বিলে জমি ফেরত হবে না, দাবি করেই বেরিয়ে গেলেন বিরোধীরা
যে পদ্ধতিতে সরকার সিঙ্গুর-বিল এনেছে, তাতে কৃষকেরা জমি ফেরত পাবেন না বলে বিধানসভা অধিবেশন থেকে ওয়াকআউট করে দাবি করল সিপিএম। তারই পাশাপাশি, সিঙ্গুর-বিল নিয়ে অবস্থান নিতে গিয়ে সিপিএমের ‘দিশাহীনতা’ মঙ্গলবার সারা দিনের ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। শেষ পর্যন্ত কক্ষত্যাগ করার সিদ্ধান্তে বহু বাম বিধায়ক ক্ষুব্ধ। আচমকা এমন সিদ্ধান্তে কৃষকদের কাছে ‘ভুল বার্তা’ যাবে বলেই তাঁদের আশঙ্কা।
সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট থেকে শুরু করে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলে এসেছেন, সিঙ্গুরের জমি ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্তে তাঁদের ‘নীতিগত’ আপত্তি নেই। কিন্তু গোটা বিষয়টিতে দল এবং বামফ্রন্টের অন্দরে সমন্বয়ের অভাব এ দিন প্রকাশ্যে এসে গিয়েছে। বিলের সমর্থনে বাম বিধায়কেরা নিজেদের বক্তব্য পেশ করার পরেও বিলের নানা খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সূর্যবাবু। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় তার কোনও জবাব না-দেওয়ায় সূর্যবাবুর নির্দেশে বাম বিধায়কেরা কক্ষত্যাগ করেন। পরে সূর্যবাবু বলেন, “যে ভাবে বিল এনেছে, তাতে চাষিরা জমি ফেরত পাবেন না।”
বস্তুত, সোমবার আলিমুদ্দিনে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের উপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, ‘ইচ্ছুক-অনিচ্ছুক’ পার্থক্য না-করে ‘প্রকৃত কৃষকে’রা সকলেই যাতে জমি ফেরত পান, বাম বিধায়করা বিধানসভায় সেই দাবি তুলবেন। এর জন্য তাঁরা প্রয়োজনীয় সংশোধনী দিয়ে আলোচনার পরে বিলটি সমর্থনও করবেন। ওই সভায় উপস্থিত এক সিপিএম নেতার কথায়, “কোনও ভাবেই যাতে কৃষকদের মনে না হয়, বামেরা এই বিলের বিরোধিতা করছে। সেটাই ছিল দলীয় সিদ্ধান্ত।” বিতর্কে অংশ নিয়ে বাম বিধায়কেরা সেই সুরেই বক্তৃতা করেন। কিন্তু যে ভাবে সূর্যবাবুর নেতৃত্বে হঠাৎ করেই কক্ষত্যাগ করা হয়, তাতে কৃষকদের কাছে ‘ভুল বার্তা’ যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে বামেদের একাংশ মনে করেন। কক্ষত্যাগ যে করা হবে, সেই সিদ্ধান্ত প্রাক্তন ভূমিমন্ত্রী রেজ্জাক যেমন জানতেন না, তেমনই বিতর্কে অংশগ্রহণকারী ফরওয়ার্ড ব্লকের অক্ষয় ঠাকুর, সিপিআইয়ের আনন্দ মণ্ডল-সহ সিপিএমের বহু বিধায়কই জানতেন না। সভায় ঢোকার আগে এ দিন বামফ্রন্টের পরিষদীয় দলের কয়েক জন নেতার মধ্যে প্রাথমিক কথা হয়েছিল প্রয়োজনে কক্ষত্যাগের ব্যাপারে। প্রতিবাদের জন্য ওটাই ঠিক পথ বলে তাঁদের মনে হয়েছিল। কিন্তু সিপিএমের সচেতক হওয়া সত্ত্বেও রেজ্জাককে তা বলা হয়নি, অন্য বিধায়কদের বেশির ভাগই তা জানতেন না। সূর্যবাবু কক্ষত্যাগের নির্দেশ দিলে বাধ্য হয়েই সকলে তা মেনে নেন। পরে ঘনিষ্ঠ মহলে ক্ষুব্ধ রেজ্জাক বলেন, “চাষিরা যে এ কাজ ভাল ভাবে নেবে না, দল তা পরে বুঝবে। এ ভাবে কক্ষত্যাগ করা হবে, তা আগে জানতাম না।”
কক্ষত্যাগের পরে বিরোধী নেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। মঙ্গলবার। নিজস্ব চিত্র
প্রসঙ্গত, সোমবার আলিমুদ্দিনের বৈঠকে রেজ্জাকও উপস্থিত ছিলেন।
সূর্যবাবুর অবশ্য দাবি, তাঁরা কক্ষত্যাগ করায় কৃষকদের কাছে কোনও ‘ভুল বাতার্’ যাবে না। সূর্যবাবুর বক্তব্য, “তাঁরা বুঝতে পারবেন, আমরা তাঁদের স্বার্থেই বিলে কিছু পরিবর্তনের কথা বলেছিলাম।” বিধানসভা নির্বাচনের রায় যে সিঙ্গুরের কৃষকদের জমি ফেরতের পক্ষে গিয়েছে, তা জানিয়েও সূর্যবাবু বলেন, “আমরা বিলের উদ্দেশ্যকে সমর্থন করছি। কিন্তু যে ভাবে বিল আনা হয়েছে, তাতে প্রকৃত চাষিরা জমি ফেরত পাবেন না। নানা আইনগত সমস্যা দেখা দেবে। সে সব সমস্যা দূর করে বিল পেশ করার জন্য আমরা সরকারের কাছে অনুরোধ করেছিলাম। যাতে চাষিরা দ্রুত জমি ফেরত পেতে পারেন। কিন্তু তা মানা হয়নি। তাই কক্ষত্যাগ করেছি।”
যে ভাবে বিলের সমর্থনে বক্তৃতা দেওয়ার পরেও বাম বিধায়কেরা কক্ষত্যাগ করেছেন, শিল্পমন্ত্রী তৃণমূলের পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও সেচমন্ত্রী কংগ্রেসের মানস ভুঁইয়া একযোগে তার সমালোচনা করেছেন। আলাদা আলাদা ভাবে বললেও তাঁদের বক্তব্যের নির্যাস সূর্যবাবুরা কৃষকদের ‘বন্ধু’ নন। তাই বিল পাশ হওয়ার আগেই কক্ষত্যাগ করেছেন। পার্থবাবু বলেন, “এই দিনটি ঐতিহাসিক। সূর্যবাবুরা এ দিন অধিবেশনে যে নাটক করলেন, তা তো কৃষকদের বিরুদ্ধেই করলেন! আমরা সরকারে আসার আগে বারবার বলতাম, সূর্যবাবুদের সরকার মুখে যা বলে, কাজে তা করে না। আমরা বলতাম, দ্বিচারিতার সরকার। ওঁরা এখনও মুখে বলছেন কৃষকদের জমি ফেরতের পক্ষে। কিন্তু কাজে কী করলেন! আজকেও প্রমাণিত হল ওঁরা কৃষক-বিরোধী!”
জমি ফেরত দিচ্ছে নতুন সরকার। আইনি জটিলতায় যদি কৃষকেরা জমি ফেরত না-পান, তা হলে বামেদের ‘দায়’ কী? ‘দায়’ তো নতুন সরকারের। জবাবে সূর্যবাবু উত্তেজিত হয়ে বলেন, “জমি ফেরতের নামে মানুষ হেনস্থা হবেন। তাঁরা যাতে হেনস্থা না-হন, তাই আমরা আইনের বিভিন্ন ফাঁকের কথা বলেছি। এত তড়িঘড়ি করে বিল আনায় ওরাও তো অনেক সংশোধনী এনেছে। তাই আইনের ফাঁকের কথা উল্লেখ করে আমরাও সংশোধনী দিয়েছিলাম।” সভা ছেড়ে বেরিয়ে এসে বাম বিধায়কদের সঙ্গে নিয়ে সূর্যবাবু সাংবাদিক বৈঠক করেন। তিনি বলেন, “আমরা যে সংশোধনী দিয়েছিলাম, তা কৃষক স্বার্থেই দিয়েছিলাম। সরকারের ঘোষিত নীতি চাষিদের জমি ফেরত দেওয়া। কিন্তু যে বিলে এ কাজ বাস্তবায়িত না-হয়ে আরও জটিল হবে, তাকে আমরা সমর্থন করতে পারি না। কৃষকেরা জমি ফেরত পাবে কি না, সে ব্যাপারে আমরা সুনির্দিষ্ট কিছু প্রশ্ন করেছিলাম। কিন্তু সরকার তার জবাব দেয়নি।”
রাজ্যে ক্ষমতার পরিবর্তনে সিঙ্গুরে জমি ফেরতের দাবিতে আন্দোলন পার্থবাবুদের অন্যতম হাতিয়ার ছিল। পার্থবাবু সেই বিষয়ে উল্লেখ করে বলেন, “মানুষ এ বার পরিবর্তনের পক্ষে রায় দিয়েছেন। ফলে, সূর্যবাবুরা আত্মবিশ্লেষণ করে কৃষকের পাশে দাঁড়াবেন বলে ভেবেছিলাম। কিন্তু সুদীর্ঘ দিন ধরে ওঁরা যে অত্যাচার ও সন্ত্রাস চালিয়েছেন, সেই মানসিকতা থেকে এখনও বেরিয়ে আসতে পারেননি বলে কক্ষত্যাগ করেছেন!” একই ভাবে মানসবাবুও বলেন, “সিঙ্গুর সংক্রান্ত বিলকে সমর্থন না-করে বিরোধীরা যে কক্ষত্যাগ করলেন, তা থেকে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে সূর্যবাবুদের শাসক দলের সেই আগ্রাসী মানসিকতা এখনও রয়ে গিয়েছে! সিঙ্গুরে কৃষকদের জমি কেড়ে নিয়ে ওঁরা যে পাপ করেছিলেন, এ দিন বিলকে সমর্থন করে সভায় থাকলে সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারতেন! ওঁরা সেই কৃষক-বিরোধীই রয়ে গেলেন!”
Previous Story South Next Story



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.