কিছু করার নেই, কারণ বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে বাইরে থেকে রক্ত পরীক্ষা করানোর মতোআর্থিক সামর্থ্য নেই বিভাদেবীর। বাড়ি বাগদার কর্দকুলবেড়িয়া গ্রামে। স্বামী খেতমজুরের কাজ করেন। বিভাদেবী বললেন, “এই নিয়ে গত এক মাসে তিন বার জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে এলাম। প্রতিবারই বলা হচ্ছে রক্ত পরীক্ষার জন্য পরে আসতে। একবার হাসপাতালে যাওয়া-আসা করতে ৪০ টাকা খরচ। তার উপর বাইরে রক্ত পরীক্ষা করানোর খরচ বেশি। আমাদের অত টাকা কোথায়?” স্পষ্টতই হতাশার সুর বৃদ্ধার গলায়। অবশ্য এই অভিজ্ঞতা শুধু বিভাদেবীর একার নয়। হাসপাতালে আসা প্রায় প্রতিটি রোগীকেই এই সমস্যায় পড়তে হয়। |
 |
ওষুধ নেওয়ার জন্য রোগীদের লাইন। দেখা নেই ফার্মাটিস্টের। |
বাগদা ব্লক গ্রামীণ হাসপাতালে বেহাল চিকিৎসা পরিকাঠামো দীর্ঘদিনের। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ব্লক গ্রামীণ হাসপাতালে যে সুযোগসুবিধা পাওয়ার কথা তার কিছুই মেলে না। অথচ এই হাসপাতালের উপরে প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষ নির্ভরশীল। কিন্তু এই হাসপাতালের বেহাল পরিষেবার কারণে তাঁদের নির্ভর করতে হয় প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে বনগাঁ মহকুমা হাসপাতালের উপরে। বাগদা হাসপাতালের বেহাল পরিষেবার বিষয়টি স্বীকার রেছেন স্থীনীয় বিধায়ক ও রাজ্যের মন্ত্রী উপেন বিশ্বাস। তিনি বলেন, “আমি সরেজমিন ওই হাসপাতালে গিয়েছিলাম। ন্যূনতম পরিষেবাও সেখানে পান না রোগীরা। প্রয়োজনীয় চিকিৎসকের অভাব রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তার সঙ্গে কথা বলব।”
হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেল, প্রয়োজনীয় সংখ্যায় শয্যা না থাকায় একই শয্যায় পুরুষ এবং মহিলা রোগীকে রাখা হয়েছে। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেল, পাঁচজন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও আছেন মাত্র তিন জন। চক্ষ বিভাগে কোনও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকলেও একজন টেকনিশিয়ান ছিলেন। কিন্তু এক বছর ধরে তাও নেই। একজন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ চিলেন। তাঁকেও স্বাস্থ্য দফতরের পক্ষ থেকে বসিরহাটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ফলে ওই বিভাগেও সমস্যা রয়েছে। হাসপাতালে নেই আলট্রাসোনোগ্রাফির ব্যবস্থা। |
 |
ডানদিকে, তালাবন্ধ চক্ষুবিভাগ। |
ম্যালেরিয়া এবং এইচআইভি ছাড়া রক্তের আর কোনও পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। এর সুযোগ নিয়ে গোটা হাসপাতাল জুড়ে ব্যবসা ফেঁদেছে দালালচক্র। মেলে না কুকুরে কামড়ানো, সাপে কাটার ওষুধ। সর্দি, কাশি, জ্বরের ওষুধ মিললেও পাওয়া যায় না অন্য রোগের ওষুধ। রোগীদের ওষুধ দেওয়ার জন্য ফার্মাটিস্ট থাকলেও তাঁর আসা-যাওয়ার কোনও নির্দিষ্ট সময় নেই। হাসপাতাল হলেও নেই অপারেশন থিয়েটার, নেই অ্যানাস্থেটিস্ট। চিকিৎসক, নার্স ও কর্মীদের আবাসনগুলিও বেহাল। তার উপর সন্ধ্য হলেই হাসপাতাল চত্বরে আনাগোনা বাড়ে সমাজবিরোধীদের। কোনও নিরাপত্তা কর্মী নেই। রোগী থেকে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী সকলেই নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন। বিএমওএইচ সৌরভ পাইক হাসপাতালের বেহাল পরিষেবার কথা স্বীকার করে বলেন, “অর্থাভাবেই চিকিৎসার পরিকাঠামোর উন্নতি ঘটানো যায়নি।” সব মিলিয়ে হাসপাতাল নামটুকুই সম্বল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সুকান্ত শীল বলেন, “বাগদা গ্রামীণ হাসপাতালের চিকিৎসা পরিষেবার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা রয়েছে। সেগুলি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
|
ছবিগুলি তুলেছেন পার্থসারথি নন্দী। |
|